জাতিরাষ্ট্রের উত্থানকে যদি মনে করা হয় মানবসভ্যতায় জাতিগত বিভাজনের আদিপাপ, তবে সে পাপের প্রথম পঙ্কিল পথ ‘ওয়েস্টফেলিয়ার চুক্তি’। তারপর এই জাতিগত বিভাজন ধীরে ধীরে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে নাজি জার্মানি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যেও। ‘আদিবাসী’ নাকি ‘সেটেলার’ কিংবা ‘ভূমিপুত্র’ নাকি ‘বহিরাগত’ শীর্ষক বিতর্ক অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মাটিতেও বেশ সক্রিয়। বিষয়টি নিয়ে বিবমিষায় আছে খোদ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো। সেখানে বাংলাদেশের মাটিতে এই বিতর্ক নিঃসন্দেহে নতুন কিছু নয়।
ব্যতিক্রমী জলবায়ু ও ভূমিরূপে বসতি হওয়াতে যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তা কোনোদিন ‘পরিচয়ের রাজনীতি’কে বিশ্রিভাবে উসকে দেবে সেটা কেউ চিন্তা করেনি শুরুতে। বাংলার ইতিহাস থেকে দেখতে গেলে প্রথম ভূমিপূত্র নিয়ে সংঘাত হতে দেখা গিয়েছিল পাল আমলে। তাম্রশাসন অনুযায়ী পালরা নিজেদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বরেন্দ্র ভূমির সন্তান হিসেবে। তারা ‘বরেন্দ্র’ তথা ‘বরেন্দ্রী’কে বলছে তাদের ‘জনকভূ’। সহজভাবে বললে বরেন্দ্র তাদের ‘জনকের ভূমি’ তথা ‘পিতৃভূমি’ তথা ‘তারা সেখানকার আদিবাসী’। প্রশ্ন উঠতেই পারে তারা কেন এই পরিচয় ধারণ জরুরি মনে করেছিল?
ইতিহাসের শিক্ষার্থী এবং আগ্রহী পাঠক মাত্রই জানেন- বরেন্দ্রভূমির কৈবর্ত্য বিদ্রোহের কথা। এ সময় বিদ্রোহী মৎস্যজীবী সম্প্রদায় ‘কৈবর্ত্যদের’ নেতা দিব্য তথা ‘দিব্যোক’ চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন পালদের। তিনি নিজেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের সন্তান দাবি করে তাদের ভূখণ্ড থেকে পালদের বিতাড়িত করার শপথ নিয়েছিলেন। পালরা যখন কৈবর্ত্যদের পালটা প্রতিরোধের চেষ্টা করে তখন তাদের আত্মপরিচয় নির্ধারণ জরুরি হয়ে গিয়েছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করে না বলা গেলেও অন্তত এমন হতে পারে বলে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় নির্ভরযোগ্য অনুমান করা যেতেই পারে। বাংলাদেশে চলমান বিবিধ জটিল রাজনৈতিক বয়ান ধীরে ধীরে যে দীর্ঘমেয়াদি গোষ্ঠীগত বিবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তার বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর সংবাদ পর্যবেক্ষণ করতে গেলে দেখা যায় দীর্ঘদিন থেকেই ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের’ বিশেষ সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার অধিকারী অধিবাসীরা নিজেদের ঐ অঞ্চলের ‘আদিবাসী’ দাবি করছেন। তারা এই দাবির প্রেক্ষিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করে চলেছেন। পাশাপাশি পার্বত্য জেলাগুলোতে বসবাসরত অন্য বাংলাদেশিদের ‘সেটেলার’ বলে পুরোপুরি খারিজ করে দিতে চাইছেন। এখানে ইতিহাসের বাস্তবতার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও তুলনামূলক ভিন্নধর্মী জীবনযাত্রা। ইতিহাসের প্রাচীনত্ব নিয়ে তর্ক যে অনেক বন্ধুর পথ সে পথে হাঁটার চেষ্টা না করে শুরুতেই বিশেষ করে ‘বাঙালি’ জাতিসত্তার মানুষকে চিহ্নিত কর হচ্ছে সেটেলার হিসেবে যার বিপরীতে তারা নিজেদের দাবি করছে ‘আদিবাসী’ হিসেবে।
বিশ্বব্যাংকের ধারণাপত্র যেখানে বলছে ‘আদিবাসীরা হচ্ছে স্বতন্ত্র সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী যারা বসতিস্থল এবং সেখানে বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমায় নিবিড় সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তৈরি করে’। প্রখ্যাত ডাচ ইতিহাসবিদ ও নৃবিজ্ঞানী ভেলাম ভান সেন্দেল আদিবাসিতার প্রশ্নে ‘প্রাচীনতম সময় থেকে কোনো স্থানে’ বসবাসকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তবে তিনি এই লাইনটিতেই থমকে গিয়েছেন। উপযুক্ত ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃ-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি এই বিষয়টিকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেননি। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব কিংবা নৃবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রেও আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরি। কারণ আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তার ধারণা বিনির্মাণে অনেক সময় দশ বছর আগের চুলার গর্ত হয়ে যেতে পারে আড়াই হাজার বছরের পুরাতন গর্তবসতি। তিন বছর আগের খুঁটির গর্ত হয়ে যেতে পারে হাজার বছরের পুরাতন কোনো ঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ‘পোস্ট হোল’।
যাই হোক আমরা কমবেশি জানি মহামারির সময় ভারতের বিভিন্ন পার্বত্য এলাকা থেকে অভিবাসনের কথা। ওদিকে জৈন্তিয়া পাহাড়ের বিভিন্ন রাজবংশের ইতিহাস এমনকি চুতিয়া রাজবংশের ইতিহাসের সঙ্গেও বর্তমান বাংলাদেশে যারা আদিবাসীতার দাবি জানাচ্ছেন তাদের মেলানোর মতো পর্যন্ত তথ্যসূত্র নেই। বাংলাদেশের সিলেটে জৈন্তাপুরের খাসিয়া পল্লীতে প্রাপ্ত বিশালাকৃতির পাথরের সমাধি তথা মেগালিথগুলোকে সামনে রেখে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যালোচনার সুযোগ ছিল। তবে প্রাচীনত্বের বিচারে শুরুতেই সেগুলোকে বাদ দিতে হয়। এমনকি ইতিহাসের সূত্রগুলোকে যেভাবেই জোড়াতালি দেওয়া হোক না কোনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার পূর্বে বাংলাদেশের বর্তমান আদিবাসিতার দাবি উত্থাপনকারীদের ন্যূনতম সম্পর্ক স্থাপন করা কঠিন।
আদিবাসিতার প্রশ্ন যখন উঠেই গেছে একটু যাচাই করে দেখা যেতেই পারে সংস্কৃতি বিকাশের শুরুতে এই ভূখণ্ডে কাদের বিচরণ ছিল। সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির নিদর্শন হিসেবে নব-পলীয় যুগে ফসিল কাঠে তৈরি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে সিলেটের হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চাকলাপুঞ্জি থেকে। অনেকে নরসিংদীর উয়ারি-বটেশ্বর থেকেও হাতকুঠার ও বাটালি প্রাপ্তির দাবি করেছেন। পাশাপাশি কুমিল্লার লালমাই ময়নামতি, ফেনীর ছাগলনাইয়া ও পার্বত্য রাঙ্গামাটি থেকেও কিছু প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ারের দেখা মিলেছে।
বিশ্বের বাস্তবতায় এই সময়কালকে সংস্কৃতির উন্মেষপর্ব মনে করা হয়। মানুষ তাদের শিকার ও সংগ্রহনির্ভর জীবনযাত্রা ছেড়ে এই সময় এসে কৃষিকাজ ও পশুপালনের মাধ্যমে স্থায়ী বসতির সূচনা করেছিল। তাই বাংলাদেশের যে সকল স্থান থেকে এসব পাথরের তৈরি হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে তা সংস্কৃতির সূচনাপর্বের পাশাপাশি ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর’ বসতিস্থলের দিকেও নির্দেশ করে। প্রাগৈতিহাসিক ফসিল কাঠের তৈরি হাতিয়ারগুলোর প্রাপ্তিস্থানের ভৌগোলিক পরিসীমা হিসেব করলে ‘বাংলাদেশের আদিবাসী মানুষের’ সাংস্কৃতিক বিস্তার হওয়ার কথা হবিগঞ্জ থেকে শুরু করে লালমাইয়ের পাহাড়ি এলাকা এবং মধুপুর গড় এবং বরেন্দ্র ভূমিতে। তবে তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেক তথ্যগত দুর্বলতা ছিল। সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকগণ ধারণা করেছেন বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাসিক মানুষের এ বসতির সময়কাল ‘খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ’।
প্রত্নউদ্ভিজ উপাদান নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন মিজানুর রহমান। তিনি মনে করেন ‘এই অঞ্চল থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক ও জেনেটিক দিক থেকে বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এক ধরনের বুনো ধান পাওয়া গিয়েছে যা খরা ও বন্যাসহিষ্ণু। যা স্বল্প পানি কিংবা বৃষ্টিপাতের পানিতেও চাষাবাদ করা সম্ভব ছিল। অন্যদিকে সে এ ধান দ্রুত পেকে যাওয়ায় প্রয়োজন মতো সংগ্রহ করা যেত। তখন জলবায়ু হয়ে উঠেছিল চরম শুষ্ক, ফলে পরিবেশের সঙ্গে এ রকম অভিযোজনসম্পন্ন ধানপ্রাপ্তি মানুষকে প্রাগৈতিহাসিককালে এ এলাকায় বসতি স্থাপন ও জীবন নির্বাহের একটি অনুকূল পরিবেশ এনে দিয়েছিল।’ তিনি সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে দাবি করেছেন বুনো ধান ছাড়াও তৎকালীন মানুষ কাউন, চিনা, নানা রকমের ডাল, বুনো সরিষা ও তরমুজ জাতীয় ফল উৎপাদন করেছে। তখনকার বুনো ফলের মধ্যে কলা, কাঁঠাল, জলপাই, কমলালেবু জাতীয় নানা ফলের কথা তুলে ধরেছেন তিনি। যাই হোক মিজানুর রহমানের গবেষণা থেকে আপাত দৃষ্টিতে এটুকু প্রতীয়মান যে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি থেকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বসতি গড়ে তুলেছিল এই অঞ্চলের মানুষ।
প্রাগৈতিহাসিক কালপর্ব পেরিয়ে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় বসতি নির্মাণ করেছে। মহাস্থানগড় থেকে প্রাপ্ত লিপি প্রমাণে দেখা যায় ঐতিহাসিক যুগের প্রাচীনতম বসতিটি খুব সম্ভবত শুরু হয়েছিল মৌর্য আমলে। তবে তার আগেও এই অঞ্চলে সমৃদ্ধ মানব বসতির চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে খোদ মহাস্থানগড় এবং তার পাশাপাশি উয়ারী-বটেশ্বর থেকে। মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, পাল ও সেন আমলের পরিক্রমায় মধ্যযুগে প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশের সংস্কৃতি। তখন বাংলার স্বাধীন সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকাশ ঘটেছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের। তাদেরকে সামনে রেখে এই সময় পরিপূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ ঘটে স্বতন্ত্র এক মানব ভাষাগোষ্ঠীর যারা দীর্ঘদিন থেকে অভিন্ন ভূমিতে বসতি স্থাপন করেছিল। তবে তাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ ও রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রকৃত সময়কাল নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে।
নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি এলাকার পাশাপাশি মধুপুরগড় ও বরেন্দ্র ভূমির লালমাটিতে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগেও সমৃদ্ধ মানববসতির অস্তিত্ব ছিল। পাশাপাশি মহাস্থানগড়ে ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক খনন দল কর্তৃক পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সাতটি স্তরে উন্মোচিত হয়েছে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক নিদর্শন। ধারাবাহিক এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্তরায়ণ প্রমাণ করে প্রাচীনতম সেই বসতির ধারাবাহিকতাই বাংলাদেশে এখনো চলমান। তাই এখানে আলাদা করে অন্য কারও আদিবাসীতার দাবি তোলা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণসিদ্ধ নয়।
বিগত কয়েকশত বছরের ইতিহাস থেকে বিশ্লেষণ করতে গেলে ঔপনিবেশিক যুগের আদমশুমারি প্রতিবেদন থেকে খোঁজ করা যেতে পারে। আমরা খুঁজে দেখতে পারি ঐ সময়ের জেলা গেজেটিয়ারগুলোতে পার্বত্য এলাকার মাটিতে অন্য সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালিরা ছিল কি না? আমরা জানি ১৮৬৪ সালের দিকে মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিহারের হাজারীবাগ থেকে কলকাতা হয়ে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন টমাস হারবার্ট লিউইন। আমরা তাকে মূলত টিএইচ লিউইন নামেই পার্বত্য চট্টগ্রামের কিংবদন্তির জেলা প্রশাসক হিসেবে জানি। তিনি ১৮৬৬-৭৩ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিজোরামে লুসাই পাহাড় এলাকায় কাজ করে গিয়েছেন। তিনিও লিখে গিয়েছেন ‘এই এলাকায় চাকমা, মারমাদের পাশাপাশি বিস্তৃত বাঙালি গ্রামের অস্তিত্বের কথা’। তাই হঠাৎ করেই বাঙালিরা গিয়ে পাহাড়ে বসবাস শুরু করেছে এমনটা বলার সুযোগ নেই।
প্রাগৈতিহাসিক সময়কাল থেকে শুরু করে প্রত্নতাত্ত্বিক বিবেচনায় তাম্রপ্রস্তর তথা ‘কালো-ও-লাল’ মৃৎপাত্র স্তরের যুগেও বাংলাদেশ ও ভারতের ‘বাঙালি’ নামের যে জনগোষ্ঠী তাদের বিকাশের ইতিহাস দৃশ্যমান। নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে তারা হাজার বছর ধরেই তাদের ভূখণ্ডে বসবাস করে আসছে অতীত অধিবাসীদের ধারাবাহিকতায়। ফলে বাংলাদেশ, আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে যে বাঙালি জনগোষ্ঠী বাস করে তাদের বসতিস্থলের বৈচিত্র্য থাকলেও সংস্কৃতির শেকড় অনেক গভীরে। তাই সমতল কিংবা পাহাড়ে যারা যেখানেই বাস করুক তাদের ‘সেটেলার’ বলে ‘আদারিং’ করার সুযোগ নাই। একইভাবে জনজাতি হিসেবে তাদের পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে অন্য যারা এই ভূখণ্ডে বাস করেছে সমতলে, নদী তীরে কিংবা পাহাড়ে সবখানেই ছিল স্ব স্ব অবস্থান থেকে পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক বিকাশের উত্তরাধিকার।
আরও একবার ভেলাম ভন সেন্দেল এর প্রখ্যাত ‘The Dangers of Belonging: Tribes, Indigenous Peoples and Homelands in South Asia (2011)’ শীর্ষক প্রবন্ধের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। তিনি নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ ও ‘সেটেলার’ এর ধারণাটি নানা দিক থেকে সমস্যায়িত। এ বিষয়ে ভেলাম ভন সেন্দেল এর মতো অভিন্ন মত আন্দ্রে বেটেইলে, বেনেডিক্ট কিংসবারি ও জন বোয়েনের। প্রাচীনযুগের মানব অভিবাসন কিংবা জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাদের এভাবে সংজ্ঞায়িত করাটা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। তিনি মনে করেন ‘আদিবাসী’ কিংবা ‘সেটেলার’ শীর্ষক নামকরণ উত্তর আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় যতটা প্রযোজ্য বাংলাদেশ ও ভারতের বাস্তবতায় তেমনটি হবে না।
আমরা যদি সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি হিসাব করি তাহলেও বিষয়টি স্পষ্ট হবে যে ১৯৪৭ সালে দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে বাংলাদেশে কোনো ইংরেজ পরিবার থেকে যায়নি। দখলদার শক্তির বংশধর হিসেবে তারা কেউ এখানে থেকে গেলে তখন তাদের সেটেলার হিসেবে চিহ্নিত করা যেতো। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে কিংবা আফ্রিকার নানা দেশে এমনটি হয়েছিল। তাই তাদের দেশে ‘আদিবাসী’ কিংবা ‘সেটেলার’ চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো জটিলতায় পড়তে হয় না।
আমরা দেখতে পাই বর্তমান বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির বাইরে চাকমা, মারমা, মগ, কুকি মুরংসহ প্রায় ১৩টি জনজাতি বাস করছেন। সমতলে রয়েছেন সাঁওতালগণ। সিলেটে বাস করছেন খাসিয়া ও মণিপুরিসহ আরও অনেকে। তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই নিজস্ব ভাষা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য সামনে রেখে তাদের বৈচিত্র্যময় সমাজ গড়ে তুলেছেন। ঐতিহাসিক সূত্র থেকে হিসেব করলে ১৭ শতক কিংবা তারপরে বিভিন্ন সময়ে পার্শ্ববর্তী মায়ানমার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা এলাকা থেকে তারাই বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে অভিবাসন করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মতভেদ ও সাংস্কৃতিক সংঘাত তৈরি হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু তারাই যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন কিংবা সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করছেন মোগল আমল থেকে এ অঞ্চলে বসবাস করার কথা সংকট তৈরি হচ্ছে সেখানে। শুধু তাই না তারা জোর দিয়ে এটাও বলছেন তারাই ‘প্রকৃত আদিবাসী’ আর প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকভাবে এই ভূখণ্ডে হাজার বছর ধরে বসবাসকারী বাঙালিরাই নাকি ‘সেটেলার’। এখানে কোনো রাখঢাক না করেই একদিকে তাদের ‘আদিবাসী পরিচয়’ অন্যদিকে বাঙালিদের ‘সেটেলার হিসেবে বহিষ্কারের দাবি’ তৈরি করেছে দীর্ঘস্থায়ী এক সাংস্কৃতিক সংঘাত ও রাষ্ট্রীয় সংকট। নানা কারণে বিভিন্ন এনজিও কিংবা কথিত শুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ধার না ধেরে তাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা ও সাংস্কৃতিক বিকাশ শুরু হয়েছিল প্রায় ২৫০০-৩০০০ বছর আগে। যা সম্প্রতি ‘আদিবাসী দাবিদার’ জাতির এই ভূখণ্ডে পা রাখারও আনুমানিক প্রায় দুই হাজার বছর আগের ঘটনা।
জাতিসত্তা হিসেবে ‘বাঙালি’ পরিচয় সামনে রেখে তর্কের আগে আমাদের ভাবতে হবে ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রটি জাতিগত বহুত্ববাদ এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত। সংখ্যাগত দিক থেকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে কারও সংখ্যা কম হলে অন্যদের বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। সাংস্কৃতিক দিক থেকেও তাদের জীবন সে হিসেবে বৈচিত্র্যময় হওয়ার কথা। বহুজাতি ও ধর্মের মানুষের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিটি ধর্ম ও জাতির অধিকার সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত। সেখানে আলাদা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘বাঙালি’ জনগোষ্ঠীকে ‘সেটেলার’ তকমা দেওয়াটা একদিক থেকে যেমন অসাংবিধানিক, অন্যদিক থেকে নির্লজ্জ জাতিগত সাম্প্রদায়িকতার অংশ। তাই চিরাচরিত সেই ‘আদিবাসী’ কিংবা ‘সেটেলার’ নিয়ে তর্ক করাটা নিরর্থক।
‘ভূমিপুত্র’ কিংবা ‘বহিরাগত’ যাই হোক স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে সবাই স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। স্বাধীন বাংলাদেশে নোয়াখালি, বরিশাল কিংবা পঞ্চগড় থেকে কেউ ঢাকায় এসে বসতি স্থাপন করলে সে যেমন ‘সেটেলার’ হয় না পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি তথৈবচ। তাই এখানে এক সম্প্রদায় কর্তৃক অন্যদের ‘সেটেলার’ তকমা দিয়ে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে উৎপাত করাটা যেমন বেআইনি, তেমনি রাজনৈতিক দিক থেকে নেতিবাচক পূর্বানুমান তৈরি করে অন্যদের হেয় করার গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধিও অনুচিত। আমরা যদি এটা বিশ্বাস করি পাহাড়ে যারা বসবাস করে তারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে বাংলাদেশের নাগরিক তাহলে এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যাগুলো থেকে সহজেই উত্তরণ সম্ভব।
ড. মো. আদনান আরিফ সালিম: গবেষক, লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
মন্তব্য করুন