চার্লি চ্যাপলিনের নির্বাক চলচ্চিত্রগুলো দেখলে ভাষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। অভিব্যক্তি পূর্ণ মুখ, দেহভঙ্গি এবং আবেগের মাধ্যমে তিনি তার গল্প কণ্ঠ ছাড়াই দৃশ্যাকারে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। নীরব গল্প বলার সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এর সর্বজনীন বোধগম্যতা। যে কোনো ভাষার মানুষের বুঝতে বা বিনোদন পেতে সমস্যা হয় না। চ্যাপলিন বলেছিলেন, ‘অ্যাকশন সাধারণত শব্দের চেয়ে বেশি বোঝা যায়। একটি অঙ্গভঙ্গি অনুবাদ করার প্রয়োজন নেই। সৃষ্টির আদিতেও তো কোনো ভাষা ছিল না, কিন্তু নিশ্চয়ই মানুষ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতো। নৃবিজ্ঞানীদের মতে ৪-৬ মিলিয়ন বছর আগে অস্ট্রালোপিথেকাসের মতো মানুষের প্রারম্ভিক পূর্বপুরুষ সম্ভবত যোগাযোগের জন্য মৌলিক কণ্ঠস্বর এবং অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করতেন, কিন্তু জটিল ভাষা তখনও উপস্থিত ছিল না। মানুষের ভৌগোলিক স্থানান্তর, বিচ্ছিন্নতা এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে ভাষার বৈচিত্র্য বিকশিত হয়েছে। ভাষার বৈচিত্র্য যদিও জাতীয় পরিচয় গঠনে ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু কালক্রমে বিভিন্ন ভাষাগত গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ, স্বীকৃতি বা স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করার কারণে একই সঙ্গে এটি সংঘাত ও যুদ্ধের উৎসও হয়েছে।
কথা বলা এবং লেখা হলো ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে অভিব্যক্তি প্রকাশের দুটি পদ্ধতি; তন্মধ্যে লেখার অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগে মানুষ সংগঠিত ভাষা ব্যবহার করে কথা বলা শুরু করে। মানুষে মানুষে দৈনন্দিন যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাধারণত লেখার চেয়ে কথা বলা অনেক বেশি প্রাধান্য পায়। যদিও সঠিক পরিসংখ্যান প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে, তবে বেশ কয়েকটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে প্রতি ঘণ্টা লেখার বিপরীতে একজন ব্যক্তি প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা কথা বলে থাকে। ই-মেইল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টেক্সটিং, পোস্টিং, ব্লগিং ইত্যাদি সত্ত্বেও একটি নির্দিষ্ট দিনে মানুষ লেখার চেয়ে কথা বলায় ৬-১০ গুণ বেশি সময় ব্যয় করে থাকে। যারা লিখতে পারেন না তারাও মোবাইলে কণ্ঠ দিয়ে লেখার কাজ চালিয়ে নিতে পারছেন। কথা বলার জন্য আমাদের বাগ্যন্ত্র রয়েছে। কণ্ঠ, অগ্রতালু, দন্তমূল ও ওষ্ঠাধর নিয়ে বাগ্যন্ত্র গঠিত। তবে বাগ্যন্ত্র শব্দ উৎপাদনের একবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে কাজ করে থাকে। এদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করে থাকে মস্তিষ্ক, ডায়াফ্রাম, ফুসফুস, ল্যারিংস, ভোকাল কর্ড (ফোল্ড) ও জিহ্বা। শ্বাসনালি (ট্রাকিয়া) একটি নল যা গলার নিচের দিকে ব্রঙ্কাস নাম ধারণ করে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে দুপাশের ফুসফুসে ঢুকে যায়। স্বাসনালি উপরের দিকে যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকেই শুরু ল্যারিংস, যা মুখগহ্বরে উন্মুক্ত হয়। ৪-৫ সেমি লম্বা ল্যারিংস ভয়েস বক্স অর্থাৎ স্বরযন্ত্র হিসেবে কাজ করে থাকে। আর ভোকাল কর্ড হল ভয়েস বক্সের (স্বরযন্ত্রের) ভিতরে পেশির দুটি ব্যান্ড (ভাঁজ), যা খুলতে পারে, বন্ধ হতে পারে এবং শব্দ সৃষ্টির জন্য কম্পন তৈরি করতে পারে।
মানুষের কণ্ঠস্বরের উৎপাদন কীভাবে ঘটে তা ধাপে ধাপে সাজানো যায়। চিন্তা থেকে উচ্চারণ পর্যন্ত পুরো ক্রমটি এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে দ্রুত ও নির্বিঘ্নে ঘটে যায়। মস্তিষ্কের মোটর কর্টেক্স কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়; কথা বলার কেন্দ্র, যেমন ব্রোকাস এলাকায় সংকেত পাঠানো হয়। মস্তিষ্ক বার্তার সমন্বয় সাধন করে এবং শ্বাস, উচ্চারণ এবং উচ্চারণে জড়িত পেশিগুলিতে মোটর সংকেত পাঠায়। ডায়াফ্রাম সংকুচিত হয়ে ফুসফুসকে প্রসারিত করে এবং বাতাস টানার জন্য স্থান তৈরি করে। বক্ষ-পিঞ্জরের (আন্তঃকোস্টাল) পেশি শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। কণ্ঠস্বরের শক্তির উৎস প্রদানের জন্য ফুসফুসে বাতাস টানা হয়। স্বরযন্ত্রের ভোকাল ভাঁজগুলো তাদের অবস্থান সামঞ্জস্য করে, আসন্ন বায়ুচাপের জন্য প্রতিরোধ তৈরি করতে এগুলো আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। মস্তিষ্ক সংকেত দেয় যে কাক্সিক্ষত পিচের উপর নির্ভর করে তাদের কতটা শক্তভাবে সামঞ্জস্য করা উচিত। বায়ু ফুসফুস থেকে শ্বাসনালিতে চলে যায়। ভোকাল ভাঁজগুলোতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর চাপ তাদের কম্পন সৃষ্টি করে এবং একটি মৌলিক শব্দ (ধ্বনি) তৈরি করে। উৎপাদিত কাঁচা শব্দটি গলা, নাকের গহ্বর ও মুখগহ্বরের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় নিদিষ্ট আকার ধারণ করে, একে রিজোনেশন অর্থাৎ অনুরণন বলে; গহ্বরগুলোর আকার এবং সাইজ শব্দের গুণমানকেও প্রভাবিত করে, যাকে টিম্বার বলে। জিহ্বা, ঠোঁট, দাঁত, এবং কোমলতা শব্দটিকে স্বীকৃত ভাষা বা গানে পরিবর্তন করে; এ প্রক্রিয়াকে আর্টিকুলেটশন বলে; আর্টিকুলেশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যঞ্জনবর্ণ, স্বরবর্ণ এবং সিলেবল নির্ধারিত হয়। উৎপাদিত শব্দ বক্তা নিজ কানে শুনতে পায় অথবা কম্পন হিসাবে অনুভব করে; শব্দ উৎপাদন পরিষ্কার ও নিখুঁতভাবে সামঞ্জস্য করার জন্য মস্তিষ্ক এই অডিটরি ফিডব্যাক (রিয়েল-টাইম অ্যাডজাস্টমেন্ট) ব্যবহার করে।
মস্তিষ্কের ব্রোকাস অঞ্চলটির ভূমিকা নিয়ে নতুন কথা আছে। প্রায় ১৫০ বছর পর্যন্ত জানা ছিল এ অঞ্চলটি মানুষের কথাবার্তা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ২০২০ সালে জন হপকিন্স ও বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এডিন ফ্লিঙ্কারের নেতৃত্বে একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন যে জোরে কথা বলার সময় ব্রোকাস অঞ্চলটি কাজই করে না। আবার আস্তে কথা বলা ও একটি সম্পূর্ণ বাক্য বলার সময় এটি সক্রিয় হয়। প্রশ্ন হচ্ছে ব্রোকাস অঞ্চল যদি কাজ বন্ধ রাখে তাহলে মস্তিষ্কের কোন অংশ তখন কথা বলা নিয়ন্ত্রণ করে? জোরে কথা বলার সময় মস্তিষ্ক তার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে একটি নেটওয়ার্ক সৃষ্টির মাধ্যমে কাজ করে; বিশেষ করে প্রাইমারি মোটর কর্টেক্স, পরিপূরক মোটর অঞ্চল এবং সেরিবেলাম কণ্ঠস্বরের তীব্রতা এবং সমন্বয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সুতরাং উচ্চস্বরে কথা বলা কেবল পেশি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (মোটর কর্টেক্সের মাধ্যমে) নয়, বরং কণ্ঠের টিউনিং এবং সমন্বয়ও তন্মধ্যে জড়িত।
মানুষের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক বা স্বাস্থ্যসম্মত কি না তা কয়েকটি সূচক দিয়ে পরিমাপ করা হয়।
১. শব্দের তীব্রতা (লাইডনেস) :
কথা কত জোরে বা উচ্চস্বরে উচ্চারিত হচ্ছে তা নির্দেশ করে। ডেসিবেল (ডিবি)-এ পরিমাপ করা হয়। সাধারণ কথোপকথনের স্বাস্থ্যকর লাইডনেস হচ্ছে ৬০-৬৫ ডিবি। ফিসফিস করে কথা বললে লাইডনেস ২০-৩০ ডিবি এবং চিৎকার করলে তা ৮৫-৯০ ডিবি বা তার বেশি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ করে যে শ্রবণের ক্ষতি এড়াতে ৮৫ ডিবির উপরে শব্দের মাত্রা প্রতিদিন ৮ ঘন্টার বেশি হওয়া উচিত নয়; এটাই দীর্ঘায়িত এক্সপোজারের জন্য নিরাপদ স্তর।
২. ফ্রিকোয়েন্সি (পিচ):
শব্দের উচ্চগ্রাম বা লঘুগ্রাম নির্দেশ করে। হার্টজে পরিমাপ করা হয়। সহজে বোঝার জন্য বলা যেতে পারে- সাধারণত পুরুষ কণ্ঠস্বর নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সির (৮৫-১৮০ হার্টজ), আর নারী কণ্ঠস্বর উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির (১৬৫-২৫৫ হার্টজ)। শিশুর ২৫৫ হার্টজের বেশি। পিচের তারতম্য স্বাভাবিক এবং তা অভিব্যক্তিতে বৈচিত্র প্রদান করে।
৩. কণ্ঠমান (ভয়েস কোয়ালিটি)
কণ্ঠস্বর কতটা পরিষ্কার তা নির্দেশ করে। হারমোনিক-টু-নয়েজ রেশিও (এইচএনআর) দিয়ে পরিমাপ করা হয়। এইচএনআর বেশি হওয়ার অর্থ কণ্ঠের মান ভালো এবং তাতে অবাঞ্ছিত শব্দ (নয়েজ) অনুপস্থিত। নয়েজ বেশি হলে এইচএনআর কমে যাবে। এইচএনআর-এর গ্রহণযোগ্য মাত্রা ২০ ডিবির বেশি।
৪. সময়কাল এবং ক্লান্তি:
কণ্ঠের চাপমুক্ত ও ক্লান্তিবিহীন টেকসই অবস্থা নির্দেশ করে। সুস্থভাবে কণ্ঠ যদি দীর্ঘ সময় ধরেও (স্বাভাবিক অবস্থায় ২-৩ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে) ব্যবহার করা হয় তবে ক্লান্তি, কর্কশতা, অস্বস্তি ইত্যাদি হবে না। যেসব পরিবেশে (যেমন কোলাহলপূর্ণ এলাকা) দীর্ঘ সময় উচ্চস্বরে কথা বলার প্রয়োজন হয় সেখানে ক্লান্তির মাত্রা বেশি থাকে।
৫. ভোকাল রেঞ্জ (অক্টেভ)
একজন ব্যক্তি কোন পরিসীমার মধ্যে পিচ তৈরি করতে পারে তা নির্দেশ করে। ২-৩ অক্টেভের পরিসীমা স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যকর, যদিও তা ব্যক্তির প্রশিক্ষণ ও সহজাত সামর্থ্যরে উপর নির্ভর করে।
খেয়াল রাখতে হবে যে, সুষম কণ্ঠের অভ্যাস বজায় রাখা স্থানীয় সাংস্কৃতিক পছন্দ, পরিবেশগত চাহিদা, জীবনধারা এবং যোগাযোগের অনুশীলন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। তবু উপরোক্ত সূচকসমূহের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যকর মানব কণ্ঠস্বর বজায় রাখার জন্য শীর্ষ ১০টি দেশ হচ্ছে জাপান, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা এবং নরওয়ে। এই দেশগুলির মধ্যে অনেকগুলো আলাপচারিতায় অত্যধিক উচ্চস্বর পরিহার করে, বক্তৃতায় ভদ্রতা, সম্মান এবং সংযমের উপর জোর দিয়ে থাকে। তাদের ভাষার ধ্বনিগত গঠন কণ্ঠের চাপ ছাড়াই স্পষ্ট বচনকে উৎসাহিত করে। কিছু ক্ষেত্রে কণ্ঠের যতো এবং কথা বলার শিষ্টাচারগুলো সাংস্কৃতিক বা পেশাদার অনুশীলনের মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে শক্তিশালী করা হয়। অপরদিকে স্বাস্থ্যকর মানব কণ্ঠস্বর বজায় রাখার ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ ১০টি দেশ হচ্ছে ভারত, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, নাইজেরিয়া, তুরস্ক, গ্রিস, মেক্সিকো, ফিলিপাইন ও সৌদি আরব। এই দেশগুলোর অনেকগুলোতে উচ্চস্বরে কথা বলা বা বক্তৃতাকে উৎসাহ-উদ্দীপনা, আবেগ বা দৃঢ়তার চিহ্ন হিসাবে দেখা হয়। শহুরে কোলাহল বা বড় বড় জমায়েতে প্রায়ই শোনার জন্য একজনের কণ্ঠস্বর উত্তুঙ্গ করার প্রয়োজন হয়। উচ্চস্বরে অভিব্যক্তিপূর্ণ যোগাযোগের বিষয়টি প্রায়শ সংস্কৃতির ভিতরই নিহিত এবং এটিকে সমস্যা হিসেবে নয়, বরং একটি স্বাভাবিক সামাজিক আচরণ হিসাবে দেখা হয়।
তবু সূচক অনুযায়ী কয়েকটি দেশ তুলনা করলে দেখা যায়, লাউডনেস সূচকে জাপান, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডের জনগণ ৫৫-৬৫, যুক্তরাজ্য ৬০-৭০ ডিবির মধ্যে কথা বলে; পক্ষান্তরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৬৫-৭৫, সৌদি আরব ৬৫-৮০ এবং ভারত, ইতালি ও ব্রাজিলের জনগণ ৭০-৮০, নাইজেরিয়া ৭৫-৮৫ ডিবির মধ্যে কথা বলে। ফ্রিকোয়েন্সি সূচকে জাপান, সুইডেন ও যুক্তরাজ্যের পুরুষ ৮৫-১৭০, নারী ১৭০-২৪০, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষ ৯০-১৮০, নারী ১৮০-২৫০, সৌদি আরব ও বাজিলের পুরুষ : ৮৫-১৯০, নারী : ১৭০-২৬০ এবং ভারত ও ইতালির পুরুষ : ৯০-২০০ ও নারী : ১৮০-২৭০ হার্টজে কথা বলে। যার যত এইচএনআর বেশি (সাধারণত ২০ ডিবির বেশি) তার ভয়েস কোয়ালিটি তত ভালো, সে হিসাবে যে সমস্ত দেশের জনগণ ভালো অবস্থায় আছে তার হচ্ছে জাপান (২২-২৫), সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য (২০-২৪), ফিনল্যান্ড (২২-২৫); অন্যদিকে পিছিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৮-২২), সৌদি আরব (১৮-২১), ভারত (১৭-২০), ইতালি ও বাজিল (১৮-২১) এবং নাইজেরিয়া (১৬-১৯)।
বাংলাদেশের মানুষের অবস্থান কোথায়? একটা শোনা ঘটনা বলি। বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল বিদেশে কয়েকদিন ব্যাপী একটি সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে। শেষ দিনে একজন বিদেশি বাংলাদেশীদের জিজ্ঞেস করছে, ‘তোমরা এত জোরে কথা বলো কেন?’ বাংলাদেশের দলনেতা মজা করে উত্তর দিলেন, ‘তুমি তো জানো বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। আমাদের প্রায় ১২ হাজার নদনদী আছে। আমাদের ঘরবাড়ি সব নদীর দুই পাড়ে। এক পাড় থেকে আরেক পাড়ে মানুষজন চিৎকার করে কথা বলে। সেটাই অভ্যাস হয়ে গেছে।’ কিন্তু বাস্তব অবস্থা কী? বাংলাদেশের মানুষ ৬৫-৭৫ ডিবিতে কথা বলে; সুতরাং লাউডনেসের বিচারে বাংলাদেশের জনগণ মাঝারি থেকে উচ্চ সীমার মধ্যে পড়ে। ফ্রিকোয়েন্সি সূচকে পুরুষ ৯০-২০০ ও নারী ১৮০-২৬০ হার্টজে কথা বলে; একে মোটোমুটি স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। ভয়েস কোয়ালিটিতে এদেশের মানুষ মাঝারি অবস্থানে রয়েছে; তাদের এইচএনআর ১৭-২০ ডিবি। শহর এলাকায় শোরগোলের কারণে কণ্ঠে মাঝারি মানের ক্লান্তি চলে আসে; বিশেষ করে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো শহরাঞ্চলে এর মাত্রা বেশি। ভোকাল রেঞ্জ ২ অক্টেভের মধ্যে থাকে। মানবকণ্ঠ থেকে এবার অন্যান্য প্রাণীর কণ্ঠের জোর নিয়ে কথা বলা যাক।
প্রাণীজগতে বিভিন্ন প্রাণী অস্বাভাবিক জোরে শব্দ তৈরি করতে সক্ষম, প্রতিটিই তাদের পরিবেশ এবং প্রয়োজন যেমন যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা বা যৌনমিলনের সাথে খাপ খাওয়ানো। উচ্চতম শব্দ উৎপাদনে রেকর্ডধারী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে নীল তিমি, স্পার্ম তিমি, হাউলার বানর, হাতি, সিংহ, সিকাডাস, হোয়াইট বেলবার্ড ইত্যাদি। নীল তিমি ১৮৮ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ তৈরি করতে পারে; তাদের কম-ফ্রিকোয়েন্সির কণ্ঠস্বর পানির নিচে শত শত মাইল ভ্রমণ করতে পারে, প্রাথমিকভাবে যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়। স্পার্ম তিমি ২৩০ ডিবি পর্যন্ত শব্দ করতে পারে; এরা ইকোলোকেশনের জন্য প্রচণ্ড শক্তিশালী ক্লিক তৈরি করে, যা সমুদ্রের গভীর জলে শিকার ধরার জন্য অপরিহার্য। হাউলার বানরের লাউডনেসের সক্ষমতা ৯০-১০০ ডিবি; মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ঘন বনে তাদের ডাক ৫ কিমি পর্যন্ত শোনা যায়। তারা অঞ্চল প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগের জন্য তাদের উচ্চস্বর ব্যবহার করে। হাতির বৃংহিত ১১০ ডিবি পর্যন্ত হতে পারে; মূলত যোগাযোগের জন্য এবং সতর্কতা সংকেত হিসাবে হাতি এমন শব্দ ব্যবহার করে থাকে। সিংহের গর্জন প্রায় ১১৪ ডিবি পর্যন্ত উঠতে পারে; সিংহরা আধিপত্য জাহির করতে গর্জন করে এবং তা দিয়ে ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত যোগাযোগ করতে পারে। উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী হিসেবে কীটপতঙ্গের প্রতিনিধিও আছে; সিকাডাস, বাংলায় উচ্চিংড়ে বা ঘুর্ঘরে পোকা এক ধরণের বড় পতঙ্গ।
গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল থকে শুরু করে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে দেখা যায়। এরা সাধারণত গাছে বাস করে, গাছের রস খায় এবং বাকলের ফাটলে ডিম পাড়ে। বেশিরভাগ সিকাডাস জীবনের বেশির ভাগ সময় লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে, লুকিয়ে থেকেই পুরুষ সিকাডাস রাতে প্রচণ্ড জোরে কোরাস গান গায়, যার লাউডনেস ১২০ ডিবি পর্যন্ত উঠে যায়। স্ত্রী সিকাডাসকে আকর্ষণ করার জন্যই এমন রক মিউজিক; তবে চূড়ান্ত মিলনের আগেও তারা এমন শব্দ করে থাকে। উচ্চকণ্ঠের পাখিও আছে; পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠের পাখির নাম হোয়াইট বেলবার্ড। উত্তর ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশে আমাজন অরণ্যে এদের বসবাস। পুরুষ বেলবার্ড স্ত্রীদের সঙ্গমে আহ্বানের জন্য ১২৫.৪ ডেসিবেলে ডাক দিয়ে থাকে (গাছ কাটার বৈদ্যুতিক করাত ১২০ ডিবি শব্দ করে থাকে)। উচ্চস্বর হলেও বেলবার্ডের ডাকটি খুব সংক্ষিপ্ত, মাত্র এক সেকেন্ড স্থায়ী হয়, যা তার নিজের শ্রবণশক্তির ক্ষতি প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। মজার ব্যাপার হল, এমন কর্ণবিদারী শব্দে স্ত্রী বেলবার্ড মোটেই ভয় পায় না, বরং সে দ্রুত পুরুষের খুব কাছাকাছি চলে আসে। তাহলে দাঁড়ালো এই যে, পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠের প্রাণী স্পার্ম তিমি (ফাইসেটার ম্যাক্রোসেফালাস)। লক্ষ্যণীয়, পানির ঘনত্বের কারণে পানির নিচের একটি ২৩০ ডিবি শব্দ বাতাসে একই পরিমাপের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। আর স্থলচর প্রাণীদের মধ্যে হাউলার বানর এবং সিংহ সর্বোচ্চ কণ্ঠের অধিকারী।
বসন্তের কোকিলকে ঘৃণা করলেও কোকিল কণ্ঠ শুনলে বাঙালির মন উচাটন হয়ে যায়। কোকিলের ডাক সুরেলা, তাছাড়া তার এইচএনআর বেশি, প্রায়শই ২০ ডিবির কাছাকাছি থাকে, মানে কণ্ঠ পরিষ্কার, শোরগোল নেই। যে কারণে এটি এত মিষ্টি! এমন বাঙালি কবি-সাহিত্যিক পাওয়া মুশকিল যিনি কোকিল নিয়ে লেখেননি। এক গীতিকবি লিখছেন, ‘পালাতে আর পারবে না বসন্তের কোকিল, এবার ডেকে এনেছি উকিল, কণ্ঠে তোমার পড়াবো মালা, বসন্তে জুড়াবে অশান্ত জ্বালা।’ কোকিলকণ্ঠ শিল্পীদের নিয়ে আলোচনা করা যাক। পেশাদার কণ্ঠশিল্পীরা পারফরম্যান্সের সময় খুব কমই ১০০-১১০ ডিবি ছাড়িয়ে যান, কারণ এই স্তরে টেকসই উচ্চারণ তাদের ভোকাল কর্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। রক কনসার্টে ১২০ ডিবি পর্যন্ত কণ্ঠ উঠতে পারে। উচ্চকণ্ঠে গানের জন্য বিখ্যাত কয়েকজন হচ্ছেন লুসিয়ানো পাভারোত্তি (ইতালির অপেরা টেনার), সাড়া জাগানো রক গায়ক মিট লোফ, এসি/ডিসি ব্যান্ডের গায়ক ব্রায়ান জনসন, কুইনের ফ্রেডি মারকারি, কাওয়ালি-শাহেনশাহ নুসরাত ফতেহ আলী খান প্রমূখ।
তবে একজন গায়কের কণ্ঠের উচ্চতা শুধু ডেসিবেলের সাথে সম্পর্কিত নয়; এটি অভিক্ষেপণ, অনুরণন এবং কৌশল সম্পর্কিত, যা ক্ষতি না করেই কণ্ঠস্বরকে বড় দূরত্ব এবং কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে বহন করে নিয়ে যায়। কণ্ঠস্বরের সুস্থতা পরিমাপের উপরিল্লিখিত সূচকসমূহের সাথে গায়কদের স্কেলের সম্পর্ক কী? একজন গায়কের স্কেল সাধারণত তাদের কণ্ঠের পরিসর বা সঙ্গীতের নোটের একটি নির্দিষ্ট সেটের মধ্যে গান গাইবার ক্ষমতাকে বোঝায়। স্কেলের সাথে সূচকসমূহের মিথস্ক্রিয়া রয়েছে। শব্দের তীব্রতা গায়কের কণ্ঠের উচ্চতা নির্ধারণ করে; সুর এবং গতিশীলতায় সমতা নিশ্চিত করতে গায়করা তাদের স্কেল জুড়ে তীব্রতার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। পিচ বা ফ্রিকোয়েন্সির কোন রেঞ্জের মধ্যে একজন গায়ক আরামে এবং আস্থার সাথে গান গাইতে পারেন তা দিয়ে ঐ গায়কের স্কেল সংজ্ঞায়িত করা হয়। হারমোনিক টু নয়েজ অনুপাত (এইচএনআর) সুরেলা শব্দ (কাক্সিক্ষত স্বর) এবং শব্দের (অবাঞ্ছিত শ্বাসকষ্ট বা রুক্ষতা) মধ্যে ভারসাম্য পরিমাপ করে। দুর্বল এইচএনআর একজন গায়কের ব্যবহারযোগ্য স্কেলকে সীমিত করতে পারে, কারণ নোটগুলি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে অস্পষ্ট বা চাপা শোনাতে পারে। ক্লান্তি ছাড়াই স্কেল জুড়ে নোটগুলিকে টিকিয়ে রাখার জন্য কণ্ঠের দম এবং কৌশল গুরুত্বপূর্ণ। ভোকাল রেঞ্জ হচ্ছে পিচের ব্যাপ্তি (অক্টেভে) যার মধ্যে একজন গায়ক সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ নোট তৈরি করতে পারেন; এটি একজন গায়ক কতক্ষণ কণ্ঠের চাপ ছাড়াই তাদের স্কেল ধরে রাখতে পারেন তা নির্ধারণ করে। মাইকেল জ্যাকসনের ভোকাল রেঞ্জ ৪ অক্টেভে বিস্তৃত ছিল, এফ শার্প ২ থেকে সি শার্প ৬ পর্যন্ত।
কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন, বাংলাদেশ টেলিভিশনে সঙ্গীত পরিবশে করেছিলেন। শোনা গিয়েছিল যে তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মাহমুদুন্নবীর মত কণ্ঠের এমন শক্তিশালী ‘বেইজ’ তিনি আর শোনেননি। এই বেইজের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? বেইজ বেশি থাকার অর্থ হচ্ছে মৌলিক ফ্রিকোয়েন্সি (এফ-জিরো) কম থাকা, যা কণ্ঠকে গভীরতা, সমৃদ্ধি ও অনুরণন দান করে। এফ-জিরো কম থাকা দীর্ঘ ও স্থ‚ল ভোকাল ফোল্ডের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যাদের বেইজ বেশি তাদের শক্তিশালী নিম্ন-হারমোনিক্স থাকে; বুকের কণ্ঠের উপর দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ থাকে, যেখানে নিচের পিচগুলি বুকের গহ্বরের মধ্য দিয়ে অনুরণিত হয়। ক্লাসিক্যাল, জ্যাজ বা সোল মিউজিকের মতো ঘরানার গায়কদের জন্য এই গুণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বরযন্ত্রের স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবহার রোগবালাইয়ের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম। পক্ষান্তরে, অভ্যাসগত উচ্চস্বরে কথা বলা মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে; শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে খারাপ পরিণতির কারণ হতে পারে :
শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব :
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ধারাবাহিকভাবে ৭৫-৮০ ডিবির ওপরে কথা বললে ভোকাল কর্ডে অসহনীয় চাপ তৈরি হতে পারে এবং ভয়েস ডিসঅর্ডার হতে পারে। ভোকাল ভাঁজের পুনরাবৃত্তিমূলক জোর কম্পনের ফলে প্রদাহ, নডিউল বা পলিপ হতে পারে। কালক্রমে এর ফলে ভোকাল কর্ডের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে, চিকিৎসার হস্তক্ষেপ, এমনকি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। যারা ধারাবাহিকভাবে উচ্চস্বরে কথা বলেন, যেমন শিক্ষক, পাবলিক স্পিকার বা কল-সেন্টার কর্মী, তাদের ভোকাল কর্ড ডিজঅর্ডার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। উচ্চস্বরে কথা বলার কারণে অত্যধিক চাপ গলার টিস্যুগুলিকে দুর্বল করে সংক্রমণের জন্য আরও সংবেদনশীল করে তুলতে পারে, কণ্ঠকে কর্কশ করে তুলতে পারে। উচ্চস্বরে বক্তৃতা প্রায়শই কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে ঘটে, যেখানে ব্যক্তিরা পারিপার্শ্বিক শোরগোলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য তাদের কণ্ঠস্বর উঁচিয়ে কথা বলেন। এর ফলে শোরগোলের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়, এ অবস্থা ‘লম্বার্ড প্রভাব’ নামে পরিচিত। উচ্চ-ডেসিবেল পরিবেশে প্রলম্বিত সময় কাটালে বক্তা এবং শ্রোতা উভয়ের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে।
উচ্চস্বরে কথা বলার একটা অতি উচ্চ ঝুঁকি হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাডপ্রেশার)। জোরে কথা বলা প্রায়শ চাপের মধ্যে বা দ্বন্দ্বমূলক বা জরুরি পরিস্থিতিতে ঘটে থাকে, যা সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় করে তোলে। এটি ‘ফাইট-অর-ফ্লাইট’ প্রতিক্রিয়াকে উসকে দেয়। যার ফলে অ্যাড্রেনালিন এবং নোরাড্রেনালিন-এর মতো স্ট্রেস হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনগুলি হৃৎপিণ্ডকে দ্রুত পাম্প করতে উদ্দীপিত করে, যা সরাসরি রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন (ট্যাকিকার্ডিয়া) বাড়ায়। তাছাড়া হরমোনগুলি রক্তনালীকে সংকুচিত করে তার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, যা রক্তচাপকে বাড়িয়ে তোলে। জোরে কথা বলার জন্য শ্বাসতন্ত্রকে অধিক পরিশ্রম করতে হয়। জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার ফলে বক্ষঃগহ্বরে চাপ বৃদ্ধি পায়, ফলে শিরার মাধ্যমে হার্টে রক্ত ফেরত পাঠানো অস্থায়ীভাবে হ্রাস পায়। পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহ বজায় রাখার জন্য হার্ট আরও পাম্প করে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যা রক্তচাপের ক্ষণস্থায়ী বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। অনেকক্ষণ ধরে জোরে কথা বলার ফলে হাইপোথ্যালামিক-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল (এইচপিএ) অক্ষের দীর্ঘায়িত সক্রিয়করণ ঘটে, ফলে কর্টিসল হরমোন নিঃসৃত হয় যেটিও রক্তচাপ বাড়ায়।
মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
উচ্চস্বরে কথা বলার জন্য বাড়তি শক্তি এবং পরিশ্রমের প্রয়োজন, যা মানসিক অবসাদ এবং শারীরিক ক্লান্তির কারণ হতে পারে এবং উৎপাদনশীলতাকে ব্যহত করতে পারে। উচ্চস্বরে বক্তৃতা বক্তাকে উদ্বেগের উচ্চতর স্তরে উপনীত করতে পারে, যা দীর্ঘস্থায়ী হলে উদ্বেগজনিত ব্যাধির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সামাজিক এবং পরিবেশগত পরিণতি
জোরে কথা বলা অনেক সমাজে শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ। অভ্যাসগতভাবে যে জোরে কথা বলে তাকে সচরাচর আক্রমণাত্মক বা আধিপত্যশীল হিসাবে বিবেচনা করা হয়; এমন ভাবমূর্তি আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে এবং তাকে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা একাকীত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে। উচ্চস্বরে কথা বলা অধিকাংশ সময় তর্ক বা দ্বন্দ্বের সাথে যুক্ত, ফলে তা আগ্রাসন, উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং সংঘর্ষের আশঙ্কা সৃষ্টি করে। উপাসনালয়, লাইব্রেরি বা কর্মক্ষেত্রের মতো পাবলিক স্পেসে উচ্চস্বরে কথা বলা পরিবেশকে ব্যাহত করে এবং অন্যদের বিরক্তির কারণ হতে পারে। পেশাগত সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। অভিভাবক বা শিক্ষক যারা স্বভাবগতভাবে উচ্চস্বরে কথা বলেন তারা শিশুদের নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারেন। এই আচরণ শিশুদের ভিতর ভয় জাগিয়ে তুলতে পারে, কার্যকর যোগাযোগ কমিয়ে দিতে পারে এবং শিশুদের একই ধরনের উচ্চস্বরে কথা বলা অনুকরণ করতে উৎসাহিত করতে পারে; প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সমস্যাটি স্থায়ী হয়ে যেতে পারে।
নেতিবাচক প্রভাব প্রশমিত করার কৌশল
উচ্চস্বরে কথা বলার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে সুস্থ ও ভালো থাকার সাথে যে স্বাস্থ্যকর কণ্ঠের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে সেদিকে সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া, আমরা শুনি বলেই বলি। যে শিশু প্রথম থেকেই কানে শোনে না সে সাধারণত কথাও বলতে পারে না; এজন্য আমরা বধির ও বোবা একসাথে পেয়ে থাকি। তাই যারা অভ্যাসগতভাবে জোরে কথা বলেন তারা শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন। শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে তারা অডিটরি ফিডব্যাক পান না, অর্থাৎ তাদের কথা নিজ কানে শুনতে পান না বা কম্পনও অনুভব করেন না। ফলে তারা মনে করেন যে কথাটা যথেষ্ট জোরে বলা হয়নি, অন্যরা শুনতে পায়নি। তখন কণ্ঠের জোর বাড়িয়ে দেন।
উচ্চস্বরে কথা বলা হ্রাসকরণে ভয়েস মড্যুলেশন অনুশীলন করা যেতে পারে; ডায়াফ্রাম্যাটিক শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ উচ্চস্বরে কথা বলার সঙ্গে যুক্ত চাপকে হ্রাস করে। বাগ্যন্ত্রের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান একান্ত প্রয়োজন। মানসিক চাপ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। চেঁচামেচি এড়িয়ে চলতে হবে। জনসমাগমে বক্তব্য প্রদানের সময় মাইক্রোফোনের সঙ্গে মুখের সঠিক দূরত্ব নিরূপন করে নিতে হবে। ব্যাকগ্রাউন্ডের শব্দ কমিয়ে জনসমক্ষে কথা বললে কণ্ঠের ওপর চাপ পড়ে না। কর্মক্ষেত্রে সাউন্ডপ্রুফিং ব্যবস্থা থাকলে উচ্চস্বরে কথা বলার প্রয়োজন থাকে না। বাড়িতে টিভি চলছে, সাউন্ড স্বাভাবিক আছে; তখন কারো সাথে কথা বলার সময় নিজের কন্ঠস্বর খুব বেশি না বাড়িয়ে যদি কারো সাথে কথোপকথন বোধগম্যভাবে চালিয়ে নেওয়া যায়, তবে ধরে নেয়া যেতে পারে যে তারা মাঝারি লাউডনেস (৬০-৬৫ ডিবি)-এ কথা বলছেন, যা স্বাস্থ্যসম্মত। কিংবা একটা নীরব কক্ষে ৩-৪ ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন যদি গলা না উঁচিয়ে পরষ্পরের কথা পরিষ্কারভাবে শুনতে পারেন তবে তারাও স্বাস্থ্যসম্মত লাউডনেসে কথা বলছেন। স্বাস্থ্যসম্মত সরবতায় কথা বলার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের উপকার করে না, নিজের ব্যক্তিত্বকে সুনাগরিকের বৈশিষ্ট্যে শোভিত করে এবং সুবিবেচক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে অবদান রাখে।
জোরে কথা বলার সামাজিক বিপদ আরও আছে। মা তার বান্ধবীদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এ সময় তার ছোট ছেলে এলো। ছেলে: কানে কানে একটা কথা বলব? মা: না, কানে কানে কথা বলা আমি একদম পছন্দ করি না। ছেলে: তাহলে জোরে বলব? মা: হ্যাঁ। ছেলে (জোরে): বাবা বলেছে, তোমার চাপাবাজ বান্ধবীরা কখন যাবে?
লেখক : বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ জনস্বাস্থ্য ও হাসপাতাল প্রশাসন বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক।
মন্তব্য করুন