মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ, মর্টার শেল ও গ্রেনেড বিস্ফোরণ। সঙ্গে বিমান হামলায় কেঁপে ওঠা, এই হচ্ছে মিয়ানমার বাংলাদেশ উপকূলীয় সীমান্ত এলাকার বর্তমান পরিস্থিতি। গত ২৮শে নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী যুদ্ধবিমান থেকে হামলা চালালে, কেঁপে ওঠে টেকনাফের দমদমিয়া ঘাট থেকে সর্বদক্ষিণের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত। স্থানীয় বাসিন্দারা বাসা থেকে বেরিয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। এর আগেরদিন, ২৭শে নভেম্বর বুধবার, ট্রলারে মাছ ধরার সময় মিয়ানমার নৌবাহিনীর ছোঁড়া গুলিতে আহত হন সেন্ট-মার্টিনের স্থানীয় জেলে মো. এরশাদ (৪০)। ক্ষত গভীর হওয়ায় বর্তমানে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্যে টেকনাফ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এই সপ্তাহের শুরু থেকেই, অর্থাৎ ২২শে নভেম্বর শুক্রবার রাত থেকে আরাকানের মংডু শহরে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যকার তীব্র সংঘর্ষ চলেছে। এতে টেকনাফের উপকূলীয় ইউনিয়ন হ্নীলার বেশ কয়েকটি বাড়িতে বুলেট আঘাত হেনেছে, যদিও কেউ হতাহত হয়নি। মিয়ানমারের মংডু শহর থেকে মাত্র ৩০-৪০ কি.মি দূরে হওয়ায় টেকনাফের দমদমিয়া, জালিয়াদ্বীপ, সাবরাং ও শাহপরীর দ্বীপ অঞ্চলে বেশ কয়েক মাস যাবত তীব্র নিরাপত্তা সংকট কাজ করছে।
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের ফলে এর আগেও মর্টার শেল, গ্রেনেড ও বুলেট এসে লেগেছে টেকনাফের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে। তবে অক্টোবরের ৯ তারিখে, মিয়ানমার নৌবাহিনী কর্তৃক ৫৮ জন বাংলাদেশি জেলে ও ৬টি মাছ ধরার ট্রলার আটক করলে সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। একই দিনে আরেকটি মাছ ধরার ট্রলারকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে তিনজন বাংলাদেশি জেলে আহত হয় এবং পরবর্তীতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মো. ওসমান (৫০) মারা যান। কিন্তু জল সীমান্তে এই তীব্র সংকটের মূল কারণ কী? মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধই কি একমাত্র নিরাপত্তা সংকট? বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় কেমন পদক্ষেপই বা নেয়া উচিত?
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলা টেকনাফ যার দক্ষিণ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর ও পূর্বে নাফ নদী। অর্থাৎ তিনদিকেই জলসীমা নিয়ে গঠিত এই উপজেলা। টেকনাফ, দেশের অন্যান্য উপজেলার চেয়ে বেশিই নিরাপত্তা সংকটে থাকে, বিশেষত এর অবস্থানের কারণে। টেকনাফের উত্তরে সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য শুধু বন্যপ্রাণীদেরই অভয়ারণ্য নয়, বরং সন্ত্রাসী ও মাদক পাচারকারীদেরও অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সহজে নদীপথ পাড়ি দিলেই সীমান্ত পেরোনো সম্ভব, তাই মাদক সরবরাহের সবচেয়ে বড় র্যুটেও পরিণত হয়েছে এই অঞ্চল।
অন্যদিকে, ২০১৭ সালের পর থেকে ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢলে শুধু টেকনাফই নয়, বরং সমগ্র কক্সবাজারেই আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংকট দেখা দিয়েছে। বেড়েছে অপরাধ প্রবণতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম। তারপরও, অভ্যন্তরীণ সকল সমস্যা ছাপিয়ে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধই বর্তমানে টেকনাফের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সংকট। ২০২১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার সেনাবাহিনী সামরিক ক্যু এর মাধ্যমে ক্ষমতায় বসে। সংবিধানকে বাতিল ঘোষণা করা হয়, অং সান সূচি কে ২৭ বছরের কারাদণ্ড ও ৪০০ রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও এমপিকে গৃহবন্দী করা হয়। একই দিনে দেশের সরকারি টিভি চ্যানেল দখল ও দেশব্যাপী ইন্টারনেট ও টেলিফোন সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। মিয়ানমারের নাগরিকরা তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুললে দেশটি গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
২০২৩ সালে এসে গৃহযুদ্ধ নতুন মোড় নেয়, যখন তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিলে ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ গঠন করে। একই বছরের অক্টোবরের ২৭ তারিখ এই যৌথ বাহিনী মিলে ‘অপারেশন ১০২৭’ পরিচালনা করলে, গৃহযুদ্ধ বহুপাক্ষিকতায় মোড় নেয়। একদিকে মিয়ানমারের তাতমাডো সেনাবাহিনী, এর বিপরীতে যুদ্ধরত বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও এর সাথে যুক্ত তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মিত্রতা। এখানে বলে রাখা ভালো, প্রায় সকল বিদ্রোহী গোষ্ঠীই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা চীনের কাছ থেকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা পেয়ে আসছে। ফলে, প্রতিটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর কার্যক্রম অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দ্বারা।
২০২৪ এর ফেব্রুয়ারির দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণই হারিয়ে ফেলে। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের আরাকান আর্মি, রাখাইনে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ন্যূনতম ৮৬৫ জন তাতমাডো সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। এদিকে, থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন হচ্ছে আরাকান আর্মি, যাদের লক্ষ্য আরাকান বা রাখাইন রাজ্য স্বাধীন করা। আরাকান আর্মির অধিকাংশ সেনাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। অন্যদিকে, রাখাইন রাজ্যে প্রায় ৬ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে।
জাতিগত ও ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত এই দুই জাতির রয়েছে দীর্ঘকালের বিরোধ। যার ফলে, বহুপাক্ষিক ও বহুমাত্রিক এ গৃহযুদ্ধে অস্তিত্বের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারাও। রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসা ও আরএসও কে তাই মিয়ানমার জান্তা সরকার আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আরাকান আর্মিকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে সশস্ত্র মুসলিম রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত থেকে সরিয়ে দিতে।
যুদ্ধের ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। বেশকিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে পালিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় বিজিবির হাতে ধরা পড়ে। এখন পর্যন্ত আটককৃত সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৪০ এর অধিক। আরাকান আর্মির দখল সামলাতে তাতমাডো বাহিনী রাখাইনকে মায়ানমার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফলে রাখাইনে তীব্র খাদ্য, জ্বালানি, ও নিরাপত্তা সংকট, ও মোটাদাগে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। অন্যদিকে, আগষ্টে এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় আরাকান আর্মি প্রায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করে। যারই ফলশ্রুতিতে, সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে তাতমাডো রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মির ত্রিমুখী সংঘর্ষ চলমান। সংঘাত আরো প্রকট হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ক্রমাগত উসকানিতে।
যার খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিকদেরও। টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সহ অধিকাংশ অঞ্চলেই নিরাপত্তা সংকট দেখা দিয়েছে, ওপার থেকে আসা গুলি, জেলেদের ট্রলারে আক্রমণ ও মর্টারের আঘাতে নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন, আহতের সংখ্যা আরো বেশি। এছাড়াও, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেন্ট-মার্টিনে জাহাজ চলাচল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় দ্বীপটিতে খাদ্য, ও জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছিলো। দীর্ঘদিন পর্যটন বন্ধ থাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। অন্যদিকে, দেশের নয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেন্ট-মার্টিনকে ইস্যু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। মূলত, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, সেন্ট-মার্টিনের নিরাপত্তা, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন গড়ে তুলতেই সরকারের এ উদ্যোগ।
যদিও, পয়লা ডিসেম্বরের পর থেকে সীমিত আকারে জাহাজ ও পর্যটন চালু হওয়ায় অবস্থা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কিন্তু, আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই। নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে দক্ষিণে নাফ নদী সংলগ্ন সীমান্ত, বঙ্গোপসাগর ও সেন্ট-মার্টিনের পার্শ্ববর্তী জলসীমায় নৌ-মহড়া, কোস্টগার্ড ও বিজিবির উপস্থিতি আরো সুদৃঢ় করা উচিত। অন্যদিকে, দেশের নয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষত মিয়ানমার প্রশ্নে পরিবর্তন এসেছে। রাখাইন রাজ্য মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় রাজ্যের রোহিঙ্গা, আরাকানীসহ সকল গোষ্ঠীই বাংলাদেশের সহায়তার ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের নিয়ে বহুপাক্ষিক আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। মানবিক সহায়তার পাশাপাশি রাখাইনে স্থিতিশীলতা ফেরানো, রোহিঙ্গা-আরাকানীদের সহাবস্থান এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতেও ঢাকার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ এখন সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় আবারো ওয়াশিংটন-বেইজিং দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘদিন চায়নার বলয়ে থাকা অস্থিতিশীল মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ওয়াশিংটনের সমর্থন পেতে পারে বাংলাদেশ। এতে ট্রাম্পের এন্টি-চায়না নীতির বাস্তবায়নের পাশাপাশি, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এছাড়াও, ঢাকার সাথে নাইপিদোর সংযোগ বাড়লে, ভারতীয় আধিপত্য ও চায়নার প্রভাব অনেকাংশেই কমে আসবে। তাই প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে, রাখাইনে স্থিতিশীলতা ফেরানো এবং সকল গোষ্ঠীদের নিয়ে আলোচনায় বসা জরুরি। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি জরুরি খাবার, জ্বালানি ও মানবিক সহায়তা পাঠানো এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সীমান্তে তুর্কি মডেলে সেইফ জোন বা করিডোর স্থাপন করা যেতে পারে। এবং সবশেষে, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রাখাইন ও নাইপিদোর মধ্যকার সংলাপ স্থাপন করা যেতে পারে। এতে আঞ্চলিক কূটনৈতিক মহলে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বাস ও সামর্থ্য বৃদ্ধি পাবে।
মুহাম্মদ ইরফান সাদিক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন