শিব উবাচ
দেবিত্বং ভক্তসুলভে সর্বকার্যবিধায়িনী।
কলৌ হি কার্যসিদ্ধ্যর্থমুপায়ং ব্রুহি যত্নতঃ।।
শিব বললেন—হে দেবী! তুমি ভক্তের কাছে সহজলভ্য এবং সমস্ত কর্মের বিধানকারিণী। কলিযুগে কামনাপূরণের যদি কোনো উপায় থাকে তবে তোমার বাণীদ্বারা সম্যকভাবে তা বলো। দেবী বললেন, রে দেব! আমার ওপরে আপনার অসীম স্নেহ। কলিযুগে সর্বকামনা সিদ্ধির যে সাধন তা আমি বলছি, শুনুন। তার নাম হলো ‘অম্বাস্তুতি’।
দুর্গাসপ্তশ্লোকী স্তোত্রে নিবেদন করা হয়েছে, ‘হে মা দুর্গা! আপনি স্মরণ মাত্রই সব প্রাণীর ভয় হরণ করে নেন এবং পরম কল্যাণময়ী বুদ্ধি প্রদান করেন। দুঃখ, দারিদ্র্য ও ভয়হারিণী দেবী! আপনি ছাড়া দ্বিতীয়া কে আছেন যার চত্ত সকলের উপকার করার জন্য সততই দয়ার্দ্র। নারায়ণী আপনি সকল প্রকার মুঙ্গল প্রদানকারিণী, মঙ্গল্ময়ী, কল্যাণদায়িণী শিবা। আপনি সর্বপুরুষারথ সিদ্ধিদায়িনী, শরণাগত বতসলা, ত্রিনয়নী গৌরী। আপনাকে প্রণাম।
শরণাগত, দীন এবং পীড়িতকে রক্ষায় সতত নিয়োজিত তথা সকলের পীড়া নিবারণকারী নারায়ণী দেবী। আপনাকে প্রণাম। সর্বস্বরূপা, সরবেশ্বরী তথা সর্বপ্রকার শক্তিসম্পন্না দিব্যরূপা দেবী দুর্গে! সকল ভয় থেকে আমাদের রক্ষা করুন, আপনাকে প্রণাম।
হে দেবী! আপনি প্রসন্ন হলে সর্বব্যাধি দূর করে দেন, আবার কুপিত হলে মনোবাঞ্ছিত সব কামনা নাশ করে দেন। যারা আপনার শরণ গ্রহণ করেছে তাদের কাছে কখনো বিপদ আসে না। আপনার শরণকারী ব্যক্তি অন্যের শরণদাতা হন। রে সর্বেশ্বরী! আপনি এই রকম তিন লোকের সমস্ত বাধা দূর করুন এবং আমাদের শত্রু নাশ করুন।
প্রতি বছর দুর্গা আসেন। ভক্তরা থাকে প্রতীক্ষায় জগন্মাতাকে কখন পাবে তাদের মাঝে। প্রকৃতি সাজে অপরূপ সাজে। কাশবনে নামে শ্বেত শুভ্র কাশের মেলা। শিউলি ফুলের গাছ উপচানো সাদা লালের ঝালর আর প্রাণ ভোলানো হৃদয় নিংড়ানো সুবাস। বাড়ি বাড়ি প্রস্তুতি। মোয়া, মুড়কি, সন্দেশ, খই, চিড়া, গুড়, নারিকেলের জিভে জল আনা গন্ধ। নতুন কাপড়, নতুন সাবান আর সুগন্ধির মেলবন্ধনে সুখময় পরিবেশ। পুজো পুজো গন্ধ। আকাশ বাতাস উতাল করা। দুগ্গা এলো, দুগ্গা এলো। মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা গড়ার ধুম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি-রিহার্সেল। আবালবৃদ্ধবনিতার আগ্রহ ও উত্তেজনা। আজই মহাপূজার ষষ্ঠী। সবাই এই পূজায় অংশগ্রহণকারী। গণসম্পৃক্ততা আলোড়ন তোলে পরিবারে, সমাজে, পাড়ায়। সৃজনশীলতার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে অনেকে। নতুন কিছু পুরোহিত তালিকা প্রস্তুত করেন পূজার সরঞ্জামের। ঢাকীরা প্র্যাকটিস শুরু করে। প্যান্ডেল নির্মাণ, লাইটিং ব্যবস্থাপনা, চাঁদা সংগ্রহ, স্বেচ্ছাসেবক ব্যবস্থাপনাসহ কতশত কাজ তার ইয়ত্তা নেই। এই ব্যস্ততা মধুর, কাঙ্ক্ষিত। কারণ হাতে সময় নেই। কানে স্বপ্নের বাদ্য। দুগ্গা এলো, দুগ্গা এলো।
লাগাতার পূজা। ষষ্ঠী থেকে দশমী। শত ঘণ্টার পূজা। পোশাক পরিচ্ছেদের প্রস্তুতিও। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক চাই। পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার জন্য স্নান সেরে পরিপাটি সেজে পূজামণ্ডপে যাওয়ার তাড়া। পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন পর্যন্ত উপবাস অনুশীলন। চরণামৃত গ্রহণ। ফল প্রসাদ গ্রহণ। কোনো কিছু বাদ দেওয়া যাবে না।
দুর্গাপূজার অন্যতম বিষয় পঙক্তিভোজ। সর্বজন মিলে একই সময়ে অন্নপ্রসাদ গ্রহণ। অভিন্ন এই প্রসাদ পূজার সর্বজনীন ঐক্যের বার্তাবহও বটে। পরিবার-পরিজন সবাই মিলে ঠাকুর দর্শন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখাশোনা। পূজাকালীন ফুরসতে বাড়িতে আপ্যায়নের ব্যবস্থা সেটিও গৃহস্থ মানুষের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। সময় যেন দ্রুত এগিয়ে চলে পুজোর দিনগুলোতে। বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ মেলে না।
এই আনন্দ পুজোর কল্যাণে। কারণ দুগ্গা এলো, দুগ্গা এলো। পুজোয় আরতি বা আরাত্রিক গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষঙ্গ। সাধারণত পুরোহিত এই আরাত্রিক করে থাকেন। কিন্তু পূজারিরা বসে থাকবে কেন? অতএব, ধুনুচি নাচে অংশগ্রহণ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ধুনুচি নাচ কিন্তু বাদ্যের তালে তালে করতে হয়। এজন্য প্রস্তুতি ও অনুশীলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর হয়ে থাকে। পূজারিরা ধর্মীয় এই নিবেদন মণ্ডপে উপস্থিত থেকে প্রাণভরে উপভোগ করেন।
পূজা উপলক্ষে স্মরণিকা প্রকাশ অধিকাংশ পূজা কমিটি করে থাকে। স্মরণিকায় প্রকাশের জন্য লেখকদের কাছ থেকে লেখা জোগাড় করা, বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপনা, মুদ্রণ, প্রুফ দেখা, বাঁধাই অর্থাৎ সম্পাদনার কাজেও অনেককে নির্ঘুম রাত অতিবাহিত করতে হয়।
দশমী দিনে থাকে দেবীকে মিষ্টি ও সিঁদুর নিবেদন। এই সময়ে নারী ভক্তরা সিঁদুর খেলাতে মেতে ওঠেন। সবশেষে থাকে প্রতিমা নিরঞ্জন। নিরাপদে পরিকল্পিত উপায়ে প্রতিমা নিরঞ্জন। এই পরিকল্পনা, স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মী নিয়োগ সময়সাপেক্ষ ও শ্রমনির্ভর। এসব কাজে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এগিয়ে যান পূজারিরা। কারণ জগন্মাতা আমাদের মাঝে। দুগ্গা এলো, দুগ্গা এলো।
লেখক: সাংবাদিক
মন্তব্য করুন