ছাত্রছাত্রীদের কাছে একজন শিক্ষক শুধু শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক নন। তিনি তাদের শিক্ষক, অভিভাবক, গাইড এবং বন্ধুও। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ সম্পর্ক ক্যাম্পাসের এবং ক্যাম্পাসের বাইরেরও। এই সম্পর্ক ছাত্র থাকা অবস্থায় এবং ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরেরও। এক কথায়, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ব্যপ্তি আমৃত্যু। তাই একজন শিক্ষকের দায়িত্ব তার ছাত্রছাত্রীদের চলার পথ নিরাপদ করা, তারা বিপথে গেলে তাদের সঠিক পথের সন্ধান দেওয়া এবং তাদের বিপদ কিংবা অসহায়ত্বে সাহায্যে এগিয়ে আসা। এই জন্যই তো শিক্ষককে জাতি গঠনের কারিগর বলা হয়।
শ্রেণিকক্ষে শুধু পাঠদান করলে শিক্ষক হওয়া যায় না। প্রকৃত শিক্ষকের দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদেরকে স্বপ্ন দেখানো– সেই স্বপ্ন মানুষ হওয়ার স্বপ্ন, বেঁচে থাকার স্বপ্ন, বড় হওয়ার স্বপ্ন, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন এবং দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। সত্যকে সত্য হিসেবে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে বলতে শিখাতে হয়। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো হিসেবে বলতে পারা শিখাতে হয়। বুকে হাত দিয়ে বলি তো কতজন আমরা এই কাজগুলো করি কিংবা করার চিন্তা করি। আমরা কতজন সত্যকে সত্য হিসেবে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে বলি। কতজন সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো হিসেবে বলতে পারি। শিক্ষক হওয়া তো দূরের কথা আমরা শিক্ষকরা তো মানুষ হয়েই উঠতে পারেনি। বরং আমরা রাজনৈতিক দলের কর্মী কিংবা ক্যাডার হতে বেশি চেষ্টা করি। আর যারা তা করি না তারা নিজেদের ভালো মানুষ মনে করে গা বাঁচিয়ে চলি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে অহিংসভাবে আন্দোলনরত ছাত্রসমাজের ওপর হেলমেটপরা অছাত্র এবং বহিরাগতদের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে পরিকল্পিতভাবে নির্মম হামলা ও নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের অসহায়ত্বে যে শিক্ষক সমাজ চুপ এবং নির্বিকার সেই মেরুদণ্ডহীন শিক্ষক সমাজ আমরা কীভাবে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের সামনে দাঁড়াব? আমরা কি পারব তাদের আগের মতো পাঠদান করাতে, স্বপ্ন দেখাতে এবং নীতিকথা শুনাতে। কেন তারা আমাদের কথা শুনবে? যে দেশে মেধার ভিত্তিতে চাকরির সুযোগ নেই এবং যেখানে যুগ যুগ ধরে চাকরীরি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, সেখানে আমরা কীভাবে বলব ভালোভাবে পড়াশোনা করতে? এমনিতেই ছাত্রছাত্রীদের একাডেমিক পড়াশোনায় মনোযোগ নেই। কেননা একাডেমিক শিক্ষা চাকরির নিশ্চয়তা দেয় না। বরং লেজুড়ভিত্তিক দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে মিছিল-মিটিং করলে কিংবা মধুর ক্যান্টিনে আড্ডা দিলে চাকরির আশ্বাস মেলে।
সারা বিশ্বে শিক্ষকরাই তো শিক্ষার্থীদের আদর্শ। আমাদের শিক্ষার্থীরা তো সেদিন থেকে শিক্ষকদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা বর্জন করেছে যে দিন থেকে সব লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমরা লেজুড়ভিত্তিক দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়েছি যা পর্যায়ক্রমে আমাদের এটি স্বার্থপর এবং মেরুদণ্ডহীন এক নিচু জীবে পরিণত করেছে। কেউ পদের আশায় এবং কেউ বাড়তি সুযোগ সুবিধার আশায় আমরা দলীয় প্রভুদের পা চাটা জীবে পরিণত হয়েছি। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় এখন কেউ কেউ দলীয় প্রভুদের জুতার তলাও চাটছি। পা-চাটা শিক্ষক সমাজ কীভাবে শিক্ষার্থীদের আদর্শ কিংবা মডেল হবে? তারপরও কেবল বদন্যতার জন্য তারা আমাদের সম্মান করত। কিন্তু সে বদন্যতার জায়গাটাও আমরা ধরে রাখতে পারলাম না। ফলে কোনোভাবেই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সামনে আমাদের দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। তাই শিক্ষক হিসেবে নিজেকে ধিক, শত কোটি ধিক।
বায়ান্ন থেকে নব্বই পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্ররা শিক্ষকদের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছে এবং বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। কিন্তু সেই ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনের পক্ষে আমরা কেউ দাঁড়ালাম না। আবার নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের ওপর যখন নির্মম অত্যাচার-নিপীড়ন চললো তাদের সাহায্যার্থে কেউ এগিয়ে আসলাম না। ফলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে যে ফাটল সৃষ্টি হলো তা কি কখনো বন্ধ হবে?
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
মন্তব্য করুন