শরিফুল হাসান
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:৩২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
১৭ কোটির এই দেশে

মাত্র ১৭০০ মানুষ সৎ হলে গোটা দেশ বদলে যাবে

শরিফুল হাসান। ছবি : সৌজন্য
শরিফুল হাসান। ছবি : সৌজন্য

বাংলাদেশের সরকারি চাকরি করে বিপ্লবের সুযোগ আছে কী? বিসিএস ক্যাডার হয়ে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ে সমালোচনার সুযোগ আছে কী? রাজনৈতিক বিষয়ে এভাবে কথা বলা কিংবা ছাত্র আন্দোলনের আইকন আবু সাঈদকে এভাবে সন্ত্রাসী বলার সুযোগ আছে কী? না থাকলে সরকার ব্যবস্থা নিতেই পারে। মনে করে দেখুন, অতীতে আপনারা এর চেয়ে তুচ্ছ কারণে অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। এমনকি বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নকে গবেষণায় ‘লুটেরা মডেল’ বলায় শাস্তির মুখে পড়েছিলেন কয়েকজন কর্মকর্তা। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে। আপনাদের পথেই এ সরকার হেঁটেছে।

এখন যেটা হতে পারে ভবিষ্যতে ২০ বছর পরেও কোনো দিন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে রাতারাতি পদোন্নতি দিয়ে সচিব বানিয়ে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না! এই তো কয়দিন আগেও এক ধাক্কায় অনেককে এভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, যাদের অনেককে অতীতে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বঞ্চিত করা হয়েছে। সব ধরনের পদায়নে রাজনৈতিক রং খোঁজা হচ্ছে। তবে এই ধরনের চর্চা কখনোই মঙ্গলজনক নয়। বিশেষত সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে মূল্যায়ন করার ঘোর বিরোধী আমি। আমি সবসময় বলি, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা রাজনৈতিক পরিচয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যোগ্যতা বা অযোগ্যতা কোনোটাই হওয়া উচিত নয়। বরং নিয়োগ, পদোন্নতিতে সততা ও যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি হওয়া উচিত। ডিসি নিয়োগ কিংবা ৪৩তম বিসিএসের গেজেট আটকে রাখা নিয়ে লিখতে গিয়েও এ কথাগুলো লিখেছি। দেখেন, গত ৫৩ বছরেও এ দেশের জনপ্রশাসন ঠিক করতে না পারার ব্যর্থতা সব রাজনৈতিক দলকে নিতে হবে। এর কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় ক্ষমতায় গিয়ে আমলা ও প্রশাসননির্ভর হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে সহায়তা করেছিল এই প্রশাসন। অতীতেও তাই হয়েছে। তবে গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক তকমা দিয়ে জনপ্রশাসনের ভয়াবহ ক্ষতি করা হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে তারুণ্যের ক্ষোভ ছিল।

আফসোস তারুণ্যের এত বড় আন্দোলনের পরও সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলায়নি। বরং মেধা, সততা ও যোগ্যতার বদলে এখনো দলীয় পরিচয় খোঁজা হচ্ছে। এটি শেষ অবদি মঙ্গল ডেকে আনবে বলে আমার মনে হয় না। এসব কারণেই আমি সবসময় ব্যক্তির বদলে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে বিশ্বাস করি। সুশাসনের কথা বলি।

অগেও লিখেছি, একজন প্রশাসনের কর্মকর্তা বা পুলিশ চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর কেন বলবেন তিনি ছাত্রলীগ করতেন, ছাত্রদল করতেন? কেন বলবেন, তিনি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ, বিএনপির ঘনিষ্ঠ? বগুড়া বা গোপালগঞ্জ বলে এত কেন প্রভাব থাকবে? সুশাসন থাকলে তো রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা কোনো যোগ্যতা হতে পারে না।

দেখেন, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করলে এই দেশের এমন সরকারি কর্মকর্তা বা মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন যে, পরিবারের কেউ না কেউ আওয়ামী লীগ করে না এবং একইভাবে তাদের সঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা খোঁজা সহজ কারণ এ দেশে সবাই সবার আত্মীয়। এ কারণেই বলি রাজনৈতিক পরিচয় কোনো যোগ্যতা বা অযোগ্যতা হতে পারে না।

কথাগুলো বলছি, কারণ জনপ্রশাসন, পিএসসি এসব নিয়ে গত দুই দশকের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ, পদোন্নতি দিলে দলের বা ব্যক্তির স্বার্থ উদ্ধার হলেও দেশের মঙ্গল হয় না। জনপ্রশাসন ঠিক করতে হলে বরং এর বাইরে গিয়ে বড় ধরনের সংস্কার জরুরি যেখানে একটা সিস্টেম থাকবে। এই কাঠামোতে মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এই কাঠামোতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সরকারি কর্মচারীদের কোনোভাবেই দলীয় কাজে ব্যবহার করতে পারবে না।

আমি মনে করি, ব্যক্তির বদলে কাঠামোকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের জনপ্রশাসনের বড় ধরনের সংস্কার জরুরি। আমার ১৭০০ লোকের একটা তত্ত্ব আছে। আমি গত এক দশক ধরে বলছি, ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে মাত্র ১৭০০ মানুষ সৎ হলে গোটা দেশ বদলে যাবে।

নথিপত্র ঘেঁটে এবং আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণে দেখেছি, সরকারি নানা প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, চুক্তি, বিল থেকে শুরু করে সবজায়গায় যাদের রক্ষক হওয়ার কথা ছিল তারাই ভক্ষক হয়েছেন। অর্থাৎ যাদের কাজ ছিল দুর্নীতি ঠেকানো তারাই এই দুর্নীতি করেছে। সে কারণেই বারবার লিখেছি, ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে শুধুমাত্র ১৭০০ লোক ঠিক হলেই গোটা বাংলাদেশ বদলে যাবে। কীভাবে শুনবেন?

দেখেন, একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রধান উপদেষ্টা, মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা ২০-৪০ জন, ৩০০ জন সংসদ সদস্য, শ খানেক স‌চিব, দুর্নীতি কমিশনের প্রধান থেকে শুরু করে শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা, অর্ধশত সরকারি প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক বা প্রতিষ্ঠান প্রধান, ৬৪ জন ডিসি, ৪৯২ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, তিন বাহিনীর প্রধান, একজন আইজিপি, ৬৪ জেলার ৬৪ জনসহ পু‌লিশ সুপার মর্যাদার কয়েকশ কর্মকর্তা, শ পাঁচেক থানার ওসি, বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্তা, প্রধান বিচারপ‌তি ও আপিল বিভাগের বিচারপতিসহ হাইকোর্টের প্রায় একশ বিচারপ‌তি, শ খানেক জেলা জজ ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যা‌জিস্ট্রেট, অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি‌সি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, গোটা ৫০ ব্যাংকের এমডি।

দেখবেন সব মিলিয়ে মোট সংখ্যা দাঁড়াবে ১৭০০-এর মতো। আপনি যে খাতের দুর্নীতির কথাই বলেন না কেন এই ১৭০০ মানুষ ঠিক হলে সেটা বন্ধ হবেই। আমি মনে করি, এই ১৭০০ লোকের পদায়নে রাজনৈতিক পরিচয়ের বদলে মেধা, সততা এবং অতীতের কাজ দেখে পদায়ন করতে হবে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টাদের শপথ বাক্যেও কিন্তু এমনটাই লেখা থাকে। জানি না আপনারা কয়জন শপথ অনুষ্ঠান দেখেন। শপথ অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা হোক বা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী হোক বা উপদেষ্টারা সবাই শপথ করে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’

অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগ কথাটার মানে হচ্ছে- আপনি কারও প্রতি রাগ দেখাবেন না, আবার কারও প্রতি অনুরাগ বা ভালোবাসাও দেখাবেন না। এই দেশে গত ৫৩ বছর ধরে রোজ এই শপথ ভাঙা হচ্ছে। যারা শপথ নেন তারা অনুরাগ-বিরাগ দেখান। সবাই দলের লোক খোঁজে।

আচ্ছা বলেন তো, দলের লোকের বাইরে সৎ কর্মকর্তা নেই? আমি তো মনে করি, আমাদের জনপ্রশাসনে বেশিরভাগ মানুষ দলের বাইরে থাকতে চান। এজন্যই বলি, রাজনৈতিক দর্শন বা পরিবারের কেউ রাজনীতিতে যুক্ত থাকলে সেটা তার যোগ্যতা কিংবা অযোগ্যতা কোনোটাই হতে পারে না। বরং চাকরিতে নিয়োগ বা পদোন্নতিতে সততা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম, সাশ্রয়, ইতিবাচক পরিবর্তন, দিনশেষে সাধারণ মানুষের মূল্যায়ন হতে হবে প্রধান যোগ্যতা।

মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে চব্বিশে আমাদের তরুণরা সেই সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্নে জীবন দিয়েছে। তারা সুশাসন চেয়েছে। চেয়েছে সুন্দর এক বাংলাদেশ! আর সে কারণেই নীতি নির্ধারকদের বলি, বিসিএস বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে পদায়নে রাজনৈতিক রং খোঁজার চর্চা বন্ধ করে এমন একটা পদ্ধতি বানান যেখানে সততা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম, সাশ্রয়, ইতিবাচক পরিবর্তন, দিনশেষে সাধারণ মানুষের মূল্যায়ন হতে হবে প্রধান যোগ্যতা।

কোনো না কোনো সরকারকে তো এই চর্চা শুরু করতে হবে। আশা করছি সবার বোধ জাগবে বিশেষ করে নীতি নির্ধারকদের। ভালো থাকুন সবাই। ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ! (লেখাটা ফেসবুক থেকে নেওয়া)

লেখক: শরিফুল হাসান, কলামিস্ট ও বিশ্লেষক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজীপুরে ট্রাকচাপায় বাইকের দুই আরোহী নিহত

আমরা আল্লাহর ওপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারত : দুলু

কঠোর আন্দোলনের প্রস্তুতি আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের

সহসমন্বয়ক সাজিদুলকে জড়িয়ে কালবেলার নামে ভুয়া ফটোকার্ড

উপদেষ্টা হাসান আরিফের দাফন সোমবার

সামাজিক ন্যায়বিচারে রুবী গজনবী পুরস্কার জিতল নারীপক্ষ

‘স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়, সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে বন্ধুত্ব রাখতে চাই’

ইউক্রেনের ৬ দূতাবাসে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

‘আমি অপেক্ষায়, আমার বাবা আর ভাত খেতে আসে না’

আজ কেন বছরের দীর্ঘতম রাত?

১০

আগামীর বাংলাদেশ তরুণদের হাতে তুলে দেব : ডা. শফিকুর রহমান

১১

সিরিয়ায় রাশিয়া পরাজিত নয়, তবে প্রধান বিজয়ী ইসরায়েল : পুতিন

১২

জেসিআই ঢাকা ইউনাইটেডের নেতৃত্বে অনি-রবি

১৩

রাজশাহীতে বাসচাপায় একই পরিবারের ৩ জন নিহত

১৪

‘পুলিশ ও জনগণ একে অন্যের পরিপূরক হলে আমরা একটি সুন্দর সমাজ গড়তে পারব’

১৫

চন্দনাইশের সালমা আদিল ফাউন্ডেশনের বৃত্তি প্রদান

১৬

হিন্দুদের ওপর সহিংসতা নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর

১৭

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছাত্রদের কীর্তিগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে : ইসলামিক ফ্রন্ট

১৮

উপদেষ্টা হাসান আরিফের প্রয়াণে পূজা পরিষদের শোক

১৯

পুলিশকে ১৫ বছর রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে : আইজিপি

২০
X