বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২৪ এর দিনগণনা চলছে, কারণ বিশ্ব প্রতি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উদযাপন করে। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO) প্রতি বছর এই দিনটির জন্য একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় বিষয় নির্ধারণ করে। এবারের বিষয় হলো ‘পর্যটন এবং শান্তি’ অর্থাৎ ‘পর্যটনের মাধ্যমে শান্তি’ অথবা পর্যটনে শান্তির সোপান।
বাংলাদেশে পর্যটনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা একটি সম্ভাবনাময় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। দেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং জনগণের আতিথেয়তার কারণে পর্যটন খাতের বিকাশ হলে তা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। পর্যটন খাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক বিনিময়, এবং সামাজিক সংহতি বাড়ানো সম্ভব। সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পনা করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। পর্যটন থেকে আয় বৃদ্ধি পেলে দেশীয় অর্থনীতিতে অর্থপ্রবাহ বাড়ে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক।
পর্যটনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, যা বেকারত্ব কমায় এবং স্থানীয় মানুষদের জীবিকা নিশ্চিত করে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে, মানুষের মধ্যে শান্তি এবং সামাজিক স্থিরতা আসে। গ্রামীণ পর্যায়ে পর্যটন খাত অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে, কক্সবাজার, সুন্দরবন, বান্দরবান, রাঙামাটি এবং সিলেটের মতো পর্যটন কেন্দ্রে স্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করে সামাজিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধরে রাখতে এবং সহাবস্থানের সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে টেকসই পর্যটন নীতি অনুসরণ করা হলে পরিবেশগত শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। সুন্দরবন, কক্সবাজার, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল এবং সিলেটের চা বাগান এলাকায় ইকো-ট্যুরিজমের বিকাশ ঘটানো হলে প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং সংরক্ষণ নিশ্চিত হয়। যদি এ ধরনের কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তারা পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে, যা স্থানীয় পর্যায়ে পরিবেশগত শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। এছাড়াও, পর্যটন খাতের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ বিশেষ করে নারী, যুব সমাজ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন সেবামূলক কাজের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, এতে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটে এবং শিক্ষাগত ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সংঘাত এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপের হার কমানো সম্ভব, যা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
পর্যটন খাতের মাধ্যমে বিদেশি এবং দেশীয় পর্যটকদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে, ফলে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্ম, এবং জীবনধারার মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্মান বৃদ্ধি পায়। এতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কমাতে সহায়ক হয় এবং সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদেশী পর্যটকদের আগমন এবং তাদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার ফলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আরও মজবুত হতে পারে। ইতিবাচক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত করে, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় পরোক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া, বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগও বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তিক এবং পাহাড়ি এলাকায় পর্যটনের মাধ্যমে উন্নয়ন করা গেলে, সেই অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব।
পর্যটন প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি সেবার সহজলভ্যতা বৃদ্ধি পায়, যা ঐসব অঞ্চলের মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনে। পর্যটন খাত যদি টেকসই পর্যটনের ওপর গুরুত্বারোপ করে, তবে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া সহজ হয়, যা ভবিষ্যতের জন্যও একটি সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করে। পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত হলে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় কমে, যার মাধ্যমে সামাজিক স্থিতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। পর্যটন খাত স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন পর্যটকরা স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার জন্য আগ্রহী হয়, তখন সেই সম্প্রদায়গুলো তাদের ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি রক্ষায় আরও উৎসাহী হয়। এটি সামাজিক বন্ধনকে মজবুত করে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে পর্যটনের মাধ্যমে শান্তি আনতে হলে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ এবং ভূমিকা থাকতে হবে। পর্যটন খাতকে সফলভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে স্টেকহোল্ডারদের ভূমিকা ও দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটন খাতের উন্নয়নে সরকারের মূল ভূমিকা থাকতে হবে। সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, এবং নিরাপত্তা ও সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। স্থানীয় সম্প্রদায় পর্যটন উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তাদের সম্পৃক্ততা ছাড়া শান্তি ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পর্যটন শিল্পের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের টেকসই ও দায়িত্বশীল পর্যটন প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের দায়িত্বশীল পর্যটন সেবা প্রদান করা উচিত, যাতে স্থানীয় পরিবেশ এবং সংস্কৃতির কোনো ক্ষতি না হয়। বেসরকারি সংস্থা এবং এনজিওগুলো পর্যটন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করতে পারে।
এনজিওগুলো স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পারে, যাতে তারা পর্যটন খাতে সঠিকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। নারী এবং যুবকদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য, তাদের মাধ্যমে পর্যটনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা প্রদান করা যেতে পারে। পর্যটক এবং পর্যটন সংস্থাগুলো বাংলাদেশের পর্যটন খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
পর্যটকদের উচিত স্থানীয় আইন, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। তাদের আচরণে স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশের প্রতি সচেতনতা থাকা উচিত।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গবেষকরা ও পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্য গবেষণা এবং নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবদান রাখতে পারে।পর্যটনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা এবং সেই অনুযায়ী সুপারিশ প্রদান করা।শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে পর্যটনের ভূমিকা এবং এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে পারে।
সুতরাং, পর্যটন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সঠিকভাবে পরিচালিত হলে এবং উপযুক্ত স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা পেলে পর্যটন খাত বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে, যা বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
মো. আশিকুর রহমান অভি : সহকারী অধ্যাপক, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা
মন্তব্য করুন