স্টিফেন ব্ল্যাঙ্ক
প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ০৫:৩৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
সক্রিয় ওয়াগনার

নাইজারে অভ্যুত্থান এবং আফ্রিকায় পুতিনের খেলা

অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নাইজারের ক্ষমতা দখল করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। ছবি : সৌজন্য
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নাইজারের ক্ষমতা দখল করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। ছবি : সৌজন্য

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজারের সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থান শুধু আফ্রিকা নয়, বরং এটি বিশ্ব রাজনীতির বেশকিছু বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে।

গত ২৬ জুলাই নাইজারের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ বাজুমকে ক্ষমতাচ্যুত করে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড বাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দুর রাহমান চিয়ানি গত শুক্রবার নিজেকে নাইজারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ঘোষণা করেন।

এই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশের মতো নাইজারও ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ যেখানে এখনো ফ্রান্স তার আর্থিক এবং সামরিক প্রভাব ধরে রেখেছে এবং নাইজারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ জারি রেখেছে। ফলে নাইজারের এই সেনা অভ্যুত্থানে মানুষ সমর্থন জানাচ্ছে এবং কিছু বিক্ষোভকারী দেশ থেকে ফ্রান্সকে হটিয়ে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের দাবি জানিয়ে আসছে।

নাইজারে এই সেনা অভ্যুত্থানের ফলে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনকে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক রূপান্তরের সূচনা হিসেবে দেখা যায়। এটি গ্লোবাল সাউথের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে সামনে নিয়ে এসেছে। গত সপ্তাহে সেন্ট পিটার্সবার্গে দ্বিতীয় রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে পুতিনের সাম্প্রতিক সমাবর্তন এবং এর পরই নাইজারের সেনা অভ্যুত্থান আফ্রিকায় রাশিয়াকে খেলোয়াড়ের আসনে বসিয়েছে। এই অভ্যুত্থান একই সাথে পুরো আফ্রিকাজুড়ে রাশিয়ার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা, এমনকি তার আক্রমণাত্মক কৌশল, সেইসাথে সেখানে শাসন ও রাষ্ট্র-নির্মাণে রাশিয়ার গভীর প্রভাবকে তুলে ধরে। এটি এও প্রকাশ করে যে, মহাদেশজুড়ে ক্ষমতা প্রতিযোগিতায় রাশিয়া একটি অপ্রতিরোধ্য চ্যালেঞ্জ।

এই অভ্যুত্থানের প্রকৃত কারণ যাই হোক না কেন, অভ্যুত্থানের নেতারা বলছেন- দেশে ইসলামী সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে এবং সরকার দেশের ‘দরিদ্র অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা’ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই তারা সরকারকে হটিয়ে দেশের ক্ষমতা সেনাবাহিনীর কাছে নিয়েছেন।

নাইজারে অভ্যুত্থান ঘটানো সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা প্রকাশ্যভাবেই রাশিয়ার সাথে যুক্ত। রাশিয়া তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে এবং রাশিয়ার ওয়াগনার বাহিনী তাদের সহযোগিতা করছে। ভ্লাদিমির পুতিন নাইজারকে সরাসরি ভর্তুকি দিচ্ছেন। নাইজার, সুদান, বুরকিনা ফাসো এবং মালিতে ঘটা অভ্যুত্থানগুলো আশ্চর্যজনকভাবে একটি অন্যটির সাথে একটি সাদৃশ্য বহন করছে।

সুদানে এবং এখন দৃশ্যত নাইজারে অভ্যুত্থানকারীরা মূলত গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। কারণ তারা আশঙ্কা করেছিল, গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব স্থানীয় সামরিক বাহিনীর ওপর তাদের ক্ষমতাকে ব্যাহত করবে। প্রকৃতপক্ষে, গণতান্ত্রিক সরকার সন্ত্রাসবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছুটা সাফল্য পেয়েছিল যা অভ্যুত্থান ঘটানো নেতাদের অভিযোগকে দুর্বল করে দেয়।

সুতরাং গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে সরিয়ে সামরিক নেতৃত্ব নিয়ে আসার মধ্যে রাশিয়া এবং আফ্রিকান ক্লায়েন্টরা পারস্পরিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক লাভ দেখছে। নাইজারের বিক্ষোভকারীরা রাশিয়ানপন্থি এবং পশ্চিমাবিরোধী, বিশেষ করে তাদের ফরাসিবিরোধী স্লোগান দিতে দেখা যাচ্ছে। সুতরাং এই সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে রাশিয়ার হাত স্পষ্ট বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ওয়াশিংটনের আফ্রিকা সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক জোসেফ সিগেল বলেছেন, বুরকিনা ফাসোতে অভ্যুত্থানের পর ‘‘ওয়াগনারের সাথে যুক্ত টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টগুলো স্পষ্টভাবেই বলছে- ‘নাইজার আমাদের পরবর্তী টার্গেট,’’। জোসেফ সিগেল তার পর্যবেক্ষণে আরও দেখিয়েছেন, রাশিয়া পশ্চিম আফ্রিকায় একটি সামরিক টেকওভার দেখতে আগ্রহী যা এই অঞ্চলে তাদের প্রভাবকে আরও বৃদ্ধি করবে।

এই বিশ্লেষণটি যদি সঠিক হয়, তবে নাইজারের অভ্যুত্থানটি কিছুটা হলেও রাশিয়ার গোয়েন্দা এবং ওয়াগনার বাহিনী দ্বারা প্ররোচিত। রাশিয়া বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য মাথায় রেখে এই অভ্যুত্থানে সহায়তা করেছে।

রাশিয়ার একটি লক্ষ্য হলো- গণতান্ত্রিক কিন্তু বিপর্যস্ত আফ্রিকান সরকারগুলোকে উৎখাত করে সেখানে রাশিয়ান প্রক্সি সরকার বসানো। যাতে জেনারেলরা রাশিয়ান অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে মস্কোর সাথে সংযুক্ত থাকে এবং পশ্চিমা প্রভাবকে হ্রাস করে সেখানে রাশিয়ন কর্তৃত্ববাদী শাসনকে লালন করে। মস্কো স্পষ্টভাবেই আফ্রিকার আঞ্চলিক, উপজাতীয়, জাতিগত, ধর্মীয় বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বকে তার উদ্দেশসাধনে কাজে লাগাবে।

আফ্রিকান দেশগুলোতে ঢুকে রাশিয়া শুধু খনি থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন এবং অন্যান্য চুক্তি করেই থেমে থাকেনি বরং ওয়াগনার গ্রুপের মাধ্যমে সেসব দেশে একটি বিকল্প সরকার ব্যবস্থাও তৈরি করে। যাতে প্রয়োজনে যে কোনো মুহূর্তে সেই দেশের সরকারকে সহজেই প্রতিস্থাপন করতে পারে। অথবা চাপ প্রয়োগ করে প্রয়োজনীয় চুক্তি বা সুবিধা আদায় করতে পারে।

এটি তখন প্রতিবেশী দেশগুলোতেও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং স্থায়ী সামরিক অবস্থান বা নৌ/বিমান ঘাঁটি গড়তে সেই দেশকে চাপ দিতে পারে। যা সেসব দেশে স্থায়ীভাবে রাশিয়ান সামরিক অবস্থানের ইচ্ছার চূড়ান্ত প্রকাশ।

সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান আফ্রিকার দেশগুলোতে রাশিয়ার শক্তি, কৌশল এবং লক্ষ্যগুলোকে স্পষ্ট করে। এখান থেকেই স্পষ্ট হয়, কেন ভ্লাদিমির পুতিন জুনের বিদ্রোহের পরও ওয়াগনার বাহিনীকে এখনো টিকিয়ে রেখেছেন।

মূল - স্টিফেন ব্ল্যাঙ্ক (STEPHEN BLANK),

দ্য হিল (THE HILL) থেকে ভাষান্তর – মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অতিরিক্ত ওজন কমাবে শীতের যেসব সবজি

জুরাইন রণক্ষেত্র, অবরোধকারীদের কয়েকজন আটক

রাশিয়া শান্তি চায় না, এবার জবাব দিতে হবে : বিশ্বকে জেলেনস্কি

মাছ ধরার নৌকায় ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবমেরিনের ধাক্কা

বেঁচে ফিরব আশা ক‌রিনি

পানের বরজে গাঁজা গাছ

ব্যাংককে রাফসান-জেফার, উড়ো প্রেমের গুঞ্জন (ভিডিও)

জনবল নিয়োগ নিচ্ছে নিটল মটরস, কর্মস্থল ঢাকায়

পাত্র খুঁজছেন পাকিস্তানি অভিনেত্রী মেহউইশ হায়াত (ভিডিও)

ঢাকায় পৌঁছেছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি

১০

৪২ টাকায় কেনা কলার চিত্রকর্ম ৭২ কোটিতে বিক্রি

১১

এবার অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নারী বেছে নিলেন ট্রাম্প

১২

ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় গন্তব্যে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা পার

১৩

বিচ্ছেদের পর এই প্রথম এআর রাহমানের পোস্ট

১৪

লঘুচাপের শঙ্কা, এরপরই জেঁকে বসবে শীত

১৫

রংপুর জিলা স্কুল মাঠ নয়, মাহিগঞ্জ কলেজে হচ্ছে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মহাসমাবেশ

১৬

ঢাকা লিগে নিষিদ্ধ ৮ ক্রিকেটারসহ ৯ জন

১৭

মালয়েশিয়ায় সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপন

১৮

জীবননগরে সাবেক পৌর মেয়র গ্রেপ্তার

১৯

অ্যান্টিগায় মাঠে নামলেই রেকর্ড করবেন মিরাজ

২০
X