৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসটিতে শিক্ষক সমাজের দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকারের বিষয়টি নিয়ে কথা বলার দিন। প্রতিবারের মতো এবারও দিবসটি পালিত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, তবে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ইউনেস্কো প্রতিবারই দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য করেছে, ‘Valuing teacher voices : Towards a new social contract for education’ যার বাংলা করা হয়েছে, ‘শিক্ষক অভিমতের প্রাধান্য : শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন সামাজিক দায়বদ্ধতার অভিযাত্রা’।
১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ সভায় ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় দ্বিতীয় জন্মদাতা অথবা জাতি গড়ার কারিগর বলে বিবেচিত শিক্ষক সমাজের মান-সম্মান, ইজ্জত ও আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার চিন্তাভাবনা থেকে দিবসটি পালনের উদ্যোগ। শিক্ষার অধিকার মানবিক এবং মৌলিক, বিষয়টি বিবেচনায় এবং জাতিসংঘের ঘোষণা বাস্তবায়নে ১৯৬৬ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তঃসরকার সম্মেলনের সুপারিশ থেকে বিশ্বের সব শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা, সব রাষ্ট্রের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, মানবসম্পদের পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়ক কর্মসূচিতে স্বাক্ষর করেন জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেস্কো) মহাপরিচালক ও সম্মেলনের সভাপতি। সম্মেলনে যোগদানকারী সরকারপ্রধান বা তাদের প্রতিনিধিরা সেটাতে স্বাক্ষর করেন এবং বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন।
সম্মেলনে গৃহীত সুপারিশের মধ্যে প্রধান বিষয়গুলো ছিল- শিক্ষকদের মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিতকরণ, মাধ্যমিক স্তরে সরকারি-বেসরকারি সবার জন্য স্তর নির্বিশেষে শ্রেণি বৈষম্যহীন একই শিক্ষা নীতিমালা, শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন, পদোন্নতি, পেশাগত আচরণ ভঙ্গের শাস্তি, নারী শিক্ষকদের জন্য কর্মোপযোগী পরিবেশ, শিক্ষকদের অধিকার ও নিরাপত্তা এবং পেশাগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিধান ওই সম্মেলনে গৃহীত হয়েছিল।
১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারায় জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোতে সবার জন্য প্রাইমারি ও ইলিমেন্টারি শিক্ষা নিশ্চিত করবে, মাধ্যমিক স্তরে কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ঘটাবে আর মেধা ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষায় সবার জন্য অর্থায়ন করবে। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে (২০০০-২০১৫) মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের ৮টি বিষয়ের মধ্যে ২ নম্বরে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি ও এনজিও স্কুলের মাধ্যমে সংখ্যাগত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য এসডিজিসের (২০১৫-২০৩০) চতুর্থ নম্বরে কোয়ালিটি, ইনক্লুসিভ ইক্যুইটি এবং লাইফলং এডুকেশন বাস্তবায়নে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
কাজগুলো বাস্তবায়নে নিয়োজিত শিক্ষকদের দক্ষতা, আন্তরিকতা, সামাজিক মর্যাদা আর অর্থনৈতিক সচ্ছলতার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু এর কোনোটি নিশ্চিত হয়নি। প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষকের চাকরি শুরু হয় ৯৭০০ টাকার স্কেলে ১৫০০০, আর মাধ্যমিক স্তরে ১২৫০০ টাকার স্কেলে, ১০০০ টাকার মাসিক বাড়ি ভাড়া আর ৫০০ টাকার মেডিকেল সুবিধা দিয়ে ১১৭৫০ টাকার (১০ ভাগ কর্তনের পর) মাসিক বেতন দিয়ে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা উৎসব বোনাস পান মূল বেতনের ২৫ শতাংশ এবং কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ। অবসর ও কল্যাণ তহবিলের কর্তনকৃত টাকা অবসরে যাওয়ার বছরেও শিক্ষক-কর্মচারীরা পাচ্ছেন না। নিয়োগকালে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি উৎকোচের বিষয়টিও মুক্ত নয়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষকদের পিটিয়ে হত্যা, হামলা, গলায় জুতার মালা পরানোর মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছিল জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক কর্মী, গভর্নিং বডির সদস্য দ্বারা, এই সব ঘটনার কোনো ধরনের বিচার না হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর ঢালাওভাবে শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন, আইনবহির্ভূতভাবে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে শিক্ষকরা মর্যাদাহানির শেষ পর্যায়ে। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব পাঠদান কাজের সংকটের বিষয়টি নতুন সমস্যা হিসেবে সামনে আসছে।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারকদের যথেষ্ট আন্তরিকতা যেমন দরকার, সেইসঙ্গে আর্থিক বরাদ্দও প্রয়োজন, সেটা বিবেচনা করেই সংস্থাটি প্রতিটি দেশকে তার দেশের জিডিপির ৭% শিক্ষা খাতে ব্যয় করার তাগিদ দিয়েছিল, যদিও তা কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশে ড. কুদরত-এ-খুদার শিক্ষা কমিশন জিডিপির ৫ শতাংশ, পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ এবং ১০ বছরের মধ্যে শিক্ষাকে সরকারীকরণের তাগিদ দিয়েছিলেন, সেটাও কার্যকর হয়নি। ২০০৬ সালে সেনেগালের রাজধানী ডাকার-সম্মেলনে ইউনেস্কোভুক্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শিক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকে আর্থিক সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে আপাতত জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও, তা কার্যকর হয়নি।
২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচনে এসডিজিসের সম্মেলনে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার ব্যয় সরকার বহন করবে বলে সম্মতি জানিয়েছিল, সেটাও বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত টাকার অঙ্ক কিছুটা বাড়লেও টাকার অবমূল্যায়ন এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে তার সুফল তেমন পাওয়া যায়নি। শিক্ষা খাতে জিডিপির ৭ শতাংশ, ৬ শতাংশ ও ৫ শতাংশ বরাদ্দে বিভিন্ন সরকারের রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি থাকলেও সেখানে গত ৫৩ বছরে বরাদ্দ কখনো ২.৪ শতাংশের ওপরে ওঠেনি। এসডিজিসের আলোকে ২০৩০ সালের মধ্যে (২০১৫-২০৩০) কোয়ালিটি ইক্যুইটি ইনক্লুসিভ এবং লাইফলং এডুকেশন এবং মাধ্যমিক স্তরে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের বাস্তবায়ন করতে হলে পরিকল্পনা কমিশনের হিসেব মতে জিডিপির ৪.৪ শতাংশ টাকা বরাদ্দের সুপারিশ করার পর শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.৬৭ ভাগ।
আর্থসামাজিক বাস্তবতা ও সক্ষমতায় বাংলাদেশের কাছাকাছি এমনকি দুর্বল অনেক দেশও শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয় করছে। শিক্ষা খাতে ভুটান ৪.৮, মালদ্বীপ ১১.২০, ভারত ৩.১ শতাংশ আর বাংলাদেশের অবস্থান ১.৬৭ (২০২৪/২৫)। বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষকদের অবস্থান বিশ্বায়নের বিবেচনায় খুবই দুঃখজনক। দেশের ৯০ ভাগ শিক্ষা এখনো পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার মাধ্যমে। বাকি ১০ ভাগ সরকারি এবং প্রাইভেট শিক্ষার মাধ্যমে। চাকরিজীবনে দুবার পদোন্নতি, প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সেই কলঙ্ক এখনো শেষ হয়নি। পারফরম্যান্সভিত্তিক পদোন্নতির ব্যবস্থা নেই, সময়ভিত্তিক পদোন্নতি এবং চাকরিজীবনে দুটির বেশি পদোন্নতি নেই, ফলে এ পেশায় মেধাবীদের অংশগ্রহণ যেমন কম, তেমনি পেশাগত মান বৃদ্ধির চেষ্টাও কম, ফলে কোয়ালিটি শিক্ষা বাস্তবায়নের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না।
শিক্ষক সংগঠনের অবস্থান: বিশ্ব শিক্ষক দিবসের ঐতিহাসিক ঘোষণা এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণের দাবিতে বাংলাদেশের শিক্ষকরা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে করেছেন। তবে দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে স্বাধীন পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে বৃহৎ আন্দোলন সেই অর্থে হয়নি। জোটগত দীর্ঘ আন্দোলনের কারণে ১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে থেকে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ নিয়ে এমপিওভুক্ত হয়ে বর্তমানে মূল বেতনের ১০০ ভাগের অধিকারী হয়েছেন। বাড়িভাড়া ১০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, উৎসব বোনাস মূল বেতনের ২৫ ভাগ ও ১টি পদোন্নতির শিকলে আটকে আছেন। কোনো কারণে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বকেয়া হলে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া বকেয়া পাওনা পাওয়া যায় না। গভর্নিং বডি দলীয়করণ হওয়ায় সামাজিক মর্যাদায়ও শিক্ষকরা পিছিয়ে।
এ অবস্থা থেকে শিক্ষক সমাজ মুক্তি পাওয়ার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণ পৃথক নিয়োগ কমিশন, বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি চান। শিক্ষকরা শুধু ট্রেড ইউনিয়নের জায়গা থেকে তাদের ভূমিকা পালন নয়, জাতি গড়ার কারিগর হিসেবে, দক্ষ, যোগ্য মানবসম্পদ তৈরিতে অবদান রাখতে চান। তাদের দিয়ে এ কাজগুলো করে নিতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে, শিক্ষকদের একাডেমিক ফ্রিডমের আওতায় কারিকুলাম সিলেবাস প্রণয়ন পাঠদানের স্বাধীনতা প্রদান, শিক্ষা কাজের বাইরে অন্য কাজে যুক্ত না করাসহ পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিতকরণের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও রাজনীতিমুক্তকরণ নিশ্চিত করা এবং আর্থিক নিরাপত্তার জন্য শিক্ষায় অর্থায়ন বাড়ানো প্রয়োজন।
ইউনেস্কো ও সংবিধানের শিক্ষা প্রসঙ্গে সরকার যে অঙ্গীকার করেছে, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষার মান বৃদ্ধিসহ বিশ্ব শিক্ষক দিবসের তাৎপর্য রক্ষা করা সম্ভব। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক ডিক্লারেশনে স্বাক্ষরকারী দেশ যাতে তা বাস্তবায়ন করে, সে বিষয়ে ইউনেস্কোর তদারকি থাকা দরকার। বিশ্বব্যাপী শিক্ষক সমাজের মর্যাদা বৃদ্ধি পাক সেইসঙ্গে শিক্ষক সমাজ ক্লাসরুমের পাঠদান কার্যক্রমসহ বস্তুনিষ্ঠভাবে দেশ জাতি ও দক্ষ মানুষ গড়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। তিনি অধিকার যেমন ভোগ করবেন, সেইসঙ্গে দায়িত্বও পালন করবেন সেই প্রত্যাশা সবার ।
আকমল হোসেন: অধ্যক্ষ, লালমাটিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ; ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
মন্তব্য করুন