প্রকৌ: মু: মাহবুব হোসেন
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৪, ০২:০৫ পিএম
আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২৪, ০২:২৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

সীমাহীন জনদুর্ভোগের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান!

প্রকৌ: মু: মাহবুব হোসেন। ছবি : সংগৃহীত
প্রকৌ: মু: মাহবুব হোসেন। ছবি : সংগৃহীত

থালায় সাজিয়ে স্বাধীন দেশ তো পাওয়া হয়েই গেছে! সেই স্বাধীন দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় নামমাত্র খরচে পড়াশোনা করে, মেধাবী হয়ে এখন আর মুক্তিযোদ্ধাদের ইজ্জত দেওয়ার দরকার আছে কি? স্বাধীন দেশের পতাকা তো গুলিস্তানের মোড়েই কিনতে পাওয়া যায়, তাই এর অর্জনের জন্য সবকিছু বিলিয়ে দেওয়া মানুষগুলো বা তাদের সম্মানের মূল্যই বা পতাকার চেয়ে কত পয়সা বেশি হবে?

তথাকথিত কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে আজ যেভাবে রাস্তায় রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের আকারে-ইঙ্গিতে বা কখনো সরাসরি অসম্মানিত করা হচ্ছে, তা দেখে এই প্রশ্নগুলো আসতেই পারে যে কোনো সভ্য, সচেতন, বিবেকবান মানুষের মনে।

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার ছেলে, একজনের নাতি এবং একজনের আপন ভাতিজা। তিনজন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্য হয়েও আমাদের বৃহত্তর পরিবারের একজন সদস্যেরও আল্লাহর রহমতে সরকারি চাকরি বা অন্য কোথাও কখনো কোটার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েছে বলে জানা নেই আমার! আমার বাবা আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার হওয়ার কারণে আমার সুযোগ হয়েছে এই রকম অন্তত কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে চেনার বা জানার, যাদের কারোরই কোনো কোটা বেয়ে ওপরে উঠতে হয়নি।

পরিসংখ্যান ঘাঁটলে হয়তো নিশ্চিত হওয়া যাবে, তবে সরকারের চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান মুক্তিযোদ্ধা কোটার অর্ধেকও কখনো ব্যাবহৃত হয়েছে কিনা- এ ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাই এত হুল্লোড়, এত আলোচনার কতটুকু তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে আর কতটুকু হুজুগে অথবা কারো গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য, সেটা খতিয়ে দেখা জরুরি। আজকে আমি আবেগের জায়গা থেকে লিখছি, তাই পরিসংখ্যানে মাথা ঘাঁটাতে ইচ্ছা করছে না। তবে দরকার হলে সেটাও করব।

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে নয়, একজন সাধারণ বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যখন পঙ্গু অবস্থায় দেখেছি, অথবা একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের কাউকে যখন দশকের পর দশক ধরে জিন্দালাশের মতো বাঁচতে দেখেছি, একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মাকে যখন সন্তানকে মৃত্যুর আগে একমুঠো ভাত না খাওয়াতে পারার শোকে আমৃত্যু ভাত না খেয়ে বেঁচে থাকতে দেখেছি, তখন অনুধাবন করেছি- জাতির পিতার ডাকে নিজেদের জীবন, যৌবন, স্বপ্ন, পরিবার, পরিজনের কথা না ভেবে সাড়ে সাত কোটি নিপীড়িত মানুষের জন্য একটি স্বাধীন দেশ, একটি পতাকা ছিনিয়ে আনতে যেই এক লাখ ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধা অকাতরে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন- তাদের চৌদ্দ প্রজন্মের সেবা করলেও ওনাদের ঋণ শোধ করা সম্ভব হবে না এ জাতির পক্ষে।

পেশার কারণে প্রতিনিয়ত ভালো-খারাপ মিলিয়ে অনেক সরকারি অফিসারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়ে থাকে আমার। কে কোন কোটায় চাকরি পেয়েছেন আজ পর্যন্ত একজনকেও জিজ্ঞেস করা হয় নাই। বর্তামানে সরকারি চাকরিতে কর্মরত অনেকের মেধা নিয়েই হয়তো আন্দোলনকারী মেধাবীরা প্রশ্ন তুলছেন।

এই মানুষগুলো আপনাদের দৃষ্টিতে হয়তো আপনাদের মতো মেধাবী নন। তবে বর্তমান প্রজন্মের মেধাবীদের একটা বড় অংশের মতো সরকারি শিক্ষা, চাকরি, সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে কাবিল হয়ে তারপর বিদেশ পাড়ি না দিয়ে ওনারা অন্তত দেশের মানুষের জন্য চলমান কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন।

সত্য মিথ্যা জানি না, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক মহাজ্ঞানী শিক্ষক মুক্তিয়োদ্ধার সন্তানদের কাছে প্রশ্ন করেছেন - যুদ্ধ করেছে তোমার বাবা, তুমি কোন যুক্তিতে কোটা পাবে?, যা ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এই ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি।

আজকে যে সরকারের সরকারি চাকরির কথা হচ্ছে, বা যে সরকারি চাকরিতে শিক্ষক মহোদয় নিজে চাকরিরত, সেই সরকারের অস্তিত্বই তৈরি হতো না যদি এ দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের কথা না ভেবে এদেশের মানুষের জন্য একটি স্বাধীন দেশ, নিজেদের মাটি, সীমানা আর সরকার ছিনিয়ে আনতে অকাতরে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে না পড়তেন। এ কথা কি শিক্ষক মহোদয় বা তার অনুসারীরা অস্বীকার করতে পারবেন?

কত মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে যাওয়ার কারণে নিজেদের পরিবারের সদস্যদের গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা করার সুযোগটুকু পর্যন্ত পান নাই, সেটা সেই শিক্ষক বা যাদের অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে উনি উসকানি দিচ্ছেন, তারা কি জানেন? শুধু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে রাজাকার আল-বদরদের সাহায্য নিয়ে কত মুক্তিযোদ্ধার পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, সহায়সম্পত্তি, চৌদ্দগোষ্ঠীসমেত মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে তা কি জানেন ওনারা?

এই ঢোল পেটানো মেধাবীর দল কি জানে যে কত মুক্তিযোদ্ধার শরীরের একাধিক অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের শিক্ষা বা পেশাদারি জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে যুদ্ধে গিয়ে? বলতে পারেন, আজ যদি আমার বাবা এবং তার মতো সকল মহান মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ না করত, তাহলে কোনো সরকারের কোনো সরকারি চাকরির কোনো কোটা নিয়ে রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষের জীবনে অপরিসীম ভোগান্তি সৃষ্টি করতেন আপনারা?

আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, এই মহাজ্ঞানী শিক্ষক বা এই অসঙ্গত আন্দোলন নামের আউটডোর পার্টির যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন কিংবা এর পেছনের কুশীলব যারা আছেন, তাদের পরিবারের কেউ কি দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন? কেউ কি যুদ্ধে পঙ্গু হয়েছিলেন কিংবা শহীদ হয়েছিলেন? আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে এ ব্যাপারে। ঘেটে দেখা দরকার, বোধহয় অন্য কিছু পাওয়া যেতে পারে।

স্বাধীনতা, তথা মুক্তিযুদ্ধের মূল্য যারা বোঝেন, মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্ব যারা বোঝেন, তারা মু্ক্তিযোদ্ধা বা তাদের পরিবারকে অসম্মান করে, রাস্তাঘাট বন্ধ করে, সাধারণ মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি করে কারও লুক্কায়িত এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্ঠা করবে, সেটা বিশ্বাস করা কঠিনই বটে। তবে যাদের মাধ্যমেই হোক, রাস্তাঘাটে ঢোল বাজিয়ে নাচগানের তালে দেশের স্বঘোষিত মেধাবীদের যখন মু্ক্তিযোদ্ধাদের বা তাদের পরিবারকে অসম্মান করতে দেখি, তখন সত্যিই খুব কষ্ট হয়।

আমার বাবার মতো এখনও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের মুখের দিকে তাকিয়ে যখন এক ধরনের অদ্ভুত অস্বস্তি দেখি এই বিচ্ছিরি বিষয় নিয়ে সংবাদ পড়া বা দেখার সময়, তখন মন ভারাক্রান্ত হয়। এই ভেবে আতঙ্কিত হই যে, যেই দেশটির জন্য সব বিলিয়ে দিয়েছিলেন এই মহামানবরা, সেদেশের মাটিতে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র আজও খুব সহজেই বর্তমান প্রজন্মের বড় একটা অংশকে বিভ্রান্ত করে ভুল পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সুফল সবচেয়ে সহজে, সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ভোগকারী প্রজন্মের পথভ্রষ্ট অংশের হাতেই আজ ভুলুণ্ঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধার সম্মান, মুক্তিযুদ্ধের সম্মান। আমার বাবার মতো মহান মুক্তিযোদ্ধারা হয়ত এই ব্যর্থতার জন্য নিজেদেরই দুষছেন আজ! এ দেশের জন্য কোন কোটায় নিজেদের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছিলেন তারা, হয়ত সেই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজছেন মনের অজান্তে!

লেখক-

প্রকৌ: মু: মাহবুব হোসেন তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিশেষজ্ঞ

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বৃষ্টি আর কত দিন থাকবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

ইসরায়েলি হামলায় সিরিয়া-লেবানন সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

দুপুরের মধ্যে ঝড় হতে পারে যেসব অঞ্চলে

আরেক দেশ থেকে ইসরায়েলে হামলায় ২ সেনা নিহত, আহত ২৪

বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে জবির স্লোগান ‘বিপ্লবে বলীয়ান নির্ভীক জবিয়ান’

শিক্ষক দিবসে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে

হত্যা মামলায় রসিকের সাবেক কাউন্সিলর মিলন গ্রেপ্তার

বৈরুত বিমানবন্দরের পাশেই ইসরায়েলি তাণ্ডব

সিলেটে রায়হান হত্যা মামলায় ২ যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

৫ অক্টোবর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১০

রোহিঙ্গা সংকট একটি তাজা টাইম বোমা : ড. ইউনূস

১১

বন্যার পানিতে মায়ের লাশের সঙ্গে ভেসে এল শিশু

১২

লেবাননের যোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষ, পিছু হঠল ইসরায়েলি বাহিনী

১৩

সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জানাজা কখন-কোথায়?

১৪

আজ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসবে বিএনপি

১৫

সকালের মধ্যে দেশের ১৮ অঞ্চলে ঝড়ের আভাস

১৬

৫ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি

১৭

আজও কি দিনভর সারাদেশে বৃষ্টি হতে পারে?

১৮

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৯

বিদ্যালয়ে কোনোরকম উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল না

২০
X