জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও তার পরবর্তী সময়ে জনগণের যে চাওয়া পাওয়া, যে প্রত্যাশা তা নিয়ে জনগণের মাঝে প্রতিদিনই হিসাব নিকাশ চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার (গত ৮ আগস্ট) পর বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি; বরং মূল্যস্ফীতি বেড়ে চলেছে। এতে সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষ। সাধারণ মানুষ তো অর্থনীতির গতি প্রকৃতি কখন কীভাবে ঠিক হবে এটা তারা বুঝে না, তারা বুঝে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী কত কমদামে সহজে পাওয়া যাবে। পতিত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তের দু:খ কষ্টের শেষ ছিলনা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবে জনগণের প্রত্যাশা বেড়ে যায়।
কিন্তু সকল আশা ও প্রত্যাশা এ সরকার পূরণ করতে পারবে তা আশা করা যেমন ঠিক নয় আবার কিছু প্রয়োজনীয় চাওয়া পাওয়ার প্রতি সরকারের উদাসীনতা ও গ্রহণযোগ্য নয়। তাই সরকারকে জনগণের ভাষা, তাদের চাওয়া পাওয়া বুঝতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বেকারত্ব নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, ব্যবসা বাণিজ্যে গতি ফিরিয়ে আনাসহ আমদানি রপ্তানিতে স্বাভাবিক করার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাতে বলা যায় নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। খবর অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবার ১৪ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। গত নভেম্বরে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে। তিন মাস পরই পবিত্র রমজান মাস। রমজান মাসকে সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের দাম যাতে কোনোভাবেই না বাড়ে, সরকারকে আগে থেকেই তার জন্য বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে কঠিন বাস্তবতা হলো ভোগ্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়লেও মানুষের আয় বাড়ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতিতেও স্থবিরতা চলছে। পণ্য আমদানিও কমছে। দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ভোক্তাদের চাহিদার চেয়ে কম খাবার কিনে খেতে হচ্ছে অথবা সংসারের অন্যান্য খাতের ব্যয় কমিয়ে খাবার কিনতে হচ্ছে।
কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রমজানকে কেন্দ্র করে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে। ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের চাপে সরকার সোয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি করে। এর আগে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন উধাও হয়ে যায়। সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে আট টাকা বাড়ছে। ফলে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন থেকে বিক্রি হবে ১৭৫ টাকায়, যা এত দিন ছিল ১৬৭ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৫৭ টাকা। খোলা পাম তেলের লিটারও ১৪৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৬০ টাকা, যা আগে ছিল ৮১৮ টাকা। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সরকারকে আরও শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়মিত বাজার তদারকির পাশাপাশি বিকল্প উপায়ে পণ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে।
এদিকে দেশে বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে। বর্তমানে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। বিবিএস তথ্যমতে বর্তমানে বেকারের হার ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা ২০২৩ সালের গড় বেকারের হারের চেয়ে কিছুটা বেশি। ২০২৩ সালের গড় বেকারের হার ছিল ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বিগত সরকারের আমলে নানা অনিয়ম দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে বহু শিক্ষিত যুবক বেকার হয়ে পড়ে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন যা কোটা আন্দোলন থেকে শুরু হয়েছিল তার অন্যতম কারণ যুব সমাজের মধ্যে বড় একটি অংশ বেকারত্বের অভিশাপে নিমজ্জিত থাকা। স্বৈরাচারী সরকার সর্বত্র বৈষম্য সৃষ্টি করে মেধাবীদের গুরুত্ব দেয়নি। যার কারণে বহু মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। আর আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতো পতিত সরকার প্রায় শেষ করে দিয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে এখন শিক্ষার্থীরা পড়তে যায়না। আড্ডাবাজি করে দিন কাটায়। অন্তর্বর্তী সরকারকে শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার করে দুর্নীতি অনিয়ম দূর করতে হবে।
ব্যবসা বাণিজ্যে ও এখনো গতি ফিরে আসেনি। ফলে বাজেট বাস্তবায়নে ও সমস্যা হতে পারে। প্রয়োজনীয় এলসি করতে ও ব্যবসায়ীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের/মুনাফার হার নিয়ে ব্যবসায়ীদের মাঝে মিস্রপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যদিও ব্যাংকে টাকা রাখা নিয়ে ভয়ের কোন কারণ নেই তবু গ্রাহকদের মাঝে আতঙ্ক পুরো পুরি এখনো কাটেনি । ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা বাড়াতে হবে। ব্যাংকে টাকা জমা ও অর্থের হাতবদল বাড়াতে হবে। অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য সামাজিক আন্দোলন ও এব্যাপারে আইন প্রয়োগ দ্রুত ও যথাযথ হতে হবে। জনগণ চায় অর্থ লোপাটকারীদের উপযুক্ত সাজা হোক। বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরে আসুক। শহরে চলাচল নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে যানজট নিরসনে বিকল্প ও সৃজনশীল পথেই অগ্রসর হতে হবে।
যানজট নিরসনে অবিলম্বে প্রাইভেটকারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, চৌরাস্তাগুলোয় টানেল নির্মাণ, ছোট ছোট বিকল্প রাস্তা তৈরি করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা ও ট্র্যাফিক পুলিশের জনবল বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যানজটের কারণে অনেক শ্রম ঘণ্টা নষ্ট হয়। যা দেশের উন্নয়নের জন্য হুমকি। বিশেষ করে ঢাকা শহরে ক্রমবর্ধমান জনস্রোত কীভাবে ঠেকানো যায়, সে বিষয়েও কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে । স্বাস্থ্য খাতে গরিবও মধ্যবিত্তের সেবার মান বাড়াতে হবে। জনগণ চায় তার সন্তান শিক্ষাঙ্গনে গিয়ে সৎভাবে আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। শিক্ষার মান উন্নয়ন করে ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনেক। কিন্তু সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব না হলেও একটি অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষায় সচেষ্ট থাকবে । অবাধ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি দরকার। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও চোরাচালান,অবৈধ ও নেশা জাতীয় দ্রব্যের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে পুলিশ সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো তৎপর হতে হবে।
আমাদের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ ও সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতির সম্ভাবনা কে কাজে লাগাতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হবে। এজন্য ইউনিয়ন ও পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন করা উচিত। জনগণ স্থানীয় অনেক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাজনৈতিক সরকার আসার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে জনগণের মাঝে কর্মচাঞ্চল্য ও স্থানীয় ইউনিট সমূহ কার্যকর থাকবে। সরকারের সিস্টেমলস কমবে। পরিশেষে বলতে চাই আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিকে রোদ করতে হবে। শুধু ব্যবসায়ীদের নয় জনগণের সুবিধার প্রতিও সরকারের নজর থাকা চাই।
মো. মাঈন উদ্দীন: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
মন্তব্য করুন