অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্ণ হলো ৮ সেপ্টেম্বর। মাস পূর্তি উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। এটি সরকার গঠনের পর তার দ্বিতীয় ভাষণ । এবারের ভাষণটিতে প্রধান উপদেষ্টা গত এক মাসে কী কী কাজ করেছেন ও ভবিষ্যতে কী করবেন তা জাতির সামনে অত্যন্ত সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন । ভাষণে অনেকগুলো করণীয় কাজের কথা ও অনেক দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার আবারও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন । এজন্য সব সেক্টরে সংস্কার করা, পরিবার, অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সরকারি ও বেসরকারি অফিসগুলোও সংস্কার করতে হবে।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের বিচার ব্যবস্থা, ব্যাংক খাত, পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি ও প্রোভিসিসহ জেলা প্রশাসক ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ও বদলি, স্থানান্তর ও সংস্কার শুরু করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে দেশের শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, বয়স্ক, বৃদ্ধ, পুরুষ, মহিলা সবাইকে সালাম জানিয়ে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত সব শহিদের প্রতি। স্মরণ করেন তাদের যারা ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রাণঘাতী অস্ত্রের সামনে হিমালয়ের মতো দাঁড়িয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে, আহত হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, হারিয়েছে তাদের চোখের দৃষ্টি। সে সব বীরদের স্মরণ করেন যারা মিথ্যাচার, লুটপাট, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক দফা দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন তাদের ভাইবোনদের, সন্তানদের যারা এ বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছে। তিনি বলেন আমি আগেও জানিয়েছি, আবারও জানাচ্ছি, গণঅভ্যুথানে সব শহীদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। সব আহত শিক্ষার্থী, শ্রমিক-জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে। আহতদের দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন নতুন তথ্য পাওয়ার ভিত্তিতে এই তালিকা হাল নাগাদ করা হতে থাকবে। তিনি আমাদের দেশের অকুতভয়, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অবদানের কথাও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
তিনি বলেছেন, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দেশের সব দুর্যোগকালে তারা সবসময় আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে বন্যা ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে তাদের সৈনিক এবং অফিসাররা দিনের পরদিন যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছে তার কোনো তুলনা হয় না। জনজীবনে স্বস্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা অনন্য।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সব সদস্যকে আমি ধন্যবাদ জানাই তাদের সততা, ত্যাগ ও অসীম দেশপ্রেমের জন্য। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বন্যা, খরা, ঝড়, বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়সহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে আপনারা সবার শেষ ভরসার স্থান। দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে আপনারা দেশের মানুষের পাশে থেকেছেন। দেশের স্বাধীনতার পক্ষে, সার্বভৌমত্বের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। দেশ গঠনেও আপনারা সবার আগে এগিয়ে এসেছেন। বিগত জুলাই থেকে শুরু হওয়া গণঅভ্যুত্থান, বন্যা, নিরাপত্তা প্রদান, অস্ত্র উদ্ধারসহ সব কার্যক্রমে আপনারা সফলভাবে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারের মাধ্যমে নতুন যাত্রা শুরু করতে চান। কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়, কারখানা খোলা রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করাসহ সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ছয়টি কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয় বিশিষ্ট নাগরিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারা হলেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান শাহদীন মালিক, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন (সাবেক স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন সচিব) এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান। তিন মাসের মধ্যে তাদের রিপোর্ট সম্পন্ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ সভার আয়োজন করবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্রসমাজ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি পরামর্শ সভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। আগামী দিনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে হাত দিবেন তাও উল্লেখ করেন। যেমন- ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা, লুটপাট বন্ধের পরিকল্পনা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, শিক্ষার দিকে নজর দেওয়া, সংবাদ মাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, অর্থনীতির চাকা সচল রাখা, তৈরি পোশাক ও ঔষধ শিল্পের সুরক্ষা, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আনাসহ জ্বালানি িএবং বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ও সংস্কারের কথা বলা হয়। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে গত এক মাসে কি অগ্রগতি হয়েছে ও ভবিষ্যতে কি কি করবেন তা বলা হলেও রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ ও ষড়যন্ত্র। চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- আইনশৃঙ্খলার উন্নতি। পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো না গেলে কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আনা, নির্বাচন কমিশন সংস্কার, প্রশাসনিক কাজে ঘুষ, দুর্নীতি দূর করে ঢেলে সাজানো, প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ সবার সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির আলোকে সম্পর্ক ঠিক রাখা। এসব চ্যালেঞ্জ একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে মোকাবিলা করাও একটা চ্যালেঞ্জ। এছাড়া স্বৈরাচারী হাসিনা ও তার দোসরদের ষড়যন্ত্র তো থাকবেই, তা উত্তোরণ করে একটি অবাধ নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই বড় চ্যালেঞ্জ।
দেশের উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে অতিরিক্ত ৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা হিসেবে চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার অনৈতিক অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছে বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন ডলার, বিশ্বব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন ও জাইকার কাছে অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রিম অর্থ পরিশোধ ও বকেয়া পাওনা নিয়ে রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আলোচনা চলছে।’ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকার লুটপাটের জন্য নতুন করে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ায় মূল্যস্ফীতির শিকার হয়েছে দেশের মানুষ। এ অতুলনীয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
নতুন বাংলাদেশ গড়া, শহীদের ত্যাগ ও কোরবানির প্রতি মর্যাদা দান, সংস্কারের মাধ্যমে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন, সব দুর্নীতিবাজ ও নরহত্যাকারীর বিচার সম্পন্ন করার দিকেই জনগণ তাকিয়ে আছে। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ যেন রচিত হয় এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : মো. মাঈন উদ্দীন, অর্থনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন