ইস্ট বেঙ্গল ফুটবল ক্লাবের ১০৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল ২ আগস্ট। এ উপলক্ষে ক্লাবটি বাংলাদেশের চার সাবেক ফুটবলার ও একজন সংগঠককে সম্মাননা জানাল। সেই চারজনের একজন হলেন মোনেম মুন্না। বাকি তিনজন হলেন রুমি, আসলাম ও গোলাম গাউস। এই চারজনের মধ্যে মুন্না দুনিয়া ছেড়েছেন সবার আগে, তাও প্রায় দেড় যুগ হবে।
মোনেম মুন্না আমার কাছে এক বিশাল আফসোসের নাম। আমি মোনেম মুন্নার সময়ে জন্ম নেইনি, তার কোনো খেলা দেখার প্রশ্নই ওঠে না। তার ওপরে জাতি হিসেবে আমরা এতই অসাধারণ(!) যে মোনেম মুন্নার খেলার কোনো ভিডিও আপনি অনলাইনে এভেইলেবল পাবেন না।
সত্তর ও আশির দশককে বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা যায়। ওই সময় আবাহনী আর মোহামেডানের এতটাই ক্রেজি ছিল, পছন্দের দল না জিতলে এক দলের সমর্থকরা বিপক্ষ দলের সমর্কদের সাথে হাতাহাতি শুরু করে দিত। এমনকি এটাও কথিত আছে, সেসময় কোনো কট্টর আবাহনী সমর্থকের মেয়ের সাথে কোনো কট্টর মোহামেডান সমর্থকের ছেলের বিয়ে হতো না।
সালাউদ্দিন, চুন্নু, কায়সার, রুমি, আসলাম, সাব্বিরের মতো ফুটবল সুপারস্টাদের ভিড়ে মোনেম মুন্না ছিলেন একজন অনন্য খেলোয়াড়। তার খেলা দেখে একসময়ের বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জার্মান কোচ অটো ফিস্টার বলেছিলেন, ‘He was mistakenly born in Bangladesh’.
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সেরা ডিফেন্ডারদের একজন বলে গণ্য করা হয় মুন্নাকে। তার হাত ধরে ফুটবলের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ পেয়েছিল একাধিক সাফল্য।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে মুন্নার খেলা দেখে সেসময়ের বাফুফের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, এই বয়সেই এই ছেলে জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা রাখে। ১৯৮৭ সালে আবাহনীতে যোগ দেন মুন্না।
১৯৯১ সালে দলবদলে মুন্না আবাহনীর হয়ে রেকর্ড পরিমাণ পারিশ্রমিক পান, যা ছিল সেসময়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক অনন্য রেকর্ড। এই পারিশ্রমিকের পরিমাণ ছিল ২০ লাখ টাকা যা এখনও অকল্পনীয়।
আবাহনীর হয়ে বাংলাদেশের ফুটবল লীগে দাপটের সাথে খেলতে খেলতে মুন্না নাম লেখান ভারতের অন্যতম স্বনামধন্য ফুটবল ক্লাব ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাব ইস্ট বেঙ্গল বিদেশি কোটায় তাকে দলে অন্তর্ভুক্ত করে। তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইস্টবেঙ্গলের একসময়ের ক্লাব অফিসিয়াল দেবব্রত সরকার বলেছিলেন, ‘এই উপমহাদেশে মুন্নার মতো দ্বিতীয় আর একজন জন্মাবে না’। কলকাতায় মাত্র দুই মৌসুম খেলেই নিজের প্রতিভা দেখিয়েছেন এই ফুটবল কিংবদন্তি। ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের ‘হল অব ফেম’-এ মোনেম মুন্নার নাম রয়েছে, আর সেটা তিনি প্রাপ্য।
জনপ্রিয়তা এবং পারফরম্যান্সের জন্য প্রসাধনী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার ১৯৯৬ সালে মুন্নাকে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে সম্মানিত করে। মোনেম মুন্নার খেলার ভিডিও ইউটিউবে না থাকলেও তার করা লাইফবয়ের বিজ্ঞাপনটি আপনি ইউটিউবে পাবেন।
১৯৯৭ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর ম্যানেজার হিসেবে প্রিয় আবাহনীর ফুটবল দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। ২০০০ সালে কিডনি প্রতিস্থাপনের পর বেশ কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। কিন্তু ২০০৪ সালে তার দেহে ভাইরাস ধরা পড়ে। ২০০৫ সালের ২৬ জানুয়ারি গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন মোনেম মুন্না।
মোনেম মুন্না বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশে জন্মগ্রহণ করলে অবশ্যই এতদিনে তাকে নিয়ে সিনেমা, সিরিজ, ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়ে যেত। বলিউড হলে কমপক্ষে ১০টা বানিয়ে ফেলত, তার মধ্যে দুটো হয়তো ভালোও হতো। যে কোনো একটায় অবশ্যই অক্ষয় কুমার থাকতেন!
মেসি, রোনালদোর সময়ে আমরা মোনেম মুন্নাকে চিনি না। চেনানোর সুযোগ তৈরি করে রাখা হয়নি, সিনেমা হোক বা খেলা- যে কোনো জিনিসের আর্কাইভাল ভ্যালু আমরা আজ পর্যন্ত বুঝতে শিখিনি। এতকিছুর মাঝেও ইস্ট বেঙ্গলের এই সম্মাননা হয়তো অনেকের কাছে নতুন করে মোনেম মুন্নাকে চেনাবে।
হয়তো কেউ বা কারা একদিন মোনেম মুন্নার ওপর রিসার্চ করে কিছু একটা বানিয়ে ফেলবে। সেই দিনের অপেক্ষায় আপাতত।
লেখক : শিক্ষক, সিনেমা বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন