ইতালির রোমে অবস্থিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দপ্তরে খাদ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক সম্মেলনের উদ্বোধনী সেশনে বিশ্বব্যাপী টেকসই, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জনে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নেরও আহ্বান জানান। ২৪ থেকে ২৬ জুলাই রোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আয়োজিত জাতিসংঘ খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্মেলনে ২০টির বেশি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ ১৬০টির বেশি দেশ থেকে প্রায় দুই হাজারের অধিক প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণ করছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৪ থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত ইতালির রোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ খাদ্যব্যবস্থা সামিট-২ স্টকটেকিং মোমেন্ট শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় মূলত বিশ্ব খাদ্যব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। মূল আয়োজক জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশন (এফএও)। এফএও, ইফাদ, আইএফএডি ও ডব্লিউএফপি-এ প্রতিষ্ঠানগুলো এ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। জাতিসংঘের একটি ফুড সিস্টেম কো-অর্ডিনেশন টিম আছে। সেই টিম আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সম্মেলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হচ্ছে—কীভাবে বিশ্বে খাদ্য সমস্যা বা খাদ্যকে কেন্দ্র করে যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার সে সম্পর্কে একটি বৈশ্বিক ধারণা অর্জন করা যায়। সবার জানা, বিশ্বে পর্যাপ্ত খাদ্য থাকলেও কোনো কোনো অঞ্চলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য ব্যাপক। বিশেষ করে আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চল, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী খাদ্য সমস্যায় বিভিন্নভাবে আক্রান্ত। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
বিশ্বজুড়ে ৬৯০ মিলিয়ন মানুষ এখনও অপুষ্টিতে ভুগছে, প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নেই এবং প্রায় তিন বিলিয়ন মানুষ সুষম খাবার থেকে বঞ্চিত। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট খাদ্য, সার, জ্বালানি ও আর্থিক সংকট বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা ও অপুষ্টির সমস্যাকে ঘনীভূত করেছে। পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহের অক্ষমতার জন্য কৃষি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যই বিশ্বব্যাপী অপুষ্টিজনিত সমস্যার একমাত্র প্রতিবন্ধকতা নয়। এ সংকট নিরসনে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই খাদ্য ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন প্রয়োজন।
টেকসই, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যব্যবস্থা নিশ্চিতে পাঁচ দফা প্রস্তাবে আর্থিক প্রণোদনা, খাদ্য ও সার রপ্তানির বিধি-নিষেধগুলো তুলে নেওয়া, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, প্রযুক্তি বিনিময়, খাদ্য অপচয় রোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী টেকসই, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি প্রস্তাবনা—আধুনিক কৃষিতে বিনিয়োগের জন্য বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন। জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগে ব্লাক সি গ্রেইন ডিলকে চালু রাখার পাশাপাশি খাদ্য ও সার রপ্তানির বিধি-নিষেধগুলো তুলে নেওয়াসহ যে কোনো বাণিজ্য বাধা অপসারণের লক্ষ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত দরকার। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ‘ফুড ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার রূপান্তরের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল রেখে ন্যানো-প্রযুক্তি, বায়ো-ইনফরমেটিক্স ও অত্যাধুনিক কৃষি প্রযুক্তিগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের অপচয় রোধে তরুণ সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যখন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয় তখন ২৬ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি দিয়ে যাত্রা শুরু করে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, ১০ টাকায় কৃষকের জন্য ব্যাংক হিসাব চালুকরণ, শৃঙ্খলাপূর্ণ সার বিতরণ ব্যবস্থাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এরফলে ২০১৩ সালের মধ্যে শুধু খাদ্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণতাই অর্জন করা নয়, বরং খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হতে সক্ষম হয়।
২০০৮-০৯ অর্থছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৩২.৯ মিলিয়ন টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯.৪ মিলিয়ন টনে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন কতটা বেড়েছে তার তুলনামূলক চিত্র থেকে তা ফুটে ওঠে। এফএও-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
২০০৮-০৯ থেকে ২০২০-২১ বছর পর্যন্ত প্রতিবছর দেশে সবজি উৎপাদন গড়ে ৫ শতাংশ এবং ফল উৎপাদন গড়ে ১১ শতাংশের বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ ধান ও মাছ উৎপাদনে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, সবজি উৎপাদনে ৩য় এবং আলু উৎপাদনে ৬ষ্ঠ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান অন্যতম, বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১১.৬৬%। আমাদের কর্মশক্তির প্রায় ৪০.৬% কৃষিতে নিয়োজিত। আমাদের জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ২.৪৩% এবং প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১.৯০%। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকার নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার কৃষি গবেষণা ও উদ্ভাবনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। দেশে বর্তমানে আটটি সরকারি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গত ১৪ বছরে ৬৯০টা উন্নত ও উচ্চফলনশীল শস্যের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা লবণাক্ত-সহিষ্ণু ধান উদ্বাবন করেছেন এবং খরা ও জলমগ্ন-সহিষ্ণু ধান উদ্বাবনের জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
কৃষিকে আধুনিক ও লাভজনক করতে ২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ৮১ হাজার কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। সার, বিদ্যুৎ ও সেচ ইত্যাদির জন্য ১ লাখ ২ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা উন্নয়ন সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে ২৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৃষি ও খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে উৎপাদন হতে শিপমেন্ট পর্যন্ত উত্তম কৃষি চর্চা, হাইজিন প্র্যাকটিসেস, গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসেস অনুসরণ করতে হবে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব স্থাপন করে দেশি পণ্যের মান নিশ্চিত করার দিকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মনোনিবেশ করেছে। আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের কৃষি উদ্ভাবন ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে বর্তমান সরকার অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
মন্তব্য করুন