রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু এবং বাণিজ্য সহযোগী হিসেবে- চীনই পুতিনকে ইউক্রেনে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করাতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত, শি জিনপিং সে ক্ষমতা ব্যবহার করতে অস্বীকার করেছেন এবং বেশিরভাগ সময়েই তার উলটো কাজ করেছেন। এতে বেইজিংয়ের ভণ্ডামিই প্রকাশ পেয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে চীনা নীতিবিষয়ক ১২ খণ্ড বিশিষ্ট একটি বিবৃতি প্রকাশ হয়। সেখানে প্রথমেই যুদ্ধে মীমাংসার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সনদকে সাধুবাদ জানিয়ে সব দেশের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা ‘কার্যকরভাবে বহাল রাখা প্রয়োজন’ বলা হয়। তবে ইউক্রেনে মস্কোর চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক যুদ্ধের নিন্দা করার পরিবর্তে দেশটির সঙ্গে ‘সীমাহীন’ বন্ধুত্বের ঘোষণা দেন শি জিনপিং। বলা বাহুল্য, রাশিয়াকে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং সামরিক সমর্থন জুগিয়ে এর আগ্রাসন অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে যাচ্ছেন তিনি।
মার্চে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে শি পুতিনের সঙ্গে করেন। ক্ষমতায় আসার পর এক দশকে তাদের কয়েক ডজন বৈঠক হয়েছে। এদিকে, ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরুর ১৪ মাস পর তিনি জেলেনস্কিকে ফোন করেছিলেন।
এটা লক্ষ্যণীয় বিষয়, চীনও জেলেনস্কির অনুরোধে ইউক্রেনে যুদ্ধ অবসানের তাগিদে আলোচনায় বসা ৪০-এর বেশি দেশের ভেতরে রয়েছে। রাশিয়াবিহীন এই আলোচনাটি সৌদি আরবের বন্দর নগরী জেদ্দায় অনুষ্ঠিত হয়। অস্ত্র এবং জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল নিরপেক্ষ বা কিছুটা মস্কোর দিকে ঝুঁকে থাকা দেশগুলোর শীর্ষ জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা। এ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্রাজিল, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, মেক্সিকো ও তুরস্ক। দুইদিনব্যাপী বৈঠকে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। ইউক্রেনীয় প্রতিনিধি এবং জেলেনস্কির শীর্ষ সহযোগী আন্দ্রে ইয়ারমাক চীনা প্রতিপক্ষের সঙ্গে মুখোমুখি বসতে পেরেছিলেন কি না তাও স্পষ্ট নয়। উপস্থিত অনেকে জানিয়েছেন চীন একটি ফলোআপ সেশনে বসার ব্যপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
চীনের নীতিনির্ধারণ পলিসি অস্বচ্ছ হলেও ইউক্রেন যুদ্ধে তারা কী চায় তা স্পষ্ট এবং স্ববিরোধী। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব এ বিশ্বাসের ওপর গড়ে উঠেছে যে মস্কো মার্কিন আধিপত্যের বিস্তাররোধে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবু চীনা নেতারা চান না মস্কোর এ আগ্রাসনকে বাহবা দেওয়ার সময় তাদের কেউ দেখে ফেলুক কারণ ইউরোপে তাদের বাণিজ্যের জন্য সেটা ক্ষতিকর।
চীন তেল আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে রাশিয়ার রক্তশূন্য যুদ্ধকালীন অর্থনীতিকে পুষ্টি জুগিয়ে চলেছে। বেইজিং সরকারিভাবে অস্বীকার করলেও চীনা প্রতিষ্ঠানের উৎপন্ন করা বডি আর্মার, ড্রোন এবং নাইট ভিশন সরঞ্জাম পথ খুঁজে নিয়েছে রাশিয়ার।
ইউক্রেন যুদ্ধে বেইজিংয়ের নেওয়া অবস্থানের সমস্যা হলো- তারা যতটুকু বলে তার চেয়ে অনেক বেশি করে। চীনা ও রাশিয়ান বাহিনীর যৌথ মহড়া অব্যাহত রয়েছে। গত সপ্তাহে দুই দেশের এক ডজন যুদ্ধজাহাজ আলাস্কার আলেউশিয়ান আইল্যান্ডের দিকে রওনা হয়েছে। এ ঘটনা পর্যবেক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী চারটি যুদ্ধজাহাজ এবং সামরিক বিমান মোতায়েন করেছে।
উল্টো পুতিনের আক্রমণের সমালোচনায় ব্যর্থ চীন ‘সকল দেশের নিরাপত্তা স্বার্থ ও উদ্বেগকে’ মাথায় রেখে রাশিয়ার ‘বলির পাঠা’ হওয়ার কথা প্রচার করে চলেছে। অথচ সত্যটা হলো পুতিনই সে আগ্রাসী ব্যক্তি যিনি অনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছেন।
চীন যদি শান্তি প্রতিষ্ঠায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চায় তাহলে ইউক্রেনের ডাকে ফলো-আপ সভায় যোগদানের চেয়ে বেশি কিছু করতে হবে। চীনকে এই সত্য বিবৃতি দিয়ে প্রচার করতে হবে যে- রাশিয়া এক দশকের বেশি সময় ধরে অবৈধভাবে ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখল করে আছে। ১৮ মাস আগে শুরু হওয়া আগ্রাসনে ইউক্রেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা অরক্ষিত হয়েছে এবং কিয়েভের সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিশ্ববাসী চীনের এমন মহড়া দেখতেই থাকবে, যেখানে তারা অস্পষ্ট ধূম্রজালে অনৈতিক যুদ্ধের অবতারণাকে প্ররোচনা দিয়ে যাবে।
মূল লেখা : ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদকীয় থেকে।
ভাষান্তর : সরকার জারিফ
মন্তব্য করুন