রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে নানান আলাপ হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলো। এখন সবাই চাইছে রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে যাতে ভবিষ্যতে কোনো স্বৈরাচারী তৈরি না হয়। কিন্তু যে শিক্ষার্থীরা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটালো, তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে থাকা স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পতন ঘটাতে পেরেছে কি? উপাচার্যের পদত্যাগই কিন্তু স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পতন না, এটা মাথায় রাখতে হবে আমাদের। স্বৈরাচারী ব্যবস্থার মূলোৎপাটন জরুরি এই মুহূর্তে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত এক ধরনের স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে প্রতিটা বিভাগে অসংখ্য মাঝারি ও ছোট স্বৈরাচারী তৈরি হয়েছে গত কয়েক দশকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন একটা প্রতিষ্ঠান যখন স্বৈরাচারী তৈরি করে, তখন আপনি দেশে ভালো রাজনৈতিক চর্চা দেখতে পাবেন কিভাবে? অথবা উল্টোভাবেও বলা যায়। রাষ্ট্র নিজেই যখন স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তখন হয়ে ওঠে সেই স্বৈরাচারী ব্যবস্থার দোসর। তাই রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট ও মাঝারি স্বৈরাচারী তৈরি করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলো হচ্ছে স্বৈরাচার তৈরির প্রথম পর্যায়। পৃথিবীর অন্য কোথাও আপনি দেখবেন না যে শিক্ষকদের কে কবে নিয়োগ পেয়েছে তার ভিত্তিতে সিনিয়র শিক্ষক-জুনিয়র শিক্ষক ইত্যাদি টাইটেল নির্ধারণ হয় এবং তার ফলাফল দেখা যায় অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন বিষয়ে মতামত গ্রহণের সময়। এটা এতোটাই বৈষম্যমূলক যে একটা উদ্ভট ধরনের ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরি হয় প্রতিটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা বিভাগে।
একজন মানুষ শিক্ষকতায় আসেন তার অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা দিয়ে। অথচ বাংলাদেশে দেখা যায় অ্যাকাডেমিক যে-কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় 'সিনিয়র' শিক্ষকের মতের বাইরে সচরাচর কিছু বলা যায় না! 'জুনিয়র' শিক্ষকদের সারাক্ষণ কোণঠাসা করে রাখা হয়। শিক্ষকতা পেশার ক্ষেত্রেও এরকম অদ্ভুত ক্ষমতা-সম্পর্ক থাকতে পারে তা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না দেখলে বুঝাই যাবে না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাই কিন্তু গণতন্ত্রের কথা বলেন প্রতিনিয়ত, শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক হতে শেখান।
এভাবে কতিপয় শিক্ষক তাদের শিক্ষকতা জীবনের পুরোটাই স্বৈরাচার হিসেবে বিভাগে দাপটের সাথে বিরাজ করেন। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারের পতন ঘটানো শিক্ষার্থীও কথা বলতে ভয় পায়। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকুরি যায় না, এই ধরনের স্বৈরাচারের পতন হয় না! এই স্বৈরাচারেরা ঠিকমতো ক্লাস নেবেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইচ্ছে হলে যাবেন-যাবেন না, সময়মত খাতা দেখবেন না, নম্বর নিয়ে গড়িমসি করবেন কিংবা প্রয়োজনে দুর্নীতিও করবেন, তাদের চাটুকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন, বিভাগের অর্থ নিয়ে যাচ্ছেতাই সিদ্ধান্ত নেবেন, এমনকি এক ধরনের ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করে শিক্ষার্থীদের সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে রাখবেন। শুধু শিক্ষার্থীই না, বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকদেরও এই স্বৈরাচারী শিক্ষকরা সারাক্ষণ ত্রাসের মধ্যে রাখেন। ত্রাস তৈরির পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থীও কিন্তু এসব স্বৈরাচারীর দোসর হিসেবে কাজ করেন। তাদেরও জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা উচিৎ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছোট স্বৈরাচারীদের অনেকে সমর্থন যোগান 'উপাচার্য' নামক মাঝারি স্বৈরাচারীদের। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ হয় কিভাবে? কারা উপাচার্য হওয়ার জন্য বিবেচিত হন? তাদের কি কি যোগ্যতা লাগে উপাচার্য হতে? কেন উপাচার্যদের এমপি-মন্ত্রীদের মতন সারাক্ষণ মিডিয়া ফুটেজের প্রয়োজন হয়? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটে ঢুকলে প্রথমেই কেন উপাচার্য ও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ছবি সবার আগে আসে? উপাচার্যের আশেপাশে থাকেন কোন ধরনের শিক্ষকেরা? অ্যাকাডেমিক কাজে সিদ্ধহস্ত শিক্ষকদের কেন মনে করা হয় তারা উপাচার্য হওয়ার যোগ্য না? এই ন্যারেটিভ কে/কারা তৈরি করে? এই প্রশ্নগুলো তোলা খুব জরুরি। এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-বিতর্ক হতে হবে। কিন্তু এটি মানতেই হবে যে, উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে হবে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে, দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নয়।
শুধু কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বাকি পদগুলোতে কি হবে? প্রো-ভিসি, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার, সিন্ডিকেট/রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য, প্রক্টর, শিক্ষার্থী উপদেষ্টা - এসব পদে কিভাবে শিক্ষকরা যুক্ত হবেন? এই পদগুলোতে কোন শিক্ষকরা থাকবেন তা কে/কারা নির্ধারণ করছেন এবং কেন করছেন? কেন চাটুকারিতা করতে পারা শিক্ষকদের এসব পদে বেশি দেখা যায়? যোগ্য শিক্ষকরা কেন সচরাচর এসব পদের জন্য বিবেচিত হন না?
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দুটো অংশীদার হলো শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সবসময়ই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বঞ্চিত করা হয়। এই সমস্যা সমাধানে 'শিক্ষার্থী সংসদ' চালু করার এটাই মোক্ষম সময়। শিক্ষার্থী সংসদ হতে পারে সেই পদক্ষেপ যা দলীয় রাজনীতির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সকল শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে তাদের প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের এই পর্যায়ে যার যার বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার কাজে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। তা নাহলে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন অচিরেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। "স্বৈরাচার নিপাত যাক" শুধু রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ পর্যায় থেকেই নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর থেকেই। আর সেই প্রক্রিয়া শুরু হোক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই, প্রকৃত মেধাবী ও বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষার্থী এবং যোগ্য শিক্ষকদের হাত দিয়েই। (লেখাটি আরাফাত রহমানের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া)
আরাফাত রহমান: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গোপালগঞ্জ
মন্তব্য করুন