হিংসা আর দাম্ভিকতায় ঘেরা পলেস্তারা খসে খাড়া দেয়াল, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে উঠেছে ঘূর্ণিঝড়; অহংকারির চোখ করেনি খেয়াল।
হ্যাঁ, বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবে পতিত স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট শেষ ‘পঁয়তাল্লিশ মিনিট’ আগেও বুঝতে পারেনি যে অতি শীঘ্রই তাদের পতন হতে চলছে। তাদের ক্ষমতার অহংকার এবং দাম্ভিকতায় তারা ছিল প্রচণ্ডভাবে বেখেয়াল। নিরাপত্তার চাদর ফুটো হয়ে গেছে-এই বোধ তাদের জাগেনি। তাদেরকে ঘিরে রাখা নিরাপত্তা প্রাচীরের পলেস্তারা খসে পড়ছে। দুনিয়ার সব ফ্যাসিস্টদের মানসিক বৈশিষ্ট্য একই রকম: তারা বন্দুকের নলকে তাদের টিকে থাকার সর্বোত্তম অবলম্বন মনে করে। জনতার শক্তি এবং বিদ্রোহের আঁচ তাদের বোধের সীমায় আসে না।
পৃথিবীর তাবৎ মহাবিদ্রোহ, ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে শিল্প-সাহিত্যের শোণিতধারা এগিয়ে নিয়েছে বহুদূর। ঊষর মরুতে ক্লান্ত বিদ্রোহীদের প্রশান্তময় নিমের ছায়ার মতো কাজ করে সাহিত্য। যোদ্ধাদের ক্লান্তদেহ শীতল জলের ছিটায় সতেজ করে তোলে কবিতা গান, তথা শিল্প সাহিত্য। আন্দোলন-প্রেক্ষিতে রচিত কবিতার শব্দমালা এবং প্রতিবাদী বিপ্লবী সুর ক্লাস্টার বোমার মতো ছিন্ন ভিন্ন করে শত্রুর কলিজা; ধ্বসিয়ে দেয় তাদের কুচিন্তার জগৎ।
২০২৪ ইংরেজি, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন। রক্তের সাথে কবিতা, ঘামের সাথে সংগীত একাকার হয়ে সমগ্র বাংলাদেশ যেন মহাসমুদ্রে টর্নেডোর হানা। ফ্যাসিজমের প্রেতাত্মার পতন না হওয়া পর্যন্ত থামবে না মহাসমুদ্রের উত্তাল সেই ঢেউ।
জুলাই বিপ্লাবে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের অপকর্মের বিচরণ ভূমি বানিয়ে ফেলেছিল। সমস্ত ভয়কে জয় করে, আঁধার নিমজ্জিত মাঝরাতে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে হাজার মানিক জ্বলে ওঠে দীপ্ত শ্লোগানে-
“তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!”
সন্ত্রাস এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একটি আয়রনিক স্লোগান যে মহাবিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এটি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ভয়ের কালো খোলস টুকরো টুকরো করে বেরিয়ে আসে দুর্বার পদাতিকেরা। এই স্লোগান হয়ে ওঠে আরও মহাকাব্যিক। “কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!”
মহাবিদ্রোহী কবিদের এই চারটি চরণের কাছে ভোঁতা হতে থাকে পতিত সরকারের সব অপকর্মের কৌশল।
আজন্ম বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম, যার সাহিত্য রণডঙ্কা ব্রিটিশ সাম্রাজবাদিদের ভীত নড়বড়ে করে দিয়েছিল। নিষিদ্ধ হয়েছে তাঁর পাঁচটি গ্রন্থ, যেতে হয়েছে দ্রোহের অভিযোগে জেলে। জেল খেটেছেন নয় মাস। অশান্ত নজরুল করেছেন অনশন। লিখেছেন ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’। দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে সাম্রাজ্যবাদিদের সিংহাসন নড়বড়ে করে শান্ত হয়ে গেলেন রণ সঙ্গীতের এই বুলবুলি। হয়ে গেলেন আমৃত্যু নির্বাক। ২০২৪ ইং, জুলাই মাস: বিষের বাঁশি হাতে জেগে উঠলেন নজরুল। প্রকম্পিত বাংলার রাজধানী ঢাকা; আন্দোলতের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তাঁর বিদ্রোহী তোলে আবার নতুন ঝংকার-
“মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেদিন হব শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণভীম রণভূমে রণিবেনা।”
নির্বাক নজরুল সবাক হয়ে উঠলেন। বাতাসে উঠছে তাঁর ঢেউভাঙা চুল। শহীদ মিনারের পাদদেশ, রাজু ভাস্কর্য, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ি, উত্তরা, রংপুর, চট্টগ্রামের নিউমার্কেট চত্বর,কুমিল্লা, সিলেট, বরিশাল, খুলনাসহ পুরো দেশে বিদ্রোহীদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন কবিতার পর কবিতা। মুক্তির নেশায় মাথায় পতাকা বেঁধে বিপ্লবীদের কণ্ঠে বাজিয়ে দিলেন-
“কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট ... ... ... লাথি মার ভাঙরে তালা যতসব বন্দিশালা আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি”
কী আশ্চর্য! দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও উঠে এলেন তাঁর অমর কবিতায় সুরের সুবাস ছড়াতে ছড়াতে-
“ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদেরই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ছড়িয়ে পড়া সুরের মূর্ছনা স্পর্শ করে ফ্যাসিস্ট মুক্তি আন্দোলনে নিমগ্ন প্রতিটি মানুষকে। সকল ধর্ম-মত-আদর্শ একাকার হয়ে পুরো বাংলা ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় একটি স্লোগান: ‘ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চাই, স্বৈরাচার মুক্ত বাংলাদেশ চাই’। কী ভয়াবহ আন্দোলন: রক্তের সাথে মিশেছে রক্ত! শিশুর রক্ত, যুবকের রক্ত, ছাত্রের রক্ত, ছাত্রীর রক্ত, মুসলিমের রক্ত, হিন্দুর রক্ত, রিক্সাওয়াল রক্ত, পথচারীর রক্ত, অভিজাতবাসীর রক্ত, বস্তিবাসীর রক্ত। রক্তত্যাগের কী এক অভিন্নতা!! ঈগলের মতো দুহাত ছড়িয়ে, স্ফিতোবুকে, শ্যেনদৃষ্টির শিরদাঁড়া রংপুরের আবু সাঈদের রক্ত বিপ্লবীদের রক্তে আগুন লাগিয়ে দেয়। চব্বিশের এই মহাবিদ্রোহের মহাকাব্যের মহানায়ক শহিদ আবু সাঈদ। হ্যামিলনের এই বাঁশিওয়ালার রক্ত-বাঁশির সুরের প্রতিধ্বনিতে উদ্দীপ্ত ওঠে দ্বিতীয় বিজয়ের স্বাদ গ্রহণে উদগ্রীব প্রতিটি বাংলাদেশি। ‘যুবকদের রক্তে আগুন লাগিয়ে দাও’-আল্লামা ইকবালের আগুনলাগা কবিতার ছত্রে উদ্দীপ্ত বিদ্রোহীরা। কী দেশ, প্রবাস: অভিন্নস্বরে, অভিন্ন শ্লোগানে, অভিন্ন দাবী-‘বিদায় হও স্বৈরাচার’।
গীতিকার ইথুন বাবু ফ্যাসিবাদীদের রক্তচোখ উপেক্ষা করে মৌসুমী চৌধুরীর গলায় তুলে দিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠহার
“দেশটা তোমার বাপের নাকি করছো চলাকলা কিছু বললে ধরছো চেপে সব জনগণের গলা।”
গানটি ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-ঘৃণা-ধিক্কারের এক অনন্ত উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। নব রূপে রূপায়িত এইসব শিল্প-সাহিত্য উদ্বুদ্ধ প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এরই মধ্যে ভেসে আরেক সৌম্য সুর-
“মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান লেখা আছে অশ্রুজলে...”
মোহিনী চৌধুরী যেন ছাত্রদের জনতার অশেষ মিছিলের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে লিখে চললেন উদ্দীপনামূলক এই গান। কৃষ্ণচন্দ্র দে কে বললেন, ‘যাও, মুক্তি সংগ্রামীদের মিছিলে গাও।’ সত্যিই আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে এই গান ছাত্রদের ত্যাগের মহৎ ইচ্ছাকে শতধারায় উৎসাহিত করে তোলে।
বিপ্লবোত্তর দেশব্যাপী গ্রাফিতিতে প্রকাশ পেয়েছে আন্দোলনের সচিত্র প্রতিবেদন। তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোগানে দেশের নানা রকমের অসংগতি তুলে ধরেছে নবস্বপ্নের শিল্পীরা। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ফুটে উঠেছে গ্রাফিতিগুলোতে। এসব গ্রাফিতি দেখে উজ্জীবিত হয়ে পথচারীরা। তারা আগ্রহ নিয়ে দেখে, পড়ে, হাসে। অতি অল্প অথচ তাৎপর্যপূর্ণ কথা ও ছবির মাধ্যমে তরুণরা তুলে ধরছে বিশাল স্বপ্ন। দু-চারটি শব্দে হিমালয়সম সুদৃঢ বক্তব্য তুলে ধরার এই কাব্য-প্রতিভা ছাত্ররা কোথায় পেলো? প্রতিভাধারী এইসব কবিরা এতদিন কোথায় ছিলো? সত্যি কী, দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরাচারী সরকার এই প্রতিভাগুলো পাথরচাপা দিয়ে রেখেছিল। সময়ের প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে বর্ণ-বৈচিত্রে ভরা এইসব প্রতিভা আজ বিকশিত হয়েছে। দেশ ও জাতিকে নিয়ে তাদের সুন্দর প্রত্যাশা প্রাণবন্ত গ্রাফিতি শিল্পের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। একটা গ্রাফিতি দেখলাম, “চিরকাল বসন্তের বাহিরেও কিছু ফুল ফোটে।” কবি হাসান রুবায়াত লিখে থুইছিলেন কোথাও, কিন্তু তরুণরা তা তুলে ধরলেন যা জুলাই বিপ্লবের মহাকাব্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো। দুটো, তিনটে শব্দের গ্রাফিতি তাৎপর্যময় এক দারুণ এক্সপ্রেশন! বাংলা সাহিত্যের প্রয়াত মহান কবিরা যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে এসব কঠিন অর্থবহ শব্দমালা তাঁদের গ্রন্থাদির নিশ্চিত নামকরণ করতেন।
সম্প্রতি হয়ে যাওয়া জাতিসংঘের অধিবেশনে স্বাপ্নিক প্রাণপুরুষ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস গ্রাফিতি আঁকা আর্টবুক জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের হাতে তুলে দেন। এসব আর্টবুকের মাধ্যমে জুলাই বিপ্লব সচিত্র প্রতিবেদন হয়ে দেশ হতে দেশে পৌঁছে যায়।
প্রয়াত, বর্তমান এবং সময়ের প্রয়োজনে আবির্ভূত হওয়া অনেক কবির কবিতা, শিল্পীর গান জুলাই বিপ্লবকে সফল করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বিপ্লবীদের শিরায় শিরায় উষ্ণ রক্তের ফোয়ার সৃষ্টি করেছিল এসব শিল্প-সাহিত্য। বিপ্লবীদের সাথে স্মরণীয় হয়ে থাক সৃষ্টিশীল এই মানুষগুলো।
আবু জাফর সাঈদ: অ্যাডজান্ট শিক্ষক, আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম
মন্তব্য করুন