বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঘনবসতিপূর্ণ এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বাধীনতার পর থেকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে একটি সমৃদ্ধিশীল জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি দেশটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় পৌঁছে দিয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে নানা অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেড় কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী, যাদের অনেকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং উত্তর আমেরিকায় বসবাস করছেন, তাদের পরিশ্রমের ফলস্বরূপ বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। এই রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে সহায়তা করছে। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হচ্ছে। এই রেমিট্যান্স শুধু পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করে না, বরং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করে, যা জাতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে সহায়ক। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশটি উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারে, যা ভবিষ্যতে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে দেশের উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা এবং পানির বণ্টন নিয়ে মতবিরোধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলছে। ফারাক্কা বাঁধ থেকে বিনা নোটিসে পানি ছেড়ে দেওয়ার ফলে উত্তরাঞ্চলে প্রায় প্রতি বছরই বন্যার সৃষ্টি হয়, যা কৃষি এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করছে। এ ধরনের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও, সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান ও সহিংসতা বন্ধে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা আশু প্রয়োজন। যদি সেটা সম্ভব না হয়, তবে দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশের সীমান্তে চীনা প্রাচীরের মতো দেওয়াল এবং ফারাক্কার পাশাপাশি নতুন বাঁধ তৈরি করাই হবে একমাত্র বিকল্প এবং এর জন্য আমরা সব প্রবাসী প্রস্তুত।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং প্রতিরক্ষা চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে প্রতিরক্ষা খাতে উন্নতি সাধন করা গেলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা আরও মজবুত হবে। বিশেষত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সহযোগিতা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে পোশাক শিল্প উল্লেখযোগ্য হলেও অন্যান্য খাতে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। দুর্নীতি ও ভেজালমুক্ত পাট, চামড়া এবং সামুদ্রিক খাবারের মতো খাতে বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করতে এবং নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে দেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোর সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা বাড়াতে এবং নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য শক্তিশালী কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। কূটনৈতিক পর্যায়ে বাণিজ্য চুক্তি, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ তৈরি করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এটি দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করবে এবং বাণিজ্যিক উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভেজাল এবং দুর্নীতি একটি প্রধান বাধা হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় এবং জনগণের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি করে। দুর্নীতি দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি শ্লথ করে। সরকারের উচিত প্রশাসনে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা, ভেজাল এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোও বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এবং নদীভাঙন দেশের কৃষি, অবকাঠামো এবং জনগণের জীবনে প্রভাব ফেলছে। পরিবেশ রক্ষার জন্য সরকারকে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
শিক্ষার্থীরা দেশের ভবিষ্যৎ হিসেবে গণ্য হয়। তাদের সঠিকভাবে প্রস্তুত করা দেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চশিক্ষা এবং কর্মমুখী প্রশিক্ষণ তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাদের জন্য অন-দ্য-জব ট্রেনিং এবং বেতন-ভাতার ব্যবস্থা চালু হলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উৎসাহ এবং উদ্দীপনা আরও বাড়বে। প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন প্রজন্মকে দেশ গঠনের কাজে যুক্ত করতে হবে, যা তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশ গঠনে আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে। প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হলে দেশের উন্নয়নের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে।
সমাপ্তিতে, কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে হবে এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপস্থিতিতে দেশের সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে, যাতে দেশটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি, বহুমুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, ভেজাল ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
রহমান মৃধা: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
মন্তব্য করুন