বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাত গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে। বিশেষ করে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর চ্যালেঞ্জ বহুমাত্রিক। তারল্য সংকট, সুশাসন ও গ্রাহক আস্থার ঘাটতির কারণে অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংকে সংকট এখন মারাত্মক পর্যায়ে। দিন দিন সংকটগুলো আরও গভীর হচ্ছে। ব্যাংকের শাখাগুলোতে টাকা উত্তলনের জন্য গ্রাহকদের ভিড় বাড়ছে। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে না পারায় ব্যাংকের শাখাগুলোতে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে পরিস্থিতি যে কোনো মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কাজেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
ব্যাংক খাতের বর্তমান সমস্যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে জটিল। এই সংকট হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। পতিত সরকারের নজিরবিহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, দখলদারি, লুটপাট, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের আর্থিকখাত আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এক সময়ের সবল ও সফল ইসলামী ব্যাংক খাত এখন গভীর সংকটের মুখে।
ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূচনা ২০০৬ সাল থেকে। সে সময়ে ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং ও জঙ্গি অর্থায়নের বানোয়াট অভিযোগ আনা হয়। যুক্তিপ্রমাণ ছাড়াই ঢালাওভাবে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থাকে বিতর্কিত ও কলঙ্কিত করতে জঙ্গি অর্থায়নের নাটক সাজিয়ে তা ফলাও করে প্রচার করা হয়। তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায় ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে মর্মে ঘোষণা দেয়। এতে দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামী ব্যাংক বড় ধরনের ধাক্কা খায়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে সরকারের মদদে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের মিথ্যা অভিযোগ এনে অনেক শাখা ও এটিএম বুথ ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত ফলস্বরূপ পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামী ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিকভাবে দখল নেয়। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও এমডিকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করিয়ে ব্যাংকটি দখলে নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। অবৈধভাবে দখল নেওয়ার পর এস আলম গ্রুপ ধীরে ধীরে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি ও পরিচালন কাঠামো দুর্বল করে দেয়। পেশাদার ব্যাংকারদের বাদ দিয়ে তাদের বিশ্বস্ত ও সহযোগী কর্মকর্তাদের পদায়ন করে। অযোগ্য ও অদক্ষ লোকবল ব্যাংকের শীর্ষ পদগুলোতে বসিয়ে অনিয়ম ও লুটের অভয়ারণ্য সৃষ্টি করে।
সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মদদে এস আলম গ্রুপ ও আরও কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ একে একে দেশের প্রায় সকল ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংক অবৈধভাবে দখল করে। এগুলো হলো- সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। দখলের পর এসব ব্যাংকে অপেশাদার ও অদক্ষ লোকদের পারিচালক হিসেবে ব্যাংকের বোর্ডগুলোতে বসানো হয়। ফলে এসব ব্যাংকে সুশাসন ও পরিপালন কার্যক্রম ভেঙে পড়ে।
ইসলামী ব্যাংকগুলো অলিগার্কদের হাতে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো আইনি দুর্বলতা। ২০১১ সালের বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের এক আইনে বলা হয় কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। ফলে অবৈধ টাকার মালিক ও রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ব্যবসায়ীরা শেয়ার অধিগ্রহণের মাধ্যমে রাতারাতি ব্যাংকের মালিক বনে যায়। মালিকানা লাভের পর জমিদারি স্টাইলে তারা ব্যাংকগুলোকে শুধু আমানত সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করে। সারাদেশ থেকে আমানত সংগ্রহ করে মুষ্টিমেয় কিছু ধনিক শ্রেণির হাতে সমস্ত সম্পদ তুলে দেয়। ফলে দেশে অলিগার্কদের জন্ম হয়। এরা বিনিয়োগের পরিবর্তে জনগণের টাকা লুটপাট ও বিদেশে পাচার করে।
নজিরবিহীন অনিয়ম, দুর্নীতি, দলীয়করণের ফলে ব্যাংকখাতের বর্তমান দুর্দশা। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ না দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিনিয়োগ এবং অযোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিশাল অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কারণে খেলাপি বিনিয়োগ বেড়েছে। ভুয়া বিনিয়োগ ও ট্রেডিংয়ের নামে ব্যাংকের টাকা লুটপাট ও পাচার করা হয়। দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক খাতে অনাস্থা এবং অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়। রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচনায় ব্যাংকগুলোর পরিচালক মনোনয়ন দেওয়ার ফলে ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব দেখা দিয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয়। সাধারণ মানুষ ফিরে পায় বাক-স্বাধীনতা। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকখাত অবৈধ দখল থেকে মুক্ত হয়। ইসলামী ব্যাংকসহ দখলকৃত ব্যাংকগুলোর বিতর্কিত পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন বোর্ড গঠন করা হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিপূর্ণভাবে শরিয়াহ পরিপালনের ব্যাপারে নতুন করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। জনগণের আমানত মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ও পরিবারের হাতে পুঞ্জীভূত করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো তা ঘুরিয়ে দিয়ে ইসলামী ব্যাংকখাতের বিনিয়োগ দেশের জনমানুষের কল্যাণে প্রবাহিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই খাতের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সকল ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। শরিয়াহ পরিপালন, সম্পদের সুষম বণ্টন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নসহ সর্বসাধারণের কল্যাণে ইসলামী ব্যাংকিংখাত তার পূর্ব গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করে পূর্ণদ্যোমে কাজ করার প্রত্যয়ে কাজ শুরু করেছে।
এই পরিস্থিতিতে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কার ও পুনর্গঠনে প্রয়োজনীয় কিছু পরামর্শ ও মতামত আলোচনা করা হলো :
ইসলামী ব্যাংকগুলোতে দ্রুত তারল্য সংকট নিরসন করা :
ইসলামী ব্যাংকসমূহে তীব্র তারল্য সংকট চলছে। এস আলম দখলকৃত ব্যাংকগুলোর কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকে তৈরি হয়েছে আস্থার সংকট। ফলে গ্রাহকদের আমানত তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে অভিভাবক সুলভ আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। খুব দ্রুত তারল্য সংকটের সমাধান না করলে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ওপর থেকে গ্রাহকদের আস্থা উঠে যাবে এবং ব্যাংকগুলো গভীর সংকটে পড়বে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে তারল্য সুবিধা প্রদানের জন্য শরিয়াহসম্মত পদ্ধতি উদ্বাবন করতে হবে। ইসলামী ব্যাংকসমূহের মাঝে মানিমার্কেট চালু করতে হবে। বিদেশি সংস্থা হতে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ আনতে হবে। সুসুক বন্ড ইস্যু করার মাধ্যমে অর্থের জোগান ঘটাতে হবে। বিনিয়োগের বিপরীতে নেওয়া জামানত দ্রুত নগদায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং সর্বোপরি বিনিয়োগ আদায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
অনাদায়ী বিনিয়োগ আদায়ে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা :
বর্তমান সরকার নিয়মবহির্ভূতভাবে নগদ টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সুবিধা দিতে রাজি নয়। এর জন্য অনাদায়ী বিনিয়োগ আদায়ে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ঋণখেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং সামাজিকভাবেও চাপ প্রয়োগ করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক আশ্রয়ে খেলাপিরা সহায়তা না পায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিভিন্ন মিডিয়ায় ইচ্ছাকৃত বিনিয়োগ খেলাপিদের তথ্য প্রকাশ করে সামাজিকভাবে হেয় করতে হবে।
সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা :
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত মোট ১১টি ব্যাংকের বিতর্কিত পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে স্বতন্ত্র পরিচালকদের সমন্বয়ে নতুন বোর্ড গঠন করেছে। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকই ৭টি। ইসলামী ব্যাংকগুলো যেহেতু মুদারাবা নীতির ভিত্তিতে আমানত সংগ্রহ করে সেহেতু এসব ব্যাংকের ৯০ শতাংশ সম্পদের মালিকানা ডিপোজিটরদের। সুতরাং ডিপোজিটরগণই হলেন ব্যাংকের প্রকৃত মালিক। এই বিষয়টি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়ার জন্য ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের বিদ্যমান আইনটি বাতিল করে তথাকথিত মালিক প্রথার অবসান ঘটাতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ডিপোজিটর, শেয়ারহোল্ডার এবং পেশাদার ব্যাংকারদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। ইসলামী ব্যাংগুলোর পরিচালক নিয়োগে ব্যক্তির সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ইসলামী অনুশাসন ও শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ের প্রতি কমিটমেন্টকে প্রধান্য দিতে হবে। সংস্কার কমিটি, টাস্ক কমিটি, ব্যাংকিং কমিশনে ইসলামী ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা :
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কার ও পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে একটি টাস্ক কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির অন্যতম কাজ হলো আর্থিক খাতে বিগত সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থপাচার ও লুটপাটের তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে একটি দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। পাশাপাশি, ব্যাংক খাত সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকিং টাস্ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরকার ব্যাংকিং কমিশন গঠনের চিন্তাভাবনা করছে। দেশের ব্যাংকখাতের এক-তৃতীয়াংশই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আওতাধীন এবং বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলামী ব্যাংকখাত। এ কারণে এসব কমিটিগুলোতে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ ইসলামী ব্যাংক বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধিত্ব থাকা জরুরি। এক্ষেত্রে ব্যাংকার, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও ইসলামিক স্কলারদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
ইসলামী ব্যাংক ও অর্থায়ন খাতের জন্য স্বতন্ত্র টাস্কফোর্স গঠন করা :
গ্রাহকদের আস্থা ও সাধারণ মানুষের ভালোবাসার কারণে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং খাত দ্রুত প্রসার লাভ করেছে। রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের যথাযথ সমর্থন ও সহযোগিতার অভাবে এখাত বার বার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ খাতের টেকসই উন্নয়ন ও শক্তিশালী রেগুলেটরি কাঠোমোর জন্য ব্যাংকখাত, ক্যাপিটাল মার্কেট, বিমা খাত এবং সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরদের মাঝে সমন্বয় থাকা জরুরি। এ প্রেক্ষিতে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক খাতে টেকসই উন্নয়ন ও রেগুলেটরি কাঠামো সুসংহত করতে সংশ্লিষ্ট রেগুলেটর ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।
পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করা :
দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিচালিত হচ্ছে ২০১১ সালে জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং গাইডলাইন বলে, যা এখন সেকেলে বিবেচিত হচ্ছে। ইতোপূর্বে বহুবার ইসলামী ব্যাংকিং আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত উদ্যোগগুলো আলোর মুখ দেখেনি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে খসড়া ইসলামী ব্যাংকিং আইন-২০২৪ প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু এতেও অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রচলিত ব্যাংকের অধীনে পরিচালিত উইন্ডো ও শাখাভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিং সেবা বন্ধের কথা বলা হয়েছে এ খসড়া আইনে, যা অনেকের মতে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা প্রসারের পথে প্রতিবন্ধকতা। বৈশ্বিক ইসলামী ব্যাংকিং প্র্যাকটিসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইসলামী ব্যাংকখাত শক্তিশালী আইনি কাঠামো দিতে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বতন্ত্র ইসলামী ব্যাংকিং বিভাগ চালু করা :
দেশে বর্তমানে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক, ৩০টি প্রচলিত ব্যাংক এবং ৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী অর্থায়ন সেবা প্রদান করছে। সব মিলিয়ে দেশের আর্থিক খাতের এক-তৃতীয়াংশ মার্কেট শেয়ার ইসলামী অর্থায়নের। সামগ্রিক অর্থনীতিতে এ খাতের যথেষ্ট গুরুত্ব থাকলেও যথাযথ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডেডিকেটেড কোনো বিভাগ নাই। ফলে কাঠামোগত গুরুত্বের অভাবে ইসলামী ব্যাংকখাত অনেকাংশে উপেক্ষিত ও অভিভাবকশূন্য থাকায় বিগত সরকারের আমলে এই খাতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। ইসলামী অর্থায়ন খাতের নিয়মতান্ত্রিক তদারকি ও নিবিড় তত্ত্বাবধানের জন্য পর্যাপ্ত রিসোর্স ও অভিজ্ঞ জনবলসহ একজন ডেপুটি গভর্নর বা সমমর্যাদার কর্মকর্তার অধীনে ডেডিকেটেড ইসলামী ব্যাংকিং বিভাগ চালু করতে হবে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, পাকিস্তান এবং ওমানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে স্বতন্ত্র ইসলামী ব্যাংকিং বিভাগ রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক খাতের জন্য উপযুক্ত মানবসম্পদ তৈরি করা :
ইসলামী ব্যাংক খাতে বর্তমানে ৫০ হাজারের বেশি জনবল কাজ করছে। এ খাতের জন্য মানবসম্পদের চাহিদা বেড়েই চলছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো যেহেতু মানুষের ধর্মীয় চাহিদার আলোকে শরিয়াহভিত্তিক অর্থায়ন সেবা দিয়ে থাকে, সেহেতু এখাতের জন্য ইসলামী ব্যাংকিং ও শরিয়াহ জানা জনবলের প্রয়োজন। অথচ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখাতের জন্য উপযুক্ত মানবসম্পদের যোগান দিতে পারছে না। ফলে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে শরিয়াহ লঙ্ঘনসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক কারিকুলামসহ দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স বিষয় চালু করতে হবে। ইসলামী ব্যাংকগুলোতে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স বিষয়ের গ্র্যাজুটেদের অগ্রাধিকার দেওয়া হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বাধ্য হয়েই এ সংক্রান্ত কোর্স চালু করবে। এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার ইনসিয়েফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে এবং আওফি, আইএফএসবি, ইসরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সার্টিফিকেশন কোর্সগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। ইসলামী ব্যাংকিং লিটারেসি উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি), সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামীক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ (সিএসবিআইবি), ইসলামিক ব্যাংকস কনসালটেটিভ ফোরাম (আইবিসিএফ) এবং বাংলাদেশ আওফি ফেলোস ফোরাম (বাফ) সহ বিভিন্ন সংগঠন যৌথভাবে কাজ করতে পারে।
ইসলামী ব্যাংক ও অর্থায়ন খাতের প্রতি জনগণের সম্পৃক্ততা ও আস্থা বৃদ্ধি করা :
ইসলামী ব্যাংকগুলোর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র মুনাফা অর্জন নয়। বরং এর উদ্দেশ্য হলো আর্থিক খাতে কল্যাণ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার মাধ্যমে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো। ইসলামী ব্যাংক ও অর্থায়ন খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ও আস্থা বৃদ্ধির জন্য সকল পক্ষকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা ও দায়িত্ব অনেক বেশি। ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন, মন্তব্য ও সমালোচনা করার ক্ষেত্রে অনেক সচেতন থাকতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে এ খাত নিয়ে গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রকৃতপক্ষে কোনো অনিয়মের ঘটনা ঘটলে যথাযথ তথ্যপ্রমাণসহ তা তুলে ধরতে হবে। সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত করার জন্য বিএবি, আইবিসিএফ, সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নলেজ-শেয়ারিং ও ডায়ালগ প্রোগ্রাম আয়োজন করতে হবে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্ভাবনাময় অর্থনীতির একটি দেশ। এ দেশের মানুষ ও অর্থনীতি ভুল নেতৃত্বের দ্বারা বারবার প্রতারিত হয়েছে। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেড়িয়ে গেলেও এ জাতি এখনো নিজ পায়ের ওপর শক্তভাবে দাঁড়াতে পারেনি। অর্থনীতির ভিত এখনো নাজুক। অথচ ৯২ ভাগ মুসলমানের এই দেশটিতে ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থায়ন খাত প্রসারের অপরিমেয় সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। এখন সময় এসেছে এ খাতে মনোযোগ দেওয়ার। ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় জরুরি। অনৈক্য ও বিবেধ ভুলে একযোগে কাজ করতে হবে। যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব, লাগসই আইনি কাঠামো এবং এ খাতসংশ্লিষ্টদের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের ফলে ইসলামী ব্যাংক ও অর্থায়ন খাত এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানুষের প্রয়োজন ও আশা আকাঙক্ষা পূরণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করুক এমনটিই প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের।
লেখক : মোঃ খায়রুল হাসান, সিএসএএ, ইসলামী ব্যাংকার ও শরিয়াহ অ্যাডভাইজর।
মন্তব্য করুন