রহমান মৃধা
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৩৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

রাষ্ট্র সংস্কারের নীতিমালা : বাংলাদেশে করণীয় ও বর্জনীয়

গণভবনে সাধারণ মানুষ। ছবি : এএফপি
গণভবনে সাধারণ মানুষ। ছবি : এএফপি

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকর নীতিমালা অত্যন্ত জরুরি। এই নীতিমালা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক খাতগুলোর উন্নয়নে দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সাধারণ মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে আমূল পরিবর্তন দরকার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কাজটি সুপরিকল্পিতভাবে করবে বলে আমরা আশাবাদী।

১. রাষ্ট্র সংস্কার : সংজ্ঞা এবং ধারণা

রাষ্ট্র সংস্কার হলো সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি দেশের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে আধুনিকায়ন ও উন্নত করা হয়। এর লক্ষ্য হলো স্থিতিশীলতা, সুশাসন, এবং জনগণের জন্য কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠন করা। উন্নততর নীতি ও সিস্টেমের মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ, উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।

২. কেন রাষ্ট্র সংস্কার প্রয়োজন

২.১ রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলা বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিয়ম এবং দলীয় সহিংসতা রোধ করার জন্য একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। জনগণের অধিকার সুরক্ষা এবং স্থিতিশীল রাজনীতি নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

২.২ দুর্নীতি হ্রাস প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং স্বচ্ছতার অভাব বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া চালু করা জরুরি।

২.৩ জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা কমে গেছে। রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব, যেখানে সরকার ও প্রশাসন জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকবে।

৩. কার জন্য সংস্কার

রাষ্ট্র সংস্কার কেবল রাজনৈতিক নেতাদের জন্য নয়, এটি সকল স্তরের মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য।

৩.১ সার্বজনীন কল্যাণ- প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে।

৩.২ অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা রাষ্ট্র সংস্কারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে।

৪. কে করবে সংস্কার

৪.১ সরকার সরকারের নীতিনির্ধারণী স্তরের সদস্যরা রাষ্ট্র সংস্কারের নেতৃত্ব দেবেন। নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের উপরই ন্যস্ত থাকবে।

৪.২ বিশেষজ্ঞ টিম প্রশাসন, অর্থনীতি, শিক্ষা ও আইন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি স্বতন্ত্র টিম (টাস্কফোর্স) গঠন করতে হবে, যারা রাষ্ট্রের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করবে এবং সেগুলোর কার্যকর সমাধানের প্রস্তাব দেবে।

৫. কীভাবে টিম গঠন করতে হবে

৫.১ বিশেষজ্ঞদের নির্বাচন প্রশাসন, অর্থনীতি, শিক্ষা, আইনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে টিম গঠন করা জরুরি। টিমের সদস্যদের নির্বাচন হবে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।

৫.২ অংশীদারত্ব টিম গঠনের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করতে হবে। এর মাধ্যমে জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে, যা সংস্কারকে কার্যকর করতে সহায়ক হবে।

৬. কতদিন লাগবে

৬.১ অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ রাষ্ট্র সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো দ্রুত কার্যকর করতে হবে। প্রশাসনিক অস্থিরতা দূর করতে এবং ত্বরান্বিত উন্নয়নের জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।

৬.২ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা পুরো সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে ৩ থেকে ৫ বছর সময় লাগতে পারে। এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রেখে তৈরি করতে হবে।

৭. সংস্কারের ফলোআপ :

৭.১ নিয়মিত মূল্যায়ন প্রতি মাসে বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সংস্কারের অগ্রগতি মূল্যায়ন করতে হবে। এর জন্য একটি স্থায়ী কমিটি থাকতে হবে, যারা সংস্কারের প্রতিটি পদক্ষেপ মূল্যায়ন করে নতুন সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করবে।

৭.২ জনগণের মতামত সংস্কারের প্রতিটি স্তরে জনগণের মতামত গ্রহণ জরুরি। এই মতামত সংস্কার প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে।

৮. যোগ্য ব্যক্তিদের উপযুক্ত পদে নিয়োগ ৮.১ যোগ্যতা নির্ধারণ প্রশাসনিক পদগুলোতে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে, যাতে তারা প্রশাসনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেন। দলীয় ভিত্তিতে নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান অপরিহার্য।

৮.২ বৈশ্বিক মানদণ্ড আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে বাংলাদেশ একটি বৈশ্বিক মানসম্পন্ন প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারে।

বর্তমান চ্যালেঞ্জ :

১. সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের অভাব অনেক সাধারণ মানুষ মনে করেন, তারা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।

২. স্বৈরশাসনের উসকানি রাষ্ট্র সংস্কারের পথে স্বৈরাচারী রাজনৈতিক চাপ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত সংস্কারের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে।

৩. অন্তর্বর্তী সরকার অন্তবর্তী সরকারের টিম যথাযথভাবে গঠিত না হলে সংস্কার প্রক্রিয়া ব্যর্থ হতে পারে। তাই সরকারের দক্ষ ও কার্যকর নেতৃত্ব দরকার।

৪. খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি বর্তমানে খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ জনগণের জীবনে চরম অসুবিধার সৃষ্টি করছে। বাজার স্থিতিশীল না হলে সংস্কার প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দেবে।

৫. প্রশাসনিক আতঙ্ক প্রশাসনে আতঙ্ক সৃষ্টি হলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হতে পারে। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে প্রশাসনে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও দক্ষ নেতৃত্ব প্রয়োজন।

শৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা

শৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে তাদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা প্রয়োজন, যেন এর মাধ্যমে জনস্বার্থ বা সংস্কার প্রক্রিয়ার ক্ষতি না হয়। জনগণের নিরাপত্তা এবং সামাজিক শান্তি নিশ্চিত করা হবে সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য।

রাষ্ট্র সংস্কারের পদ্ধতি

১. অংশীদারত্বমূলক প্রক্রিয়া রাষ্ট্র সংস্কার একটি অংশীদারিত্বমূলক প্রক্রিয়া হতে হবে, যেখানে বিভিন্ন স্তরের জনগণ, বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসন একত্রে কাজ করবে।

২. টাস্কফোর্স গঠন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি স্বতন্ত্র টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে, যারা সংস্কারের পরিকল্পনা তৈরি করবে এবং তার বাস্তবায়নের পথ সুগম করবে।

৩. সচেতনতা বৃদ্ধি রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে।

আন্তর্জাতিক উদাহরণ

দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৪ সালে বর্ণবৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের সফল উদাহরণ স্থাপন করেছে। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশটিতে সমান ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়, যা দেশের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে।

রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নত ও সুশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব। তবে এজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষ নেতৃত্ব, জনগণের অংশগ্রহণ, এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্র সংস্কার একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ, যা দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেবে।

রহমান মৃধা : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হত্যা মামলায় তাঁতী লীগ নেতা গ্রেপ্তার

গাজা যোদ্ধাদের নতুন প্রধানের মৃত্যুর শেষ মুহূর্তের ভিডিও প্রকাশ্যে

দেশে ৫৩ বছর ধরে দুঃশাসন চলছে : জোনায়েদ সাকি

তারেক রহমানের সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে :  লেবার পার্টি

শিক্ষা কমিশন গঠনের দাবি সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর

৫ কোটি রুপি না দিলে হত্যা করা হবে সালমানকে 

সাকিবের বদলে কাকে দলে নিল টাইগাররা?

ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে বিএনপি নেতাকে হেয় করার অভিযোগ

দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আহমাদুল্লাহর স্ট্যাটাস

সাকিবের বাংলা টাইগার্সে তাওহীদ হৃদয়

১০

শেখ হাসিনা দেশের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করছেন : জাহাঙ্গীর 

১১

বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্যে ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ : জাতিসংঘ

১২

নন্দন পার্কের পরিচালকসহ ১২ আসামিকে আদালতে প্রেরণ

১৩

‘আ.লীগ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়েছিল’

১৪

‘আ.লীগ আমলের চোর-বাটপারদের শাস্তি দিলে দ্রব্যমূল্য বাড়ত না’

১৫

রাষ্ট্র সংস্কারের নীতিমালা : বাংলাদেশে করণীয় ও বর্জনীয়

১৬

শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচারের দাবি ফারুকের

১৭

সিজেএফবি’র সভাপতি এনাম সরকার, সম্পাদক রানা 

১৮

ইডির প্রশ্নের মুখে তামান্না ভাটিয়া 

১৯

লেবানন থেকে ছোড়া রকেট ঠেকাতে ব্যর্থ ইসরায়েল

২০
X