রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিষয় আপাতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে— দেশে সরকার ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতি সঠিক আছে; তবে নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও সঠিক নয় এবং এই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে প্রয়োজন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। উল্লেখ্য যে, ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে গণ-আন্দোলনের মুখে সামরিক সরকার পদত্যাগ করলে, নির্বাচন পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই নির্বাচনকালীন তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় নির্বাচন শেষে আওয়ামীলীগ সরকার বাতিল করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থা এখনও চালু রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করার উদ্দেশ্য ছিল সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থায় প্রকৃত সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। কারণ এই সরকার ব্যবস্থায় গত কয়েক দশক ধরে যে দু’জন ব্যক্তি ঘুরেফিরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতা উৎসারিত হয়েছে পরিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য থেকে। তাঁদের হাতেই মূলত সরকার প্রধান, দলীয় প্রধান ও রাষ্ট্র প্রধানের ক্ষমতা ন্যস্ত থেকেছে বা আছে। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী হয়েও তাঁরা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের রাষ্ট্রপতির মতো শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বা হন। অধিকন্তু, প্রধানমন্ত্রীর এই কর্তৃত্ববাদী ভূমিকা বিদ্যমান থাকায় পরোক্ষভাবে জাতীয় সংসদকেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুগত থাকতে হয়েছে বা হয়। অন্যদিকে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রচলনের উদ্দেশ্য ছিল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা। কিন্তু ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অনুষ্ঠিত সমস্ত জাতীয় নির্বাচন সমাপনের পর, পরাজিত রাজনৈতিক দলগুলো সর্বদা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তা সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন পুনঃ:প্রবর্তনের রাজনৈতিক প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এই ব্যবস্থা পুনঃ:প্রবর্তনের মাধ্যমে হয়ত আপাতভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সচল হবে। কিন্তু এর মাধ্যমে আদতে টেকসই রাজনৈতিক সমাধান ঘটবে না। কারণ, এই ব্যবস্থাটির মাধ্যমে মূলত: “সব অথবা কিছুই নয়” ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। এর প্রধান কারণ হলো নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ ও প্রতিষ্ঠান সচল থাকে। তাছাড়া সাধারণ ভোটারদের নির্বাচনী আচরণকে অর্থ, অস্ত্র ও ক্ষমতা দ্বারা বিভ্রান্ত করার মতো ব্যবস্থাগুলো সচল থাকে। অধিকন্তু নির্বাচন প্রকৌশলের মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার নানান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা সচল থাকে। এভাবে নির্বাচনী আচরণ ও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার মতো যে ব্যবস্থাগুলো বিদ্যমান রয়েছে, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত স্তরবিন্যস্ত অনেকগুলো স্বার্থান্বেষী মহল। নির্বাচনকালীন সময়ে এই স্তরবিন্যস্ত স্বার্থান্বেষী মহলকে যারা কাজে লাগাতে পারে, তাঁদেরকেই মূলত: রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, এই স্তরবিন্যস্ত স্বার্থান্বেষী মহলকে নির্বাচনে কাজে লাগাতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু এই কোটি কোটি টাকা ব্যয় করার মতো অর্থ-বিত্ত সাধারণ রাজনৈতিক নেতাদের থাকে না। যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে সফলতা নিশ্চিত করতে বিত্তশালী প্রার্থীদেরকে মনোনয়ন দিয়ে থাকে।
উপরোল্লিখিত কারণে বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোতে আদর্শশুন্য বিত্তশালীদের প্রাধান্য বিস্তৃত হয়েছে। রাজনীতি থেকে ক্রমশ রাজনৈতিক আদর্শের বিদায় হয়েছে। ফলশ্রুতিতে সমাজতন্ত্র, ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী রাজনৈতিক নেতাগণও বিভিন্ন সময় আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী ইত্যাদি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোতে যোগ দিয়েছেন। এই প্র্রক্রিয়া কয়েক দশক ধরে চলতে থাকায়, দেশে বিত্তশালীদের প্রাধান্যে দ্বি-দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। যে কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ সম্পন্ন, বিবিধ পেশা সম্পন্ন এবং আঞ্চলিকতাবোধ সম্পন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতিতে তথা আইন সভায় বা সরকারে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ নি:শেষ হয়ে গেছে। অথচ সরকার ব্যবস্থায় মতাদর্শ, ধর্ম, বিত্ত ও শ্রেণি ইত্যাদি নির্বিশেষে দেশের সমস্ত জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত না হলে, সমাজে তাদের প্রান্তিকীকরণ ঘটে। রাজনীতি বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী সমাজে শক্তিশালী কোনও গোষ্ঠীর রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিকীকরণ ঘটতে থাকলে, তা পরিণামে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশ পায় অথবা রাজনীতিতে বিদেশি বা দেশী অপশক্তি ও স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বস্তুত: বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতে একাধিকবার এরূপ গণঅভ্যুত্থান বা ষড়যন্ত্র সংঘটনের নজির রয়েছে এবং এখনও এরূপ ঝুঁকি বিদ্যমান রয়েছে। অথচ, বিত্তশালীদের প্রাধান্যে প্রতিষ্ঠিত দ্বি-দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এরূপ গণঅভ্যুত্থান বা ষড়যন্ত্র সংঘটনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা দেশে রাজনৈতিক মহাসংকট সৃষ্টি করতে পারে।
দেশের উক্ত সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক মহাসংকটকে এড়াতে হলে, সরকার ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতি— এই উভয়রেই সংস্কার করা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত এই সরকার ব্যবস্থা হবে রাষ্ট্রপতি শাসিত আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থা। নিম্নে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ প্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
১) রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি: বর্তমানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকলেও, এ দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর পদটি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রধানের মতো কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে। সেজন্য প্রত্যক্ষ গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান চালু করা প্রয়োজন। তবে এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ব্যবস্থাও গতানুগতিক পদ্ধতির বদলে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আদলে ২ ধাপ বিশিষ্ট নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন, যেখানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থিতার কিছু শর্ত থাকবে। এই শর্ত হলো— যে সব রাজনৈতিক দলের এককভাবে বা একাধিক দলের সম্মিলিতভাবে জাতীয় নির্বাচনে ২০ ভাগ ভোট প্রাপ্তির পূর্ব ইতিহাস রয়েছে, কেবলমাত্র সে সব রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে। কোনও নির্দিষ্ট প্রার্থী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনের জন্য সর্বমোট প্রদত্ত ভোটের কমপক্ষে শতকরা ৩০ ভাগ ভোট পেতে হবে। তবে কোনও প্রার্থী এককভাবে যদি শতকরা ৩০ ভাগ ভোট না পান, তা্হলে ১ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট প্রাপ্ত প্রথম দু’জন প্রার্থীর প্রার্থীতায় দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ থাকবে। এই দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পাবেন, তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবেন।
২) সংসদীয় প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি: বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিত্তশালী নিয়ন্ত্রিত দ্বি-দলীয় সংসদীয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এক নির্বাচনী অঞ্চল এক প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি (প্রথম পদ্ধতি) এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন পদ্ধতি (দ্বিতীয় পদ্ধতি)— এই দ্বিবিধ নির্বাচন পদ্ধতির সমন্বয়ে মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতির প্রচলন করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জাপানে এই মিশ্র পদ্ধতির জাতীয় সংসদ নির্বাচন চালুর ফলে সব মতাদর্শের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে।। প্রস্তাবিত এই মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতির প্রথম পদ্ধতি এবং দ্বিতীয় পদ্ধতিতে যথাক্রমে ৩০০জন করে মোট ৬০০ জন জাতীয় সংসদ প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থাকবে। প্রথম প্রকার নির্বাচন পদ্ধতিতে মূলত: একটি নির্বাচনী অঞ্চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা দল নিরপেক্ষ প্রার্থীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থাকবে, যেখানে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত প্রার্থী নির্দিষ্ট নির্বাচনী অঞ্চল থেকে জাতীয় সংসদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবেন। প্রথম প্রকার নির্বাচন পদ্ধতি মূলত: বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতিরই অনুরকণ বিশেষ, তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন প্রবর্তন করা হলে, তা গতানুগতিক নির্বাচন পদ্ধতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় প্রকার নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের পূর্বেই প্রার্থীদের অনুক্রমিক তালিকা প্রকাশ করবে এবং নির্বাচন শেষে, ৩০০টি নির্বাচনী অঞ্চলে মোট প্রাপ্ত ভোটের হিস্যা অনুসারে অনুক্রমিক তালিকা থেকে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধি প্রেরণের সুযোগ পাবে। এই মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতিতে বড় ও প্রান্তিক উভয় প্রকার রাজনৈতিক দলেরই জাতীয় সংসদে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা অনুসারে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। নিম্নে বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরা হলো:
প্রথমত: মিশ্র পদ্ধতিতে বিগত (২০০১ ও ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ) কয়েকটি নির্বাচনে ভোটের হিস্যা অনুসারে বড় রাজনৈতিক দলের আসন প্রাপ্যতার হিসাব দেওয়া হলো। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামীলীগ (৪০.১৩% ভোট, ৬২টি আসন) ও বিএনপি (৪০.৯৭% ভোট, ১৯৩টি আসন) প্রায় সমান হারে ভোট পেয়েও, বিদ্যমান পদ্ধতির কারণে প্রাপ্ত ভোটের হিস্যা অনুযায়ী দল দু’টির আনুপাতিক হারে আসন প্রাপ্তি ঘটেনি। কিন্তু মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির জাতীয় সংসদে আসন সংখ্যা দাঁড়াতো যথাক্রমে সর্বমোট ৬২+১২০=১৮২টি ও ১৯৩+১২৩=৩১৬টি। অন্যদিকে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ (৪৮.৪০% ভোট, ২৩০ আসন) এর তুলনায় বিএনপি (৩২.৫০% ভোট, ৩০ আসন) উল্লেখযোগ্য হারে ভোট লাভ করেও, বিএনপি খুব অল্প সংখ্যক আসন (৩০টি) লাভ করেছিলো। কিন্তু মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগ ও বিএনপির জাতীয় সংসদে আসন সংখ্যা দাঁড়াতো যথাক্রমে সর্বমোট ২৩০+১৪৫=৩৭৫টি ও ৩০+৯৭=১২৭টি। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, প্রস্তাবিত মিশ্র পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় সংসদে রাজনৈতিক দলসমূহের যৌক্তিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত: মিশ্র পদ্ধতিতে বিগত (১৯৭৩ ও ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ) কয়েকটি নির্বাচনে ভোটের হিস্যা অনুসারে কয়েকটি প্রান্তিক রাজনৈতিক দলের আসন প্রাপ্যতার হিসাব দেওয়া হলো। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রচলিত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন উল্লেখযোগ্য দল ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি- মোজাফফর (৮.৩২%), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (৬.৫২%), ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি-ভাসানী (৫.৩২%) দেশব্যাপী যথেষ্ট সংখ্যক ভোট লাভ করে, একমাত্র জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ১টি আসন ছাড়া আর কোনো দল কোনও আসন লাভ করেনি। অথচ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন পদ্ধতি (দ্বিতীয় পদ্ধতি) চালু থাকলে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে আসন প্রাপ্য ছিল যথাক্রমে ২৫টি, ২০টি ও ১৬টি। অনুরূপভাবে, ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে জাকের পার্টি (১.২২%), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-রব (০.৭৯%), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-ইনু (০.৫০%), বাংলাদেশ জনতা দল (০.৩৫%) ও ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ অব বাংলাদেশ (০.৩২%) উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়েও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি আসনও লাভ করেনি। অথচ প্রস্তাবিত আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, হিস্যা অনুসারে এই দলগুলো জাতীয় সংসদে যথাক্রমে ৭টি, ৩টি, ১টি, ১টি ও ১টি আসন লাভ করতো। উপস্থাপিত পরিসংখ্যান থেকে লক্ষণীয় যে, কোনও রাজনৈতিক দল প্রথম পদ্ধতিতে দেশের কোনও একটি সংসদীয় আসনে জয় লাভ না করেও, মিশ্র পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধি প্রেরণের সুযোগ পাবে।
সবশেষে বলা যায় যে, উক্ত উপায়ে দেশে সরকার ব্যবস্থা ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করা হলে দেশে স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। একদিকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ৫ বছরের জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করবেন বিধায়, তাঁর মাধ্যমে পরিচালিত রাষ্ট্রের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া গতিশীল হবে, যা কার্যত দেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক হবে। তাছাড়া এই উপায়ে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি দেশে স্থিতিশীল সরকারের রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করবে। অন্যদিকে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন পদ্ধতিতে বিভিন্ন মতাদর্শ, পেশা ও শ্রেণি নির্বিশেষে উল্লেখযোগ্য সব রাজনৈতিক দলের জাতীয় সংসদে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে বিধায় রাজনৈতিক পরিক্রমায় ক্রমান্বয়ে জাতীয় সংসদে প্রান্তিক অথচ আদর্শবাদী দলগুলোর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ফলশ্রুতিতে দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উত্তরোত্তর গতিশীল হবে।
উপরে বর্ণিত উপায়ে সরকার ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করা হলেও, দেশে পারিবারিক উত্তরাধিকার ভিত্তিক নেতৃত্বের বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠবে এবং বিত্তশালী প্রাধান্যে প্রতিষ্ঠিত দ্বি-দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান হবে। ফলশ্রুতিতে, রাজনৈতিক অঙ্গনে মৃতপ্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের পুনরুজ্জীবন ঘটবে এবং সমাজতন্ত্র, ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি নানাবিধ রাজনৈতিক দর্শনের চর্চা বৃদ্ধি পাবে। আদর্শবাদী রাজনৈতিক দলসমূহের পুনরুজ্জীবন দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক আবহ বয়ে আনবে। ফলশ্রুতিতে দেশ ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে রক্ষা পাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত জনপ্রতিনিধিত্বশীল টেকসই গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কায়েম হবে। তবে এর জন্য সংবিধানের ৬৫(২) ও (৩) নং অনুচ্ছেদ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর সংশোধনী আনয়নের প্রয়োজন হবে।
ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; অনুবন্ধ অধ্যাপক, সুলতান ইদ্রিস বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব অনুবন্ধ অধ্যাপক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট
মন্তব্য করুন