ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৩, ০৫:৩৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শিশু বন্ধু জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান

জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান। ছবি : সৌজন্য
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান। ছবি : সৌজন্য

শিশু চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রবাদ পুরুষ, শিশুবন্ধু, সমাজ হিতৈষী, শিক্ষাবিদ, দক্ষ চিকিৎসা প্রশাসক ও সফল শিল্প উদ্যোক্তা, সদালাপী, সদা সংস্কার মনস্ক এবং সমাজসেবায় একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরষ্কার জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফি খান যিনি এম আর খান হিসেবে ছিলেন অতি পরিচিত, ছিলেন চিকিৎসা ও সমাজসেবায় একজন অনুকরনীয় ও প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। Father of Pediatrics হিসাবে বাংলাদেশে যিনি ছিলেন পরম সম্মানীয়। এই নির্লোভ, প্রচারবিমুখ সদাহাস্য মানুষটি তার বিভিন্ন জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমাজে অসংখ্য মানুষকে সেবা দিয়ে গেছেন।

ডা. এম আর খান সাতক্ষীরা জেলার রসুলপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৮ সালের ১লা আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা (পীরালী বংশখ্যাত) আবদুল বারী খান এবং মাতা জায়েরা খানম (সংবাদপত্র জগতের পথিকৃত মাওলানা মো. আকরাম খান সাহেবের নিকটাত্মীয়) সমাজ হিতৈষী সৃজনশীল পরিবার, ছিলেন সুখ্যাত সাতক্ষীরায়। তার সহধর্মিণী মরহুম আনোয়ারা খান (কলকাতা সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের ছাত্রী)। তিনি নিজেও ছিলেন একজন স্বনামধন্য সমাজসেবী।

শিশুবন্ধু এম আর খান এর জীবন দর্শন হলো- কর্মচাঞ্চল্য আর মহৎ ভাবনার সরোবরে সাঁতার দিয়ে মানব কল্যাণে নিবেদিত চিত্ততা। নিবেদিতা মেডিকেল ইনস্টিটিউট আর অগণিত শিশু চিকিৎসা সদন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার সেই স্বপ্নেরা ডানা মেলে ফিরেছে সাফল্যের আকাশে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিশু, নারী ও অসহায়জনের নতশীর, মূক ও ম্লান মুখে হাসি ফুটিয়ে সাফল্যের তারকারা ঝিলিমিলি করে ফিরত তার ললাটে, তার মুখে-তার সানন্দ তৃপ্তির নিলয়ে। জোনাকীর আলো যেমন অমানিশার আঁধারে মিটি মিটি জ্বলে এক অভূতপূর্ব পেলব শান্তি ও সোহাগের পরিবেশ রচনা করে তেমনি তার সুদক্ষ পরিচালনায়, পৃষ্ঠপোষকতায়, নৈপুণ্যে, নিবেদনে অর্থবহ অবয়ব রচনা করে চলতেন নিত্যনিয়ত। এ সবের মাঝে চির ভাস্বর হয়ে রইবে তার স্মৃতি। ‘উপকার কর এবং উপকৃত হও’ এই মহাজন বাক্য তার জীবন ও কর্মে, মনন ও মেধায় পথ চলা ও জীবন সাধনায় স্বতঃসিদ্ধের মতো অর্থবহ হয়েছে এবং কার্যকর ছিল। আর এ সবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের মতো সারল্যে, সহজিয়া কড়চায়, বন্ধু বাৎসল্যে, স্নেহাস্পদনায়, মুরুব্বিয়ানার মাধুর্যে ছিল তার ব্যক্তি ও চরিত্র উদ্ভাসিত।

জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান মনে করতেন রোগীও একজন মানুষ। আর এ রোগীটি সামাজে আমাদেরই কারও না কারও আত্মীয়স্বজন, এমন কী আপনজন। রোগী যখন ডাক্তারের কাছে আসেন; তখন সাহায্য প্রার্থী, কখনও কখনও অসহায় বটে। আর রোগীটি যদি শিশু হয় তা হলে তো কথাই নেই। ডাক্তারের কর্তব্য হবে রোগীর কষ্ট গভীর মনোযোগের সাথে ধৈর্য সহকারে শোনা, রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। রোগীকে সুস্থ করে তুলতে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যেমন প্রয়োজন; তেমনি রোগীর অভিভাবকদের প্রতি ডাক্তারের সহমর্মিতা প্রদর্শন ও আশ্ব¯ত করাও প্রয়োজন। সব রোগীই তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে এমনটিও ঠিক নয়। কারও কারও সুস্থ হতে সময় লাগতে পারে। মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তিনি বলতেন, হায়াত ও মউতের মালিক যেমন আল্লাহতায়ালা; তেমনি রোগ হতে মুক্তি দাতাও তিনি। তবে রোগীর আপনজনরা এমন যেন বলতে না পারেন যে- ডাক্তার আন্তরিক ছিলেন না, ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

শিশুদের সেবার মানসে তিনি ১৯৮৩ সালে শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঢাকার মিরপুরে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ ও শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং যশোরে শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। মানুষের সৃজনশীল সম্ভাবনার সত্ত্বা তাকে পুষ্টি দিয়ে মননশীল করে সুচিকিৎসা দিয়ে সুস্থভাবে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে- এ সুযোগলাভ তার অধিকার। ডা. এম আর খান শিশু চিকিৎসার ওপর বিদেশে বড় ডিগ্রি অর্জন করে সেখানে উচুঁ মাপের চাকরির সুযোগ ও সুবিধা পরিত্যাগ করে চলে এসেছিলেন নিজ দেশে। দেশে শিশু চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় প্রতিষ্ঠায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন পথিকৃতের ভূমিকায়।

শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন ছাড়াও স্থানীয় জনগণ এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় তিনি তার পেনশনের টাকা, পৈতৃক জমিজমা এবং স্ত্রীর সঞ্চয়ের অর্থে ১৯৮৫ সালে সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এই হাসপাতাল বছরে প্রায় ১৮ হাজার শিশুকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে। ডা. খান ১৯৮৮ সালে তার নিজ গ্রাম রসুলপুরে মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এ স্কুলে প্রায় ৬০০ ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত আছে। এ ছাড়াও তার প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহ হচ্ছে- (১) ডা. এম আর খান অ্যান্ড আনোয়ারা ট্রাষ্ট্র (২) উত্তরা মহিলা মেডিকেল কলেজ (৩) নিবেদিতা চিল্ড্রেন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্স সেন্টার (৪) সেন্ট্রাল হাসপাতাল প্রা. লি. ইত্যাদি। সাতক্ষীরায় নিজের গ্রাম রসুলপুরকে আদর্শ গ্রাম তথা দারিদ্র্যমুক্ত গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার স্বপ্ন উদ্যোগ দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভুয়োদর্শন হিসেবে বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। ‘নিজের গ্রামকে আগে দারিদ্র্যমুক্ত করি’ এই প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ে দীপ্ত বাংলাদেশের সকল সচেতন মানুষ তার মতো কর্মবীরের অনুসরণে একযোগে কাজ করতে পারলে, সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সুদূর পরাহত থাকে না আর। ‘রসুলপুর আদর্শ গ্রাম’ এই মডেলে তার প্রত্যয় ও প্রত্যাশা ছিল গড়ে উঠুক বাংলাদেশের আটষট্টি হাজার গ্রাম ও জনপদ। পল্লী উন্নয়ন ভাবনা ও কর্মযজ্ঞে রসুলপুর ছিল পল্লী উন্নয়নে সমৃদ্ধ চেতনার নাম।

মহৎপ্রাণ মানুষরা নিজের জন্য নয় অন্যের কল্যাণে নিবেদন করেন নিজের সব ধ্যান ধারণাকে। উৎসর্গ করেন নিজের স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ ভাবনাকে। এম আর খান অ্যান্ড আনোয়ারা বেগম ট্রাস্ট ফান্ড এমন এক মহৎ উদ্দেশ্যে নিবেদিত, শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন আর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তিনি উৎসর্গ করেছিলেন নিজের সঞ্চয়, সম্পদ ও সামর্থ্য। একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তার একান্ত প্রত্যাশা ছিল স্থায়িত্ব লাভ করুক জনদরদি এ ফান্ড ও প্রতিষ্ঠান। সাতক্ষীরা তথা দেশের মানুষ পাক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধ জীবনযাপনের দিশা। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে তার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দেখেছেন, শিখেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন মানুষের অসহায়ত্বকে সহায় হয়ে দাঁড়াবার অনিবার্যতা। সুদূর পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামাতে বোধিছড়া গ্রামে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ কোয়ান্টমমতেও তিনি রেখেছেন শিশুবিকাশে তার সৃজনশীল হাতের স্পর্শ। ‘দুর্বল মানুষ যদি পার হয় জীবনের অথৈ নদী’ তাতে নিজের কোনো ক্ষতি নেই বরং বিপদমুক্ত মানুষের কলরবে সাফল্যে ভরবে দেশ ও জাতি। কেন তাই এ পথে পিছিয়ে যাব? রেখেছিলেন এ প্রশ্ন নিজের কাছে, দেশের কাছে।

অধ্যাপক ডা. এম আর খান শিশুরোগ চিকিৎসা ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বিভিন্ন সময়ে তার কর্মের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, হয়েছিলেন ঈর্ষণীয় সম্মানে ভূষিত। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত করে তার প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেন। তার প্রাপ্ত অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কারগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হচ্ছে- (১) শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে অসামান্য অবদানের জন্য স্বর্ণপদক, ১৯৮৬ (২) ম্যানিলাভিত্তিক দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের অ্যাসোসিয়েশন অব পেডিয়েট্রিকস পদক, ১৯৯১, (৩) ওয়ার্ল্ড এসট্রোলজিক্যাল সোসাইটি সংবর্ধনা ও পদক, ১৯৯২ (৪) শেরেবাংলা জাতীয় স্মৃতি সংসদ স্বর্ণপদক, ১৯৯২ (৫) কবি নজরুল ইসলাম জাতীয় পুরস্কার ও স্বর্ণপদক, ১৯৯৩ (৬) বাংলাদেশ পেডিয়েট্রিক অ্যাসোসিয়েশন সংবর্ধনা ও পদক, ১৯৯৪ (৭) ) খান বাহাদুর আহছানউল্লা স্বর্ণপদক, ১৯৯৮ (৮) ইবনে সিনা স্বর্ণপদক, ১৯৯৮ (৮) বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সমাজসেবা স্বর্ণপদক, ১৯৯৯ (৯) সমাজসেবা বিষয়ে অবদানের জন্য একুশে পদক, ২০০৯ (১০) বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক, ২০১৬।

লেখক : ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ - সরকারের সাবেক সচিব, এন বি আরের সাবেক চেয়ারম্যান।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১০

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১১

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১২

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৩

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৪

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

১৫

কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

১৬

পাকিস্তানের জলসীমায় বিপুল তেল-গ্যাস মজুতের সন্ধান

১৭

বিসিবির দুর্নীতির তদন্ত দাবি সাবেকদের

১৮

পাবিপ্রবি ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ

১৯

জেল খেটেছি তবু শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যাইনি : সাবেক এমপি হাবিব

২০
X