আমি দুনিয়ার অন্যতম ধনী দেশ কানাডা আছি। পঁচিশ বছর ধরে টরন্টো মহানগরীতে বসবাস করতেছি । যে শহর দিবানিশি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে । কানাডার আরেক পরিচয় এটি G-সেভেন মানে উন্নত সাত তারকার একটি বিশেষ তারকা রাষ্ট্র ।
সংসদীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা। যার বিভিন্ন ধাপের সরকার পরিচালনা পরিষদ রয়েছে। ফেডারেল, প্রাদেশিক, নগর এবং রুরাল কাউন্টি। দুনিয়ার অভিবাসী দেশগুলোর মধ্যে কানাডা শীর্ষে আছে। টরন্টো মহানগরীর শতকরা ৭৮% শতাংশ মানুষ অভিবাসী । মানে অন্য দেশ থেকে নানান উপায়ে এখানে চলে এসেছে ।
আমার আজকের লেখার শিরোনাম করপোরেট দানবদের রুখতে হবে । কারণ এই করপোরেট দানবদের পরিচালক যারা, তারাই আজ সারা দুনিয়ার বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধাভোগী। সেই সঙ্গে ওই সব তথাকথিত অতিচতুর পরিচালকরা নানান ফন্দিফিকির করে দেশে দেশে অস্ত্র বাণিজ্য, ওষুধ বাণিজ্য, ভোগবিলাসী বাণিজ্য, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদনের বাণিজ্যিক সিনেমা, খেলাধুলা এবং নিরাপদ খাবারের নামে কেমিস্ট্রি শিল্প দিয়ে অনিরাপদ খাবার তৈরি ও বাজারজাতকরণ ইত্যাদি সব সূচকেই ওরা বলিয়ান হয়ে উঠেছে । শুধু তাই নয়, কোনো দেশের শাসক বা সরকার যদি ওইসব করপোরেট দানব পরিচালকদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো জনকল্যাণমূলক কাজ করতে শুরু করে; তাহলে আর রক্ষা নেই । ওই শাসক বা সরকারেকে করপোরেট দানব বাহিনী নানান কায়দা-কানুন করে মসনদ থেকে উপড়ে ফেলে। এমনকি হত্যাকাণ্ড ঘটাতেও পিছপা হয় না। আমেরিকার অতি জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডীকে নাকি ওই একই কারণে খুন করা হয়েছিল । কারণ উনি ওই সময়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এমন কিছু কাজ করার উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন যার কারণে উনাকে করপোরেট দানব বাহিনীর ভাড়াটে বাহিনী খুন করে ।
আরেক জনপ্রিয় আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিল ক্লিনটন। উনি অসলো চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের মধ্যে দুই রাষ্ট্র কায়েমে অনেক দূর এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু উনাকে থামিয়ে দেয়ার জন্য মনিকা লিউনিস্কর কেলেঙ্কারি ওই করপোরেট দানবের মিডিয়া জগতের সামনে নিয়ে আসে। আবার অন্য দিকে কট্টর জায়নবাদী গং ইসরায়েলর শান্তি বাদী নেতা আইজাক রবিনকে দিনদুপুরে সবার সামনে খুন করে। এই ক্ষেত্রে ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ভূমিকা এখন প্রশ্নসাপেক্ষ?
আজ দেশে দেশে চলেছে অর্থনৈতিক অরাজকতা, লুটপাট, দিনের পর দিন টাকার অবমাননা, কাগজি নোট ছাপিয়ে শাসকদল টাকার জোগান দিচ্ছে, আবার ওরাই নিজেদের আখের গোছানোর নামে বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে । আজ মানুষের আদি পেশা কৃষক সমাজের হাতে ওদের দশ হাজার বছর ধরে জমা রাখা ধান বীজের বীজাধার নেই। তথাকথিত গবেষণার নাম করে তথাকথিত ওইসব করপোরেট দানব আমাদের বীজের স্বত্ব নিয়ে গেছে। আমাদের হাজার বছরের সরিষা বা আর অন্য সব মৌলিক খাদ্যের বীজাধার আর কৃষকের হাতে নেই । নিয়ে গেছে ওইসব করপোরেট দানবগং। আমাদের বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব হাতে তৈরি কুটিরশিল্পের খাদ্য ছিল তাও আর গাঁও-গেরামের ছোট ছোট কারিগরদের হাতে নেই। চলে গেছে করপোরেট দানব নবীন মিল কারখানার মালিকদের কাছে । আমার দেখা সত্তর দশকে এমনকি আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের গাঁও-গেরামে চৈত্রসংক্রান্ত উপলক্ষে যেসব মেলা বসত, ওইসব মেলার আয়োজন ছিল গেরাম বাংলার কুটির শিল্পের নানার হাতের তৈরি জিনিসপত্র । খই, মুড়ির মোয়া, বাতাসা, চিনির কদমী, চিনির গছা, মজার রসগোল্লাসহ আরও কত পদ পদবি খাবার, হাতে বোনা ঝালি গেঞ্জি ও পাওয়া যেত ।
আজ আমরা করপোরেট দানবের তথাকথিত গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে না পেরে হারিয়ে ফেলেছি; আমাদের গাঁও-গেরামের ওইসব ছোট ছোট কুটিরশিল্পের বৈচিত্র্যময় বাণিজ্য ।এখন গার্মেন্টস মালিকদের বাচিয়ে রাখতে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, নানান কর্মসূচির নামে। কিন্তু গেরাম বাংলার অবলা-সবলা জরিমন আর করিমনদের কুটিরশিল্পের বিকাশ জারি অব্যাহত রাখতে; ওদের জন্য মাত্র হাজার টাকা ও বরাদ্দ করে না, সরকার বাহাদুর অথবা দরদি? ব্যাংক মালিক পক্ষের করপোরেট মহাজন। এখন চলেছে তথাকথিত উন্নত অর্থনৈতিক ক্লাব । যেমন G-সেভেন । সেখানে থেকে G-টুয়েন্টি। এভাবে ক্লাব আর সমিতির নামে করপোরেট দানব বাহিনী আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে । কংগ্রেস বা সংসদ নির্বাচনে ওই করপোরেট দানব পরিচালকরা অর্থলগ্নি মানে নির্বাচনে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। বিনিময়ে ওদের পক্ষে কাজ করতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি বা সরকার প্রধান বা কংগ্রেস বা সংসদকে ব্যবহার করতেছে; নিজেদের ভাগ্যে আরও বেশি রাষ্টীয় সুবিধা লাভবান হতে।
উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন পালের গোদা করপোরেট সংস্থা বিভিন্ন গবেষণার জন্য এসব দেশের নামকরা ইউনিভার্সিটিগুলোতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ডোনেশন করে যাচ্ছে । মেধাবী অধ্যাপকরা আর তাদের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এখন একদিকে অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য গবেষণা করে ওষুধ আবিষ্কার করে যাচ্ছে । আবার একই ইউনিভার্সিটির মেধাবী অধ্যাপক তার অধীন মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গবেষণা করে সুস্থ মানুষকে খুন করার জন্য, বিভিন্ন দেশের খনিজসম্পদ লুটপাটের জন্য বিভিন্ন বোমাসহ আধুনিক অস্ত্র আবিষ্কার করে যাচ্ছে এবং দেশে দেশে সুস্থ মানুষ কে খুন করে যাচ্ছে এক বা এক ডজন নয়। হাজার হাজার ,লাখ লাখ মানুষ তারা খুন করে যাচ্ছে ইরাক, সিরিয়া,আফগানিস্তান, কুরদিস্তান, ইয়েমেন,সুদান, সোমালিয়া, মালিসহ সাহারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে । ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, আরাকান আর ফিলিপাইনের মিন্দানাও এখন খুন হচ্ছে বনি আদম। খুনের রক্ত এখন ঝরে যাচ্ছে ইউক্রেনে। চীনের দখলে থাকা কাশগড়ে। বিভিন্ন প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নবপ্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আজ নানান ডিভাইস আসক্তি তে এমনভাবে ডুবে গেছে যে, তারা আর এখন ওদের দৈনন্দিন লেখাপড়া, খাওয়াদাওয়া আর খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। পরিস্থিতির এতই ভয়াবহতা যে কানাডার দুটো প্রদেশের হাইস্কুলে এখন থেকে আর ছাত্রছাত্রীরা তাদের মোবাইল ফোনসহ অপরাপর ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবে না । এই জন্য প্রাদেশিক সরকারের পার্লামেন্ট আইন ও পাস করেছে। আমার আজকের লেখার শিরোনাম করপোরেট দানব । এরা আজ দুনিয়ার দেশে তাদের বাণিজ্যিক বহুবিধ পথ ও পাথেয় চালু করেছে। কোথাও তারা হাসপাতাল বানিয়ে রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা চালু করেছে । আবার কোথাও খনিজ সম্পদ আহরণের নামে ওইসব দেশের অজানা গোপন দামি সম্পদ লুট করে যাচ্ছে । করপোরট মহাজনরা মাদকদ্রব্যের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। বিভিন্ন মিডিয়া টিভি চ্যানেলে ওদের বস্তাপচা পণ্যের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এই জন্য তারা বিভিন্ন দেশের উঠতি বহুল জনপ্রিয় তারকাদের মোটা অঙ্কের ডলার দিয়ে মডেল হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে ।
মানুষের অনেক মৌলিক অধিকার এবং চাহিদা দেশে দেশে করপোরেট মহাজনরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক ফন্দি করে ওদের হাতে নিয়ে গেছে । এমতাবস্থায় মানুষ হিসেবে আমাদের আশু করণীয় কি কি? আমরা কি করপোরেট দানবদের দুনিয়াব্যাপী নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারব । এই জায়গাটাতে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা অসহায়। তবে আমরা অবশ্যই একটা কাজ করতে পারি সকল প্রকার আমাদের কেনা পণ্য আমরা আমাদের পছন্দের তালিকা থেকে নেব। আমরা নিজেদের খাদ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজেদের হাতে নেব। ফরমালিনযুক্ত সবজি, মাছ না কিনে বিকল্প পথে আমাদের চারপাশের পরিবেশ থেকে আমাদের মৌলিক খাবারসহ বিভিন্ন পণ্য খরিদ করব বা জোগাড় করব। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পোশাক থেকে শুরু করে জুতা, তৈল সাবানসহ বিভিন্ন নিত্যদিনের পণ্য নিজেরাই জোগানের চেষ্টা করব। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে এখন থেকে কাগজে টাকা না জমিয়ে সোনা রুপার মজুত বাড়াব। কারণ আগামীতে খুব কাছাকাছি সময়ে বিশ্বের ধনী-গরিব দেশের সাধারণ মানুষ এমন একটা মহাসংকটে পড়তে যাচ্ছে; তখন কাগজি মুদ্রার মান আরও কমে যাবে। সেই তা ডলার বা দিনার ইউরো যা-ই হোক না কেন?
লেখক : ফজল মুহাম্মদ টরন্টো থেকে
মন্তব্য করুন