আন্দোলন-সংগ্রামই বাঙালি জাতির ইতিহাস এবং বাংলাদেশের ইতিহাস। এই আন্দোলন-সংগ্রাম কখনও মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে, কখনও স্বাধীনতা সংগ্রামে, কখনও স্বৈরাচার নিপাতে, কখনও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে এবং কখনও সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে।
প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম থেকেই বিজয় এসেছে এবং দেশ তার সুফল পেয়েছে। তবে, সঙ্গত কারণেই এসব ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ শক্তি পরাজিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দেশের ছাত্র সমাজের কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে সবার জেতার সুযোগ আছে।
এবারের কোটাবিরোধী আন্দোলন বিদ্যমান কোটা বাতিলসংক্রান্ত পরিপত্র নিয়ে করা একটি রিটের পরিপেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি রায়কে কেন্দ্র করে যার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এখনও অজানা। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর তা যৌক্তিক মনে না হলে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে সরকারের আপিল করার সুযোগ আছে।
সরকার সে সুযোগ কাজে লাগালে এবং আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করলে অথবা সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ন্যায্যতার ভিত্তিতে কোটা সংস্কারের পক্ষে রায় দিলে দেশের বিচার বিভাগের লাভ ছাড়া ক্ষতির কিছু নেই। বরং এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের হারানো আস্থা কিছুটা হলেও ফিরে আসার সুযোগ হবে। ফলে দেশের বিচার বিভাগ জিতে যাবে।
এ আন্দলোন থেকে সরকারের বহুমুখী সুফল ঘরে তোলার সুযোগ আছে। এই শান্তিপূর্ণ এবং অহিংস আন্দোলনে বাধা না দেওয়ায় আন্দলোন উৎসব মুখর হচ্ছে যা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর আর তেমন দেখা যায়নি। ফলে দেশে-বিদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। আন্দলোন-সংগ্রাম দমনে সরকারের বিরুদ্ধে যে পাহাড়সম অভিযোগ আছে তা কিছুটা হলেও কমতে পারে।
আর আপিলের রায় সরকার এবং ছাত্রসমাজের পক্ষে আসলে তো সরকার এবং ছাত্র সমাজ উভয়পক্ষই জিতে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের লাভের পাল্লাই বেশি ভারী হবে কেননা ২০১৮ সালে ছাত্রসমাজের আন্দোলনের মুখে কোটা বাতিল করে সরকারের ভাবমূর্তি যতটুকু উজ্জ্বল হয়েছিল তা সমুজ্জ্বল হবে।
তাছাড়া, আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা তো বেশিরভাগ সরকার পক্ষের ছাত্র-সংগঠনের নেতাকর্মী এবং অনুসারী। তাই তারা জিতলে তো সরকারই জিতে যায়।
অন্যদিকে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা সাবেক এবং বর্তমান কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতির অভিযোগের সংবাদ মূলধারা এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে জায়গা করে নেওয়ায় সরকারের বিব্রত হাওয়া স্বাভাবিক ছিল। কোটাবিরোধী আন্দলোনের সংবাদ আপাতত সেই জায়গা দখল করে নেওয়ায় সে ক্ষেত্রে কিছু স্বস্তি আসা স্বাভাবিক।
এই আন্দোলনে বাক-শক্তিহীন বিরোধী দল নৈতিক সমর্থন দিয়ে তাদের অস্তিত্বের জানান দিতে পারছে। তাই তাদেরও জিত আছে।তবে সবচেয়ে বেশি জিত আছে দেশের। শতভাগে বিভক্ত ছাত্রসমাজের একই প্লাটফর্মে এসে শান্তিপূর্ণভাবে টানা আন্দলোন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সত্যিই দেশের জন্য একটা বড় পাওয়া।
দেশের প্রয়োজনে ছাত্রসমাজের এই একতাবদ্ধতা ধরে রাখতে পারলে জাতি কখনও পথ হারাবে না। এই আন্দোলনে ছাত্রসমাজের মধ্যে নেতৃত্বের বীজ বপন হচ্ছে যা দেশের আরেকটা বড় পাওয়া। আর সবচেয়ে বড় পাওয়া হচ্ছে ছাত্রসমাজের বিলুপ্ত প্রায় কনফিডেন্স ফিরে পাওয়া যা এই সময়ে যুবসমাজের টিকে থাকার জন্য অতীব জরুরি।
এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ আপিল বিভাগে হাইকোর্টের রায় বাতিল হলেও আন্দোলনরত ছাত্রসমাজের বৃহৎ অংশই হয়তো সরকারি চাকরি পাবে না। তবে এই ফিরে পাওয়া কনফিডেন্স তাদের জীবন চলার পথে একটি বিশাল পাথেও হিসাবে কাজ করবে যা কাউকে কাউকে বড় উদ্যোক্ততা হতেও সাহায্য করবে।
তাই চাকরির পাশাপাশি উদ্যোক্ততা হওয়ার বীজ ছাত্র থাকা অবস্থায় বপন করতে হবে। তবে কিছু শর্ত আছে। আর তা হলো নিজেদের মধ্যে একতা, সততা, সরলতা এবং অহিংসতা ধরে রাখতে হবে।
আরও শর্ত হলো- যে কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় শর্ত হলো অন্তরকে জটিলতা, কুটিলতা, প্রতিহিংসাপরায়নতা এবং পরশ্রীকাতরতা মুক্ত করে পারস্পারিক হিংসা-বিদ্বেষ এবং রেষারেষি-হানাহানি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে । এসব শর্ত মেনে অগ্রসর হলে তোমাদের শক্তি-সমাজ, দেশ এবং জাতি গঠনের আন্দোলনেও রূপান্তর হবে। এটিই ছাত্রসমাজের কাছে প্রত্যাশা।
লেখক : ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
মন্তব্য করুন