দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে গোটা বাংলাদেশ। বিক্ষোভ, হত্যা, জখম, সহিংসতা কাটিয়ে নতুন সরকার গঠিত হলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি এখনও। এরই মধ্যে দেশের এক প্রান্তে শুরু হয়েছে বন্যা। ভেসে গেছে বহু ঘরবাড়ি, পরিবারের সম্বল, সবকিছু। অস্বাভাবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত হওয়ায় এ সব ঘটনায় প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের শিকার হচ্ছে মানুষ।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান তখন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলি আর অস্ত্র হাতে হেলমেটধারীদের হামলায় একের পর এক হতাহত হয় নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা। মর্মভেদি সেই সব ভিডিও, ছবি আর বর্ণনা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। গণঅভ্যুত্থান ঘটে যাওয়ার পরও চলেছে সেই অস্ত্রবাজি, খুন, হামলা, লুটতরাজ। দিনের পর দিন এসব দেখে মানসিকভাবে কমবেশি বিপর্যস্ত সব বয়সী মানুষ। মূলত গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে গেছে সবাই।
মানসিক চাপ কতটা গুরুতর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী নাঈম হোসাইন স্বীকার করেন, ন্যায্য দাবি আদায়ের মিছিলে অংশ নিয়ে তিনি যে বর্বরতা ও সহিংসতা দেখেছেন, তাতে তার পুরো লাইফস্টাইলই বদলে গেছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে ঘুমের। মানসিক যে চাপ তৈরি হয়েছে, তাতে তিনি অন্য শিক্ষার্থীদের মতোই ট্রমাটাইজড বলে জানান।
নাঈম নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল-অর্গানাইজেশনাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী। এরপরও মনের গভীরে নেতিবাচক প্রভাব কষ্ট দিচ্ছে তাকে। তিনি এখনো হঠাৎ হঠাৎ শুনতে পান সেই গুলি আর সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ। মাঝে মাঝে চোখের সামনেও ভেসে ওঠে রাস্তায় পড়ে থাকা শিক্ষার্থী এবং পুলিশের গুলির দৃশ্য। বিশেষ করে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় বিগত সরকারের প্রায় ১৬ বছরের নানা কুকীর্তি উঠে আসলে তা দেখার পর মানসিক চাপ বাড়ছে, যা তাকে অনেক বেশি কষ্ট দিচ্ছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছে, যেসব শিশু-কিশোর আহত বা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, জেল খেটেছে এবং যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্যাতন, হত্যা, গুলিবর্ষণের ঘটনা বারবার দেখেছেন, তারাও তীব্র মানসিক আঘাত বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের (পিটিএসডি) ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের সাইক্রিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম সাঈদ এনাম জানান, মনের উপর যে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব বা ক্ষতি, তা শারীরিক আঘাতের চেয়েও গভীর, যা থাকতে পারে বহুদিন। তিনি বলেন, ‘কোনো শিশু যখন প্রত্যক্ষভাবে অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় হত্যাযজ্ঞ, মারামারি, গোলাগুলি দেখছে শিশুদের মনে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। এটা কাম্য নয়। এ ব্যাপারে আমাদের সব সময় সচেতন থাকতে হবে।’
ডা. সাঈদ এনাম জানান, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় এগুলো বেশি বেশি দেখলে অনেক সময় শিশুদের মন ডিসেনসেটাইজড হয়ে যায়। তার মধ্যে একটা ভুলবার্তা যেতে পারে যে, এসব ঘটনা মনে হয় স্বাভাবিক। কোনো একটি কনফ্লিক্ট বা প্রব্লেম দেখা দিলে এর সমাধানস্বরূপ মারামারি, গোলাগুলি, মেরে ফেলা, পুড়িয়ে ফেলা, পুঁতে ফেলা ইত্যাদি হয়তো সমাজের স্বাভাবিক নিয়মকানুন।’
সম্প্রতি এমন বেশ কয়েকজন শিশুরোগী পাওয়ার কথা জানিয়ে ডা. এনাম বলেন, ‘তাদের কারও কারও আগের মানসিক রোগের পুরোনো উপসর্গগুলো ফিরে এসেছে। আবার কারও কারও মানসিক রোগ ছিল না। কিন্তু নতুন করে কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তাদের মা-বাবা জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে তারা ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্টারনেটে মারামারির দৃশ্য দেখেছে, যা হয়তো তারা আগে গেমে বা কার্টুনে দেখত।’
যখন তারা এটা বাস্তবে দেখল, তখন তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। এ সব ক্ষেত্রে আমাদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজনে ওয়াইফাই ইন্টারনেট বন্ধ রাখা যেতে পারে। এ সব ভায়োলেন্ট দৃশ্য কারও কাম্য নয়। এগুলো হয়তো ইনভেস্টিগেশনে লাগতে পারে। কিন্তু তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইকি পাওয়ার জন্য বা সেলিব্রিটি হওয়ার জন্য এগুলো ছড়িয়ে দেওয়া কারও কাম্য নয়। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
ট্রমার লক্ষণগুলো কী কী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস কাউন্সেলিং অ্যান্ড গাইডেন্স সেন্টারের উপ-পরিচালক ও মনোবিজ্ঞানী শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জী জানান, প্রাথমিকভাবে ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা লাভের তিন মাসের মধ্যে কারও কারও মধ্যে পিটিএসডি বা ট্রমাটিক লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। কারও কারও মধ্যে অনেক পরেও বা পরিণত বয়সেও তা দেখা দিতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে ট্রমাটিক অভিজ্ঞতার ঘটনাস্থল এড়ানোর চেষ্টা করা, ঘটনার বিশেষ আঙ্গিক মনে করতে না পারা, ফ্ল্যাশব্যাক করা, আবারও ঘটার আতঙ্কে থাকা, এমনকি তার চোখের সামনে পুরনো স্মৃতি ভেসেও উঠতে পারে। এ অবস্থায় পৃথিবী থেকে সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে পারে, নিজেকে দায়ী করতে পারে; আত্মহত্যার চিন্তাও আসতে পারে; মেজাজ খিটখিয়ে হয়ে উঠতে পারে; মুডের সমস্যা দেখা দিতে পারে; ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটি বাড়তে পারে।
ডা. সাঈদ এনামের ভাষ্যমতে, ‘শিশুদের মধ্যে সারাক্ষণ ভয় কাজ করতে পারে। সে এই দৃশ্যগুলো বারবার মনে আনতে পারে এবং এটা ভেবে ভেবে সে হয়তো বাইরে যাওয়া কমিয়ে দেবে; হয়তো কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যাবে না; স্কুল-কলেজে যাবে না; তার পড়াশোনায় অমনোযোগিতা তৈরি হতে পারে; সে হয়তো ঠিকমতো পড়তে পারবে না, পড়া ভুলে যাবে; ঘুমে ডিস্টার্ব হতে পারে, ঘুমের মধ্যে চিৎকার করতে পারে; দুঃস্বপ্ন দেখতে পারে। আবার কোনো শিশুর মানসিক রোগ থেকে থাকলে সেই উপসর্গের তীব্রতা বেড়ে যেতে পারে।’
সমাধানের পথ কী
লাইফস্প্রিং লিমিটেডের মনোবিজ্ঞানী মারজাহান আক্তার জানান, অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান না হলে এবং সঠিকভাবে ট্রমা ম্যানেজমেন্ট করা না গেলে একটা অসুস্থ ছাত্রসমাজ তৈরির ঝুঁকি বাড়বে। তাদের মধ্যে নানা রকম মানসিক সমস্যা দেখা দেবে। এর ফলে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়বে। অপরাধও বাড়তে থাকবে। তাই এগুলো যাতে না ঘটে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
মনোবিজ্ঞানী শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জীর মতে, ট্রমা ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে সেলফ কেয়ার খুবই জরুরি। প্রথমত, তাদের একটি নিরাপদ জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। সোশ্যাল সাপোর্ট ভীষণভাবে দরকার। বিশ্বস্ত মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে হবে। কারণ ট্রমা যাদের হয়, তারা মানুষকে বিশ্বাস করতে পারেন না। মেডিটেশন, এক্সারসাইজ, রিল্যাক্সেশন, মাইন্ডফুলনেস চর্চা করতে হবে। শান্তি অনুভব করেন, এমন কাজ করা, মনোযোগ ঘুরিয়ে রাখা, টিভি, মোবাইল বা বিভিন্ন গণমাধ্যম সরিয়ে রাখতে পারেন। মনে মনে বলতে পারেন, এই যে অভিজ্ঞতা, তা সারাজীবন থাকবে না, এটা একদিন ঠিক হয়ে যাবে। খুব বেশি সমস্যা মনে হলে কাউন্সেলিং সাপোর্ট নিতে পারেন। কারও মধ্যে সেলফ হার্মের চিন্তা এলে মেডিকেশন লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে পারেন। নিজের কাজ নিজে করতে পারেন, গান শুনতে পারেন, কোথা থেকে ঘুরে আসতে পারেন। প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। কারণ ট্রমা ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে শেয়ারিং গুরুত্বপূর্ণ।
ডা. সাঈদ এনাম জানান, ‘চিকিৎসা হিসেবে এসব বাচ্চাকে অনেক সময় কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি বা টক থেরাপি দেওয়া হয়‘।
শেষ কথা
শিক্ষার্থীদের নিজেদের কাছে তো বটেই, অনেকের কাছেই গণঅভ্যুত্থানে আত্মত্যাগ দেশের প্রয়োজনে বীরোচিত বলে বিবেচিত। বন্ধু, সহপাঠীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েনি এই সব তরুণ। দুঃসহ কঠিন অভিজ্ঞতার পরও তারা নবউদ্যোমে সড়কে নামেন শৃঙ্খলা ফেরাতে। দেয়ালে গ্রাফিতিতে লেখেন নিজেদের কথন। যা ঝুঁকি কমাতে দারুণ সহায়ক বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত।
জেনজেড বলে অভিহিত এই তরুণ প্রজন্ম বেশ আত্মমর্যাদাশীল। তারা যা করে দেখিয়েছেন, তা তাদের আগের প্রজন্মের অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। এভাবেই তারা যদি নিজেরাই নিজেদের মনের যত্ন নেন, তবে মানসিক সমস্যা থেকেও তারা পরিত্রাণ পাবেন দ্রুত।
লেখক: সিনিয়র নিউজ এডিটর, কালবেলা অনলাইন
মন্তব্য করুন