রহমান মৃধা
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৪১ পিএম
আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৪৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

দুর্নীতির জালে বন্দি সমাজ : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি দীর্ঘ ইতিহাসের ফল, যার শেকড় মুঘল আমল থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই দীর্ঘ সময় ধরে দুর্নীতি আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে, এবং স্বাধীনতার পরেও এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। প্রশাসনের বাহ্যিক পরিবর্তন, যেমন পুলিশের পোশাক পরিবর্তন, প্রশাসনিক রদবদল বা কর্মকর্তাদের ওএসডি করা, কেবল বাহ্যিক পরিবর্তন এনে দেয়। কিন্তু দুর্নীতির মূলে আঘাত না করলে, অর্থাৎ প্রশাসনিক দুর্বলতা, সামাজিক নৈতিকতা এবং আর্থিক অসামঞ্জস্যের কারণগুলো চিহ্নিত করে সমাধান না করা পর্যন্ত, এসব পরিবর্তন কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এনে দেবে না।

আমরা প্রায়ই নৈতিকতা, মানবতা এবং ব্যক্তিগত পরিবর্তনের কথা বলি, কিন্তু বাস্তবতা হলো—অধিকাংশ মানুষ নিজে থেকে পরিবর্তিত হতে অনিচ্ছুক। এই কারণে দুর্নীতি, স্বার্থপরতা এবং অসততার বিস্তার দিন দিন বাড়ছে।

আমাদের সমাজে একটি বড় সমস্যা হলো, উসকানি দেওয়ার প্রবণতা। কোনো সমস্যার সমাধান খোঁজার বদলে, আমরা প্রায়শই অন্যকে দোষারোপ করি এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ করি। এই উসকানি শুধু সমাজে নয়, পরিবারেও লক্ষণীয়। ছোটখাটো বিষয়ে দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে বড় পরিসরে রাজনৈতিক ও সামাজিক উসকানি পর্যন্ত, সবকিছুতেই আমরা পাকা। যেমন, রাজনীতিতে এক দলের আরোপিত অভিযোগ আরেক দলের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যা আরও বিশৃঙ্খলা ও সংঘাত সৃষ্টি করে। পরিবারেও, ছোট ছোট বিষয়কে কেন্দ্র করে সদস্যদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে, যা সমাজের বৃহত্তর সমস্যার প্রতিফলন। এতে সমস্যা সমাধানের চেয়ে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়, যা সমাজকে আরও পেছনে ঠেলে দেয়। উসকানি এবং দোষারোপের এই সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে।

একটি দেশ কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়; এটি সেই দেশের জনগণের সম্পদ। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে আসে এবং যদি জনগণ কাউকে না চায়, তখন সেই দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়াই নিয়ম। উদাহরণস্বরূপ, সুইজারল্যান্ডে জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়, যা রাজনৈতিক সচেতনতা এবং দায়িত্ববোধকে উৎসাহিত করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে এই প্রবণতা দেখা যায় না।

আমাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দেখা যায়, অনেক নেতাই মরতে রাজি কিন্তু দায়িত্ব ছাড়তে নয়। তাদের আচরণ যেন বানরের চরিত্রের মতো—বানর যখন কোনো বক্সের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কলা ধরে, তখন হাত সহজেই ঢুকে যায়, কিন্তু কলা ধরার পর হাতটি মুঠো করলে সে বক্স থেকে হাত বের করতে পারে না। ঠিক এভাবেই, আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতা তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে চান, কিন্তু সেই ক্ষমতা যখন তাদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে যায়, তখনও তারা তা ছাড়তে নারাজ। যুগ যুগ ধরে আমরা এই ধরনের আচরণ দেখে আসছি, এবং দুর্ভাগ্যবশত, এই থেকে আমরা কোনো শিক্ষা নিচ্ছি না।

যদি আমরা আমাদের সমাজে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে চাই, তবে নৈতিকতার চর্চা শুধুমাত্র একটি ঐচ্ছিক পন্থা হতে পারে না। আমাদের দরকার কঠোর, সিস্টেমভিত্তিক নিয়মকানুনের কার্যকর বাস্তবায়ন। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেনের মতো দেশগুলো ক্যাশলেস অর্থনীতির দিকে এগিয়েছে, যা দুর্নীতি দমনে একটি কার্যকরী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশেও ক্যাশ টাকার লেনদেন নিয়ন্ত্রণে আনা এবং সমস্ত আর্থিক কার্যক্রম ডিজিটালাইজড করার মাধ্যমে দুর্নীতি কমানো সম্ভব।

ক্যাশলেস অর্থনীতি চালু করা হলে প্রতিটি লেনদেন নজরদারির আওতায় আনা সম্ভব হয়। এতে দুর্নীতি করার সুযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুরের মতো দেশে কঠোর আইনি ব্যবস্থা এবং টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হয়েছে। দুর্নীতির মাত্রা কমানোর পাশাপাশি, এটি সমাজে স্বচ্ছতা এবং সচ্চরিত্রের গুরুত্বও বাড়াবে।

যদি আমরা এমন একটি সিস্টেম তৈরি করতে পারি যেখানে দুর্নীতি করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়, তাহলে মানুষ বাধ্য হবে সৎ পথে চলতে। ক্যাশলেস অর্থনীতি, কঠোর নজরদারি, এবং দুর্নীতি বিরোধী সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজকে একটি সৎ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার দিকে নিয়ে যেতে পারি।

কিন্তু সিস্টেমভিত্তিক কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি আমাদের নিজেদেরও পরিবর্তন করতে হবে। প্রশাসনের রদবদল বা বাহ্যিক পরিবর্তন করেই আমরা সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে পারব না। আমাদের প্রত্যেককে নিজের দায়িত্ব নিতে হবে এবং সৎ হতে হবে। ব্যক্তিগত পরিবর্তনের মাধ্যমেই সমাজের প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব।

নতুন একটি বাংলাদেশ গড়তে আমাদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেতন হতে হবে। নিজের অবস্থান থেকে শতভাগ দায়িত্ব পালন এবং সেবা দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। যদি আমরা প্রত্যেকে আমাদের কাজ ও দায়িত্বের প্রতি শতভাগ নিষ্ঠা ও সময় দিই, তবে দেশকে দুর্নীতি ও অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।

আমাদের নিজেদের সচেতনতার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছে একটি উন্নত ও সৎ বাংলাদেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব দিয়ে যেতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, সমাজ ও দেশের পরিবর্তন আসবে তখনই, যখন আমরা নিজেরাই পরিবর্তিত হবো। নতুন প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষা ও নৈতিকতার মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারে।

আমরা শুধু বাহ্যিক পরিবর্তন এবং প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। আমাদের দরকার সিস্টেমভিত্তিক কঠোর নিয়মকানুন, যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। ক্যাশলেস অর্থনীতি এবং কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা চালু করে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যক্তিগত পরিবর্তন। একমাত্র নিজেকে পরিবর্তনের মাধ্যমেই আমরা সমাজকে পরিবর্তিত করতে পারি।

এ যুগে প্রযুক্তি যেমন এআই চিন্তা ও তথ্য প্রক্রিয়া করতে সক্ষম, কিন্তু এর মধ্যে মানবিক গুণাবলীর অভাব রয়েছে—যেমন, সহমর্মিতা, অনুভূতি, এবং নৈতিকতার বিশ্লেষণ। তবুও, সেই এআই আমাদের আদর্শ ও নৈতিকতার ভিত্তিতে সঠিক তথ্য ও উপদেশ দিয়ে চলেছে।

অথচ আমরা মানুষ হয়েও যদি মানবিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলি, তবে আমাদের সমাজের অবক্ষয় এবং অমানবিকতা কেবল বাড়তেই থাকবে। কিন্তু আশার কথা হলো, আমাদের নিজেদের মধ্যে সেই পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রয়েছে, যা সিস্টেম বা প্রযুক্তি দ্বারা সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়।

আমাদের নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি মানবিক, সৎ, ও উন্নত সমাজ গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিটি ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত। আলোচনার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে এই মানবিক মূল্যবোধগুলোকে নতুনভাবে জাগ্রত করতে হবে, যাতে আমরা প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারি। আমাদের প্রত্যাশা এখন নতুন প্রজন্ম এই দায়িত্ব নেবে এবং সোনার বাংলাকে সৎ, স্বচ্ছ এবং উন্নত একটি জাতি হিসেবে গড়ে তুলবে। এটাই আমাদের নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

রহমান মৃধা: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকা দক্ষিণ-উত্তরসহ ১২ সিটির কাউন্সিলরদের অপসারণ

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১২৫ বস্তা চাল উদ্ধার, আটক ২

সিলেটে হোটেল ব্যবসায় ধস

জৌলুস হারাচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও পরিচালকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

অটোরিকশার ধাক্কায় প্রাণ গেল ইউপি সদস্যের

নোবিপ্রবি ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি মুবদী, সম্পাদক রিন্তি

ড. ইউনূসের সঙ্গে ব্লিঙ্কেনের সাক্ষাৎ / পারস্পরিক সহযোগিতা আরও গভীর করতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র

রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গৃহবধূকে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণ’

সীতাকুণ্ডে সড়ক দুর্ঘটনা নিহত ২

১০

চটপটিতে টক বেশি দেওয়াকে কেন্দ্র করে মারধর, নিহত ১

১১

ডিএনসির অভিযানে ৭১ শীর্ষ মাদককারবারিসহ গ্রেপ্তার ৮৪৬

১২

আ.লীগ কর্মীর হাঁসুয়ার কোপে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নিহত

১৩

২০ বস্তা চাল রেখে পালালেন ভ্যানচালক

১৪

‘মানুষের মুক্তির জন্য কোরআনের আইনের বিকল্প নেই’

১৫

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধানকে ইউরোপ প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্মারকলিপি

১৬

পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটি থেকে দুই সদস্য অপসারণ ও ইসলামী স্কলার অন্তর্ভুক্তির দাবি

১৭

মাগুরায় আ.লীগ-বিএনপি সংঘর্ষে আহত ১৫

১৮

গৌরীপুরে দুর্গাপুজার প্রতিমা ভাঙচুর, আটক ১

১৯

টাকার জন্য সন্তানকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখলেন মা!

২০
X