রেজওয়ান উর রহমান
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৫০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

গণঅভ্যুত্থান : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের বিজয়! বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান-এর মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। শুধু তাই নয়, জন মানুষের ক্ষোভ ও আক্রোশের মুখে উনি দেশ থেকে পালিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এটা ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এটাই ছিল এদেশের ইতিহাসে সব থেকে গৌরবময় ঘটনা। সব থেকে প্রথমে যে নামটি মনে পড়ছে- বীর সন্তান আবু সাঈদ। আসলেই উনি একজন মহাকাব্যের নায়ক- একজন বীরসেনা। ইতিহাসে অনেক যোদ্ধা দেখেছি; কিন্তু আবু সাঈদ এর মতো এমন অসীম সাহসী, নির্ভীক মানুষ খুব কম দেখা মেলে- যিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন শত্রুর বন্দুকের সামনে। সেদিনই বাংলাদেশের এই গৌরবগাঁথা গণঅভ্যুত্থানের সূচনা।

এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে পড়ছে- আমেরিকার Revolutionary War এর উপর নির্মিত মুভি- Patriot এ ব্রিটিশদের দ্বারা নির্যাতিত Benjamin Martin এর ছেলে Gabriel প্রতিবাদ করেছিল কারণ তার ছোট ভাইকে ব্রিটিশ কর্নেল Tavington হত্যা করেছিলো। ঘটনাচক্রে Gabriel তার বাবার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে যোগ দেয় ও শহীদ হয়। এই Gabriel হল সেই ঘটনার আবু সাঈদ। কারণ, আমরা যেমন দেখেছি আবু সাঈদের মৃত্যুর পরে কীভাবে পুরো দেশের ছাত্র জনতাসহ আপামর মানুষ নেমে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি Gabriel এর মৃত্যুর পরে তার বাবা একটি Martin আঞ্চলিক একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করেন এবং তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন দেশ ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীন করবার জন্য। আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর আমরা তদ্রূপ আন্দোলন দেখেছি।

আমরা দেখলাম একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হল। তার প্রধান হলেন- বিশ্ব নন্দিত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমারও অনেক প্রত্যাশা এই সরকারের কাছে। আমাদের প্রাপ্তি আমরা অনেক তাজা রক্ত দিয়ে এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি, এখন প্রত্যাশা অনেক। আমাদের বাংলাদেশ আমাদেরই গড়তে হবে, যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, মনে হল এদেশের তরুণেরা সেটাই আরেকবার মনে করিয়ে দিল। একেই মনে হয় বলে- ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি!

একথা অনস্বীকার্য, বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই গণঅভ্যুত্থান জন্ম নেয়। সুতরাং, বর্তমান সরকার একটি বিপ্লবী অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের প্রধান কাজ হলো– সমাজে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন; অর্থাৎ গণ-অভ্যুত্থান-এর মুল যে মন্ত্র- একটি বৈষম্যবিরোধী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা, সমাজের সব স্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। কাজটা অনেক কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। এদেশের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা এক দানবীয় স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছে, সুতরাং সদিচ্ছা থাকলে রাষ্ট্র সংস্কার এখন সময়ের ব্যাপার। এটি সময়ের দাবিও বটে!

কিন্তু আমাদের সজাগ থাকতে হবে- প্রতিবিপ্লব যেন না ঘটে, কারণ পরাজিত শিবির চাইবেই যেন এই গণঅভ্যুত্থান কোনোদিনও সফল হতে না পারে। বাংলাদেশ যেন কখনো মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারে। বিপ্লবের অপর পিঠেই থাকে- প্রতিবিপ্লব- নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো। যারা প্রতিবিপ্লব করে, তারা সবসময়ই আত্মঘাতী হয়, কেননা তাদের আর হারাবার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিবিপ্লব দেখি- যেমন তিউনিশিয়ার বিপ্লব ও তারপর প্রতিবিপ্লব। শেষ পর্যন্ত সেই বিপ্লবটি সফল হয়নি। তেমনি রুশ বিপ্লব। তাহলে সমাধান কি? এই বিপ্লবী সরকারকে দুটি জিনিসের ওপর খুব সতর্কভাবে নজর দিতে হবে- একটি হল জনতার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা, আরেকটি হল সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা যেন গুজব না ছড়ায়। এ দুটি কাজ অবিলম্বে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতেই হবে।

বাংলাদেশের মানুষ অনেক রক্ত দিয়েছে। অনেক মায়ের বুকে খালি করে সন্তানরা শহীদ হয়েছেন। এরকম সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে এমন নিরস্ত্র গণ-অভ্যুত্থান। কোথাও নেই! যে জাতির সন্তানেরা হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে- ও বলছে- স্বৈরাচারীর পতন হয়েছে? আমাদের কি মুক্তি হয়েছে? সে জাতি কখনও পরাজিত হতে পারে না। আমরা এই স্বাধীনতা ধরে রাখবোই- শুধুমাত্র তিনটি মূলনীতি দরকার- একটি হল- এক জাতি হিসেবে; বাংলাদেশি হিসেবে সবাইকে এক হতে হবে, আর দ্বিতীয়টি হল- বৈষম্যবিরোধী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, তৃতীয়টি হলো- প্রতিষ্ঠানগুলোকে সার্বিকভাবে দলীয়করণ থেকে নিস্তার দেয়া, প্রয়োজনে সংবিধান সংস্কার করে হলেও।

প্রসঙ্গক্রমে, এ অংশে এসে যায়, সংবিধান-এর মূল যে অংশগুলো একজন শাসককে স্বৈরাচার করে তোলে, তার পরিবর্তন, কিংবা একটি নতুন সংবিধান। সেটি অনেক ভাবেই করা যায়, আমি আইনজ্ঞ নই, কিন্তু একজন নাগরিক হিসেবে আমিও দাবি করছি- গণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার নিরিখে একটি সংবিধান।

একজন নাগরিক হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট কিছু উল্লেখযোগ্য ও সময়োপযোগী প্রস্তাবনা-

• অন্তর্বর্তী সরকারের এখনি একটি গণভোট এর আয়োজন করা, এবং তার মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সকল প্রকার সংস্কার বাস্তবায়ন করা।

• যত দ্রুত সম্ভব এই সংবিধান বাতিল করে আগামী ৬-৮ মাসের মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক, মানবাধিকার সম্মত, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্যমূলক একটি সংবিধান প্রণয়ন। সেজন্য একটি গণপরিষদ (Constituent Assembly) আগামী এক মাস কিংবা দ্রুততম সময়ে গঠন।

• সরকারের মেয়াদ থাকবে ৪ বছর। নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচনকালীন সময়ে রাষ্ট্রের আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে।

• আর কখনো যেন কোন শাসক দানব হয়ে উঠতে না পারে, সাংবিধানিকভাবে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

• দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন। দুবারের বেশি একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পারবেন না।

• রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিকেন্দ্রীকরণ যেন কোনো প্রকার বৈষম্যের আবির্ভাব না ঘটে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি লেজুড়বৃত্তি না করা হয়, সেজন্য নতুন করে আইনের সংস্কার খুব জরুরি।

• বিচার বিভাগ, প্রশাসন থেকে শুরু করে সাংবিধানিক সকল প্রতিষ্ঠান যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেভাবে আইনের সংস্কার।

বাংলাদেশের নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্র জনতা তাদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে এক দানবের সাথে যুদ্ধ করে সুমহান বিজয় অর্জন করেছে। সেই দানবের ত্রাস থেকে শিশুরাও রক্ষা পায়নি। এই মহান ত্যাগ কখনই বিফলে যেতে দেয়া হবে না, আর একটিও প্রাণ যেন এভাবে অকাতরে ঝরে না যায়, তার জন্য যত প্রকার সংস্কার আবশ্যক, তাই করতে হবে।

সর্বশেষে; বিদ্রোহী কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ থেকে একটি পঙ্‌ক্তি উল্লেখ করতে চাই- আমি চির-বিদ্রোহী বীর – বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

রেজওয়ান উর রহমান : প্রবাসী

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চবিতে শহীদদের স্মরণে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৯ সেপ্টেম্বর : নামাজের সময়সূচি

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রুরা ওত পেতে আছে

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ গ্রেপ্তার

‘গণহত্যায় উসকানিদাতা কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে’

জাবিতে গণধোলাইয়ের শিকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু ঘিরে রহস্য

বৈদেশিক ঋণ আবার ছাড়িয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা পদক পেলেন নৌবাহিনীর ২শ’ সদস্য

১০

সিলেট জেলা ও মহানগর যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

১১

জাহাঙ্গীরনগরে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে গণপিটুনি, হাসপাতালে মৃত্যু

১২

ডিপিডিসি কর্মকর্তা-কর্মচারী সমবায় সমিতির নতুন কমিটি

১৩

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হয়ে আলী রীয়াজের ফেসবুক স্ট্যাটাস

১৪

আলজাজিরার অনুসন্ধান / যুক্তরাজ্যে ৩৬০টি বাড়ি কিনেছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী

১৫

রূপপুর পারমাণবিকের প্রথম ইউনিটে ডামি ফুয়েল লোডিং শুরু

১৬

মহেশখালী থেকে অস্ত্রসহ একজনকে আটক করেছে নৌবাহিনী

১৭

নকল সোনার মূর্তি দিয়ে প্রতারণা, গ্রেপ্তার ২

১৮

কুমিল্লায় ট্রাকচাপায় প্রবাসী যুবক নিহত

১৯

ভুল সংশোধনী ও দুঃখ প্রকাশ

২০
X