মো. মশিউর রহমান
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৩, ১১:০৪ এএম
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৩, ০৪:২০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
মো. মশিউর রহমান

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের উপায়

মো. মশিউর রহমান। ছবি : সৌজন্য
মো. মশিউর রহমান। ছবি : সৌজন্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের আড্ডা থেকে গ্রামের চায়ের আড্ডা—সবাই দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে কথা বলছে, সবাই বলছে ঋণ বেশি, দ্রব্যমূল্য বেশি, খেলাপি ঋণ বেশি, রপ্তানি কম, রেমিট্যান্স কম এবং ডলার সংকট প্রভৃতি। আমরা আজকের লেখায় সমস্যার সমাধান লেখার চেষ্টা করব।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা:

কোনো পণ্য বা সেবার দাম বেড়ে গেলে সেই বর্ধিত দামকে বলে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য সবাই ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয় এই যুক্তিতে, অর্থ সরবরাহ কমলে মানুষ কম কিনবে তাই পণ্যের দামও কমে যাবে। ইহা একটি ভুল ধারণা, কারণ যারা ব্যবসা করেন তাদেরও তখন উচ্চসুদে ঋণ নিতে হয়। তাই তাদের উৎপাদন খরচ বা ব্যবসা খরচ বেড়ে যায়। খরচ বাড়লে কেউই আর কমদামে বিক্রি করতে পারে না অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যায়। মূলকথা হলো, মূল্যস্ফীতি আর সুদের সঙ্গে রয়েছে ধনাত্মক সম্পর্ক। অর্থাৎ একটি বাড়লে আরেকটি বাড়ে। তাই সুদের হার বাড়িয়ে আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ভুল দর্শনে এগিয়ে যাচ্ছি।

মূল্যস্ফীতির প্রধান খাত হলো, খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং আমদানি দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশে একদিকে যেমন প্রচুর মানুষ রয়েছে অন্যদিকে রয়েছে উর্বর জমি। কৃষিঋণ সহজীকরণ (স্বল্প সুদ ও প্রান্তিক কৃষককে সরাসরি ঋণপ্রদান) ও আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতিতে বাংলাদেশ খুব সহজেই খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারে এবং খাদ্য পরিবহন ও ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে সব ধরনের অনিয়ম বন্ধে ব্যবস্থা নিলে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির সমস্যা সমাধান হবে, যেমন: পাইকারি বাজারের ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে দেশের ভেতরেই প্রচুর মানুষ থাকায় উৎপাদন বাড়লেও যথেষ্ট ভোক্তা পাওয়া যাবে তাই মন্দার সৃষ্টি হবে না। কৃষির ওপর বিশেষ নজরই দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে, যা একই সঙ্গে জনতুষ্টিও ঘটাবে। অন্যদিকে, আমদানি দ্রব্যের মধ্যে বিলাসদ্রব্য দেশে উৎপাদন সহজতর হলে এবং ব্যবসায় সব ধরনের বাধা দূর করা গেলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কোনো কঠিন কাজই হবে না।

রাজস্ব আদায় ও আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কমিয়ে আনা:

কম রাজস্ব ও অতিরিক্ত রাজস্ব উভয়ই ক্ষতিকর। উচ্চ ট্যাক্স ও ভ্যাট দুর্নীতি বাড়িয়ে দেয়। কারণ তখন অনেকেই ঘুস দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিতে চাইবে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বত্র ট্যাক্স গভরন্যান্স বাস্তবায়ন করতে হবে। ট্যাক্স গভরন্যান্স ছাড়া করপোরেট গভরন্যান্স কেবল ফাঁকা বুলি।

উল্লেখ্য, অনেক ব্যবসায়ীর, ব্যাংকঋণ, আয়, ট্যাক্স, ক্যাশফ্লো ও খরচের সঙ্গে ম্যাচিং পাওয়া যায় না। অনেকের আবার একাধিক কোম্পানির লাইসেন্স থাকলেও মজুত পণ্য একই গুদামে থাকে। কারণ, তাদের ব্যবসার ধরন অভিন্ন। অভিন্ন পণ্য নিয়ে একাধিক কোম্পানির ব্যবসা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ প্রক্রিয়ায় এবং সচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে রাজস্ব আদায় ও আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব।

ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এবং বৈদেশিক মুদ্রা:

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যে অস্থিতিশীলতা রয়েছে, তা সমাধানে মূল্যস্ফীতি, বিনিময়মূল্যের অস্থিরতা, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি কমিয়ে আনা আর রিজার্ভ কমে যাওয়া; এসবের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এসব কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া, শ্রমবাজারে সংকট তৈরি হওয়া এবং সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি সীমিত হয়ে পড়া। এগুলোর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। যেহেতু বৈদেশিক লেনদেনের ওপর ঘাটতি বড় আকারে এসেছে, সে জন্য টাকার বিনিময় হারের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। টাকার আরও পতন হলে তো আমদানি করা পণ্যের দাম আরও বাড়বে।

এসব সমস্যার সমাধানের অন্যতম একটি উপায় হলো প্রবাসীদের নিরাপত্তা, সম্মান ও সহযোগিতা এবং আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে দক্ষ করা ও ভর্তুকি ঋণে বিদেশে শ্রমিক পাঠানো। দেশের ভেতরে একটি নিরাপদ ও কম ব্যয়বহুল পেমেন্ট সিস্টেম গড়ে তোলা, উদ্যোগ নিলে সহায়তা করতে পারব। বাংলাদেশের সর্বত্র ইন্টারনেট সুবিধা বিদ্যমান এবং দরিদ্র মানুষের হাতেও রয়েছে স্মার্টফোন। এ প্রক্রিয়ায় মোবাইলভিত্তিক ব্যয়বহুল পেমেন্ট সিস্টেম এর পাশাপাশি স্বল্প খরচের ইন্টারনেটভিত্তিক পেমেন্ট সিস্টেম একান্ত প্রয়োজন। ইন্টারনেটভিত্তিক পেমেন্ট সিস্টেমে সব ব্যাংকের জন্য একটি মাত্র অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) ডেভেলপ কার্যকর করা যেতে পারে। ইহা একান্ত প্রয়োজন। অন্যদিকে দেশের যুবক শ্রেণির মানুষ সব থেকে বেশি, তাই সাহসী উদ্যোগ নেওয়া একান্ত কাম্য। কারিগরি শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণও প্রয়োজন, যার অনেকটাই বর্তমানে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

সেবা ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার হয় তার একটি খাত হলো, লেটার অব ক্রেডিট বা এলসির জন্য সুইফটে তথ্য আদান-প্রদান।

বাংলাদেশে রপ্তানির বিপরীতে প্রচুর ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলতে হয় যার কিছু থাকে দেশের ভেতরে এবং কিছু থাকে দেশের বাইরে। দেশের অভ্যন্তরে ব্যাক টু ব্যাক এলসির জন্য সুইফট ম্যাসেজের পরিবর্তে নিজেরাই একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারি, যার কেন্দ্রে থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এভাবে আমরা ডলার খরচ কমাতে পারি এবং নিজ দেশে সফল হলে অন্যদেশে বিক্রয় করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন সম্ভব।

এভাবে আমরা বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে পারি এবং খরচ কমাতে পারি, যা একান্ত প্রয়োজন।

আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনা:

দেশে এখনো নন-ব্যাংক পপুলেশন অনেক বেশি তাই ব্যাংকিং পরিধি পল্লি এলাকায় ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং আরও ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ডিজিটাল ব্যাংকের উদ্যোগ একটি সময় উপযোগী ও সঠিক সিদ্ধান্ত।

অন্যদিকে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে উইপোকার মতো খেয়ে ফেলে সব অর্জন ধ্বংস করে দিচ্ছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ দুটি। যথা, ঋণগ্রহীতা নির্বাচনের আগে তার ঋণ প্রয়োজনীয়তা ও আচরণ যাচাই করে না নেওয়া বা দুর্বলভাবে নেওয়া। দ্বিতীয় কারণ হলো, ঋণ দেওয়ার পরে ঋণের ব্যবহার নিয়ে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকা। এ দুটি সমস্যার সমাধান করা গেলে খেলাপি ঋণের সমস্যা অনেকাংশেই সমাধান হয়ে যাবে।

এ কারণেও আমাদের একটি দক্ষ, নিরাপদ ও কম খরচের পেমেন্ট সিস্টেম একান্ত প্রয়োজন। ট্যাক্স গভরন্যান্স এবং খেলাপি ঋণের সঙ্গে ক্যাশফ্লো মিলিয়ে দেখা একান্ত প্রয়োজন। বৃহৎ করপোরেট যেন ব্যাংকে ঋণের জন্য না যায় বরং ক্যাপিটাল মার্কেটে যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে এবং ব্যাংকঋণের ক্ষেত্র খুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।

এভাবেই আমরা দক্ষ জনবল, উন্নত কৃষি ও খাদ্য সমস্যার সমাধান, স্বচ্ছ ও শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থা, কম ব্যায়ের নিরাপদ পেমেন্ট সিস্টেম, বৈদেশিক মুদ্রার সরবারহ বৃদ্ধিতে সহজ সমাধান খুঁজে পেতে পারি এবং একটি সত্য ও সুন্দরের উন্নত বাংলাদেশ পেতে পারি।

মো. মশিউর রহমান : ব্যাংকার

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ট্রাক-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

বিশ্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্‌যাপন হচ্ছে বাংলা নববর্ষ 

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ইইউ রাষ্ট্রদূত মিলার

নৌকার প্রতিকৃতি ভাঙলেন গোপালগঞ্জের আ.লীগ নেতা

বড় শাস্তির মুখে রিয়াল ডিফেন্ডার রুডিগার

কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যসহ আটক ৯

ঝড়ে লন্ডভন্ড রংপুরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ৯ ইউনিয়ন

পরীক্ষায় খাতা দেখতে না দেওয়ায় মারধর, শিক্ষার্থীর মৃত্যু

চালকলে মিলল খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১৮০ বস্তা চাল

তাহলে কী ব্রাজিল ডাকছে আনচেলত্তিকে?

১০

সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ‘বাংলাদেশি’ নিহত

১১

মায়ামির অনুশীলনে কী কারণে অনুপস্থিত মেসি-সুয়ারেজ?

১২

তাসনিম জারা ও জাহাঙ্গীর কবিরকে দেওয়া আইনি নোটিশ প্রত্যাহার

১৩

সন্ধ্যার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

১৪

কোপা জয়ের পর রিয়ালকে নিয়ে যা বললেন ইয়ামাল

১৫

দ্রুত সময়ের মধ্যে জুলাই সনদ : আলী রীয়াজ

১৬

শেরেবাংলা ফজলুল ছিলেন উপমহাদেশের বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ : তারেক রহমান

১৭

অবৈধ কার্যকলাপে ২ কিশোরীকে পুলিশে দিল পরিবার

১৮

ইসরায়েলের পথে হাঁটছে ভারত: সিনেটর সিদ্দিকির হুঁশিয়ারি

১৯

চুরির অপবাদে নারীকে ভয়াবহ নির্যাতন

২০
X