শেখ হাসিনার শাসনামলে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনা সরাসরি তার নির্দেশনার ফলাফল হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, শত শত শিক্ষার্থীর হত্যাকাণ্ডের জন্য দায় কার? কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনার ভিত্তিতে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে কি না, তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন ওঠে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য একটিমাত্র মামলাই যথেষ্ট, যদি তা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। অথচ অহেতুক শত শত মামলা দায়ের করে রাষ্ট্রের সম্পদ ও সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু হয় না। এ ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়া প্রশাসনের পচনকে আরও গভীর করে এবং জনগণের আস্থাকে ভেঙে দেয়। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার যদি নিশ্চিত করা যেত, তবে এমন অবস্থা এড়ানো সম্ভব হতো।
বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসন: ঘুষের ফাঁদ থেকে মুক্তি
বিচার ব্যবস্থার ধীর গতি এবং প্রশাসনের দুর্নীতিও আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। প্রশাসনিক কাজগুলোতে এখন এত বেশি ঘুষ লেনদেন চলছে যে, কাজ না করার জন্য সময়ের অভাবের অজুহাত দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু ঘুষ দিলে কাজ হচ্ছে। একটা ফাইল দিনের পর দিন পড়ে থাকে, যতক্ষণ না ঘুষের অর্থ হাতে আসে।
দুর্নীতি ও ঘুষ কেবলমাত্র বিচারপ্রক্রিয়াকেই ধীরগতির করে না, বরং সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। কীভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব, সেটাই এখন সময়ের দাবি।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাধারণ মানুষ একটি জমির মালিকানা পেতে বা কোনো প্রশাসনিক সেবা পেতে প্রশাসনের কাছে গেলে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। আর যারা ঘুষ দিতে পারে না, তাদের কাজ আটকে থাকে। এটা শুধু মাত্র ‘পচা বাংলাদেশ’-এর চিত্র। এমন একটা বাংলাদেশ যা মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের চেতনার সাথে মিলে না।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: দায়িত্ব ও ন্যায়বিচারের প্রয়োজন
আমরা আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের দামে স্বাধীনতা পেয়েছি। এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হওয়া উচিত সেই স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করা। দুর্নীতি, অন্যায়, এবং নৈতিক অবক্ষয়কে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তাই জাতি হিসেবে আমাদের উচিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
স্বাধীনতার আদর্শকে ধরে রাখতে হলে আমাদের নিজেদের দায়িত্বের কথা ভুললে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই চেতনায় দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই হবে।
মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ নিয়ে আমরা লড়াই করেছিলাম, সেই আদর্শ এখনও আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে। আমাদের বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনকেও সেই আদর্শ মেনে চলতে হবে। একটি দেশ শুধুমাত্র তখনই প্রকৃতভাবে এগিয়ে যেতে পারে, যখন তার বিচারব্যবস্থা সঠিক এবং তার প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত থাকে।
পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা
আমাদের প্রতিটি খাতে এবং জীবনের প্রতিটি স্তরে "ভলিউম" বাড়ানোর চেষ্টা না করে "কোয়ালিটি" বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। দুর্নীতি, ঘুষ, এবং অযৌক্তিক অপচয় বন্ধ করতে হবে। শিক্ষায় মানসম্পন্ন জ্ঞানচর্চা, বিচারব্যবস্থায় ন্যায়বিচার, এবং প্রশাসনে স্বচ্ছতা—এসব যদি নিশ্চিত করতে পারি, তবে আমাদের দেশ সত্যিকার অর্থে উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।
আমাদের প্রতিটি স্তরে গুণগত মান বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষা, প্রশাসন, বিচার—সবখানেই কোয়ালিটি বাড়াতে পারলেই আমরা একটা উন্নত ও সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।
এটাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য—আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, এবং জাতীয় জীবনে গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য সচেতন প্রচেষ্টা চালানো। কারণ, জাতির উন্নতি কেবল সংখ্যার নয়, গুণগত মানের উপর নির্ভর করে।
রহমান মৃধা: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
মন্তব্য করুন