ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০৪:১৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের জাল ভাঙতে প্রয়োজন ক্ষমতার যথাযথ বণ্টন ও বিকেন্দ্রীকরণ

ডক্টর এবিএম রেজাউল করিম ফকির। ছবি : সংগৃহীত
ডক্টর এবিএম রেজাউল করিম ফকির। ছবি : সংগৃহীত

দেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র (ইংরেজি : Oligarchy)। গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র গড়ে ওঠে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরবিন্যস্ত ক্ষমতার ওপর ভর করে। এই স্তরবিন্যস্ত ক্ষমতার বলয়ে সর্বদাই বংশমর্যাদা, সম্পদ, পারিবারিক ঐতিহ্য, শিক্ষা ও ব্যবসায় অগ্রগামী শ্রেণির নিকট রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে বিত্তশালীদের আধিপত্যে প্রযোজিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এ ধরনের গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যদিও বাংলাদেশ সর্বদাই ধর্মীয় এবং সামরিক গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্তমানে বিদ্যমান গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের জাল দেশের সব আধাআনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে বিস্তৃত রয়েছে, যেখান থেকে বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠী তোলা, চাঁদা, কমিশন ও ঘুষ ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণকে অব্যাহতভাবে শাসন ও শোষণ করে থাকে।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের জাল ভাঙতে ছাত্র-জনতাকে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করতে হয়েছে। এই আন্দোলন থেকে সুফল আনতে সেনাবাহিনী এখন মাঠে নেমেছে এবং তারা আওয়ামী গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের কলকব্জা ভেঙে দিতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সেনাবাহিনী একসময় রাজনীতির মাঠ থেকে উঠে যাবে। তারপর আবার নতুন গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র গড়ে উঠবে না তো?

মনে রাখতে হবে, বিএনপির রাজনৈতিক ক্ষমতাও কিন্তু গড়ে উঠেছে গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের ওপর ভর করে। কাজেই বাংলাদেশ পুনরায় গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের কবলে নিপতিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি বজায় থাকলে, পুনরায় গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র গড়ে উঠতে পারে। তখন সেই গোষ্ঠীতন্ত্রকে ভাঙতে পুনরায় সেনাবাহিনীকে নামতে হতে পারে। আন্দোলন-সংগ্রাম করে সেনাবাহিনী নামানোর মতো বিষয়টি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়। কাজেই গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র যাতে না গড়ে ওঠে, সেজন্য বিদ্যমান এই গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের কলকব্জা স্থায়ীভাবে ভেঙে দেওয়া প্রয়োজন। গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের কলকব্জা স্থায়ীভাবে ভাঙতে হলে রাষ্ট্র ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও বণ্টন এবং প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করা প্রয়োজন।

রাষ্ট্র ক্ষমতার পৃথকীকরণ এমনভাবে করা প্রয়োজন যেন আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক জবাবদিহিতা ও ভারসাম্য নিশ্চিত হয়। নিম্নোল্লেখিত বিষয়গুলো সংবিধানে সংযোজনের মাধ্যমে এই পারস্পরিক জবাবদিহিতা ও ভারসাম্য নিশ্চিত করা যেতে পারে।

ক) উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ এবং আদালতে দোষী সাব্যস্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিষয়টি রাষ্ট্রপতির নিকট ন্যস্তকরণের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতায় আনা যেতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমানে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে এই নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। প্রস্তাবিত বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনের মাধ্যমেও এই নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ রাখা যেতে পারে।

খ) জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে বাতিল এবং রাষ্ট্রপতিকে অভিসংশনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের নিকট প্রদানের মাধ্যমে আইন বিভাগ প্রশাসনিক বিভাগকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে।

গ) আইন বিভাগকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার ক্ষমতা এবং নিয়োজিত বিচারককে অভিসংশনের ক্ষমতা অর্পণের মাধ্যমে আইন বিভাগ বিচার বিভাগকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে।

ঘ) বিচার বিভাগকে আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত কোনো আইন এবং রাষ্ট্রপতি প্রযোজিত কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতাকে পর্যালোচনা করার ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে আইন বিভাগ নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে।

লক্ষ্য যদি থাকে টেকসই রাষ্ট্র সংস্কার, তাহলে রাজনীতি বিজ্ঞানের দর্শন, তত্ত্ব ও সূত্রকে মেনে নিয়ে রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার করতে হবে। প্রস্তাবিত এই রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে সরকারের ধরন হবে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রতিনিধিত্বশীল সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা। এ সরকার ব্যবস্থায় কিছু নির্বাহী ক্ষমতা প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, জেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যানের নিকট আনুপাতিক হারে বণ্টন ও বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে। এই বণ্টন ও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতিরক্ষা বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের দায়িত্ব; স্বায়ত্ত্বশাসিত জেলা সরকারের নিকট পুলিশ প্রশাসন, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সমবায়, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি বিভাগের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব এবং উপজেলা সরকারের নিকট উপজেলাধীন প্রশাসনের ক্ষমতা ন্যস্ত করা যেতে পারে।

আমরা জানি, গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো নির্বাচন পদ্ধতিতে ত্রুটি, যে কারণে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি (শুধু রাজনৈতিক দল মনোনীত প্রার্থী থেকে), জেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যান (যা বর্তমানে কার্যকর আছে) নির্বাচনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অধিকন্তু জাতীয় সংসদে আদর্শবাদী রাজনীতিবিদদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সংসদীয় নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করা প্রয়োজন। আমরা জানি, জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও গণফোরাম ইত্যাদি ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সর্বদাই রাজনৈতিক দর্শন, তত্ত্ব ও সূত্র নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক ও বাহাস চলমান থাকে। কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতির ত্রুটির কারণে জাতীয় সংসদে এসব আদর্শবাদী দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকে না। সেজন্য এক নির্বাচনী অঞ্চল এক প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন পদ্ধতি— এই দ্বিবিধ নির্বাচন পদ্ধতির সমন্বয়ে মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতির প্রচলন করা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত এই মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতির প্রথম পদ্ধতি এবং দ্বিতীয় পদ্ধতিতে যথাক্রমে ৩০০ করে মোট ৬০০ জন জাতীয় সংসদ প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থাকবে।

বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদে ৩০০ ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনের যে ব্যবস্থা আছে, তার বাইরে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ নির্বাচন পদ্ধতিতে (দ্বিতীয় প্রকার) আরও ৩০০ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এই দ্বিতীয় প্রকার নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের পূর্বেই প্রার্থীদের অনুক্রমিক তালিকা প্রকাশ করবে এবং নির্বাচন শেষে ৩০০টি নির্বাচনী অঞ্চলে মোট প্রাপ্ত ভোটের হিস্যা অনুসারে অনুক্রমিক তালিকা থেকে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধি প্রেরণের সুযোগ পাবে।

এই প্রক্রিয়ায় জাতীয় সংসদ গঠিত হলে, জাতীয় সংসদে বড় দলগুলোর সঙ্গে সব ছোট ছোট আদর্শবাদী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধত্ব নিশ্চিত হবে। প্রসঙ্গত, দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকলে, তৃণমূল পর্যায়েও তরুণ নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। প্রস্তাবিত এই নির্বাচন পদ্ধতির প্রবর্তন করা হলে, জনগণের ভোটে যে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে, তা টেকসই জাতীয় নেতৃত্বের জোগান দিবে। নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বের সৃজন ও তা জাতীয় নেতৃত্বে আত্তীকরণের প্রক্রিয়া সৃষ্টি হলে, তা গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র বিকাশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে।

উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট, রাষ্ট্রক্ষমতার যথাযথ পৃথকীকরণ, বণ্টন ও বিকেন্দ্রীকরণ এবং ক্ষমতার বলয়ে নতুন সৃষ্ট নেতৃত্ব আত্তীকরণের সুযোগ থাকলে, বংশপরম্পরানির্ভর গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ চিরতরে রুদ্ধ হবে। ফলে দেশে টেকসই গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটবে।

ডক্টর এবিএম রেজাউল করিম ফকির : অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; অনুবন্ধ অধ্যাপক, সুলতান ইদ্রিস বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব অনুবন্ধ অধ্যাপক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তিতুমীর কলেজে সমন্বয়ক পরিচয়ে রুম দখলের প্রতিবাদে মানববন্ধন

ড. ইউনূসের মেগাফোন কূটনীতিতে ভারতের অস্বস্তি

আওয়ামী নেতার সিনেমায় বুবলী, মুখ খুললেন নায়িকা 

অস্ত্র হাতে সেই লিটন গ্রেপ্তার

কমলার সঙ্গে আর বিতর্কে যাবেন না ট্রাম্প

চিরকুট ও কাফনের কাপড় রেখে প্রাণনাশের হুমকি

অসুস্থ ফুটবলারের চিকিৎসায় পাশে দাঁড়ালেন তারেক রহমান

ভারতে পাচারকালে কুমিল্লা সীমান্তে ফের ইলিশের চালান জব্দ

সুনামগঞ্জ সীমান্তে সাড়ে ১৯ লাখ রুপিসহ যুবক আটক

দাবানলে পাল্টে যাচ্ছে আবহাওয়া, স্যাটেলাইটে ভয়ংকর দৃশ্য

১০

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডিতে নতুন মুখ

১১

শেখ হাসিনার নতুন ফোনালাপ, নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি

১২

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে ৩ জনের মৃত্যু

১৩

৫০ হাজার কর্মীর পরিবার করুণ অবস্থায় আছে : আওয়ামী লীগ

১৪

সাতক্ষীরায় ১১টি সোনার বারসহ চোরাকারবারি আটক

১৫

আসছেন ডোনাল্ড লু / ঢাকাকে বিরক্ত না করতে দিল্লিকে দেবেন বার্তা

১৬

গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক লোডশেডিং, বেকায়দায় শিক্ষার্থীরা

১৭

এখনো স্বৈরাচারী কায়দায় চলছে গণপরিবহন: যাত্রী অধিকার আন্দোলন

১৮

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হাসপাতালে জরুরি বিভাগে দুপক্ষের সংঘর্ষ

১৯

মধ্যপ্রাচ্য থেকে পিছু হটছে মার্কিন রণতরী

২০
X