মাছুম বিল্লাহ
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৪, ০৯:৪০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে

মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও চাঁদা দিতে হয়?

ছবি : প্রতীকী
ছবি : প্রতীকী

২৪ জুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক অধ্যক্ষের কিছু কথা ভাইরাল হয়। তিনি বলেন, ইউএনও, এডিসি, ডিসিকে সম্মানী দিতে অতিরিক্ত ফি দিতে হয়। সরকারি পাতারহাট আর.সি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শহীদুল ইসলামের এমন একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে এমন কথা বলেন আরসি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। ভাইরাল হওয়া ৩ মিনিট ৩ সেকেন্ডের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীর করা ভিডিওতে অতিরিক্ত ফি আদায় কেনো করছেন? ৫০০ টাকা দেওয়ার এবিলিট যাদের নেই তারা কি করবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যারা গরীব তারা টাকা দিয়া গেছে, রিকশাওয়ারা পোলা টাকা দিয়ে গেছে, যারা ধনী সামর্থ্যবান তারা যুদ্ধ করে কেমনে প্রিন্সিপালকে হেনস্থা করা যায়।

তিনি ছাত্রীকে বলেন, তুমি গরিব হলে কেমনে? তুমি তো এন্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করো, আসি স্টুডেন্ট অবস্থায় তো চিন্তাও করি নাই। আপনার সময় এন্ড্রয়েড ফোন তো দূরের কথা, মোবাইল ফোনও পরের কথা ল্যান্ড ফোনও ছিলনা উপজেলা পর্যায়ের কলেজে। এসময় অধ্যক্ষ বলেন, আমার ওপর দায় চাপালে হবেনা, আমি তো বেতনের টাকায় হাত দেবনা, আমার তো সংসার আছে, আছে ইউএনও-ও সম্মানী, জেলা প্রশাসকের সম্মানী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকে সম্মানী পাঠাতে হবে। দুজন ট্যাগ অফিসার আছে এদের সম্মানী পাঠাতে হবে।

অধ্যক্ষের উল্লেখ করা এই ট্যাগ অফিসার কারা? কি এদের কাজ? বোঝা যাচ্ছে মোটামুটি গিভ অ্যান্ড টেকের মধ্যে দিয়ে সবকিছু চলছে। অধ্যক্ষ অবশ্য নিজেই বলেছেন, এটা সমঝোতার পথ, তোমরা সমঝোতার পথ বন্ধ করে দিলে তোমারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবা। তোমাদের কাছ থেকে বলা যায় এক প্রকার জোর করে টাকা নিছি। কারণ, আমি কি করব, আমার তো সংসার আছে।

অধ্যক্ষ বলছেন, ‘আমাকে ২১ দিনের ট্রেনিংয়ে সম্মানী দিয়েছে ৫৩ হাজার টাকা, আর আমার খরব হয়েছে এক লাখ টাকা।’ আমি অন্য একটি লেখায় বিষয়টি বলেছি যে, সরকারি পর্যায়ে যেসব প্রশিক্ষণ অনুষ্টিত হয় সেখানে মুখ্য বিষয় মুখ্য হচ্ছে অর্থ প্রাপ্তি। অর্থ আছে শিক্ষকরা আছেন, অর্থ নেই তারা নেই। প্রশিক্ষনের মাধ্যমে কিছু জানা বা পেশাগত উন্নয়ন... এসব কথা আর হালে পানি পায়না। পাতার হাট রসিক চন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ সত্য কথাটিই বলেছেন। আমাকে খরচ না দিলে আমি ট্রেনিং করবোনা। কিন্তু এই বিষয়টি বুঝলামনা উনি যখন বললেন যে, ‘আমাকে ২১ দিনের ট্রেনিংয়ে ৫৩ হাজার টাকা দিয়েছে আর আমার খরচ হয়েছে এক লাখ টাকা।’ উনি কি থ্রিস্টার হোটেলে বসে ট্রেনিং করেছেন নাকি প্রতিদিন কলেজ থেকে স্পেশাল কারে চড়ে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছেন।

দেশে এখন যত প্রশিক্ষণ হচ্ছে তার অবস্থা এরকমই। আমরা এটি বহু আগে থেকেই জানি। যারা জানতেন না তাদের মোটামুটি জানা হলো। এর মধ্যে আরও অনেক ‘কিন্তু’ আছে। ঐ প্রশিক্ষণের যাওয়ার জন্যও লবিং আছে, অর্থ লেনদেনের ব্যাপার আছে। সম্ভবত ইত্যাদি মিলিয়ে উনি এক লাখ টাকার কথা বলেছেন। তো আপনার এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে সেই টাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিতে হবে? রাস্তায়, হাঁটে ঘাটে যারা জোর করে অর্থ আদায় করে তাদের সাথে তফাৎ কি রইলো?

উনি আরও বলেছেন, ‘আমি তো বেতনের টাকায় হাত দেবনা, আমার তো সংসার আছে।’ একজন অধ্যক্ষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে আপনার এই মহান বাণী? কি শেখাচ্ছেন আপনার শিক্ষার্থীদের? সমাজ কি একেবারেই গেল? এ তো কোন শিক্ষকের কথা নয়, এ তো অন্য কোন পেশায় নিয়োজিতদের কথা যারা পনের লাখ টাকা দিয়ে ছাগল ক্রয় করে, দেশে বিদেশে রিসোর্ট বানায় আর ব্যাংকের হিসার স্ফীত করে? শুনেছি উক্ত মতিউরের বাড়িও নাকি সেই এলাকায়।

অধ্যক্ষ ভিডিওতে আরও বলেন, অনার্সের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কেন্দ্র ফি নেয়া হয়নি। তারা আসতেছে, নিয়ে যাচ্ছে আমারও কোন টেনশন নেই। ডিসির সম্মানী লাগবে না, এডিসির লাগবেনা, আর ইউএনরও লাগবে না, ওডা বিএম কলেজের ব্যাপার। সম্ভবত বিএম কলেজ পরীক্ষার কেন্দ্র। সেখানকার প্রশাসন বুঝবে এডিসি, ডিসিদের কত টাকা দিতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচছুক একাধিক শিক্ষার্থী দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের এডমিট কার্ড এর জন্য ৫০০ টাকা অতিরিক্ত ফি আদায় করেছেন ৫০ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে অধ্যক্ষের কাছে তারা গেলে তিনি এসব কথা বলেন।

এখানে অনেকগুলো বিষয় উঠে এসেছে। মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাগন তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও সম্মানী (?) আদায় করেন বিষয়টি আমার কাছে নতুন মনে হলো। আমরা জানি এবং বন্ধুরা যারা সরকারি বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ তারা বলেন যে, ছাত্র নেতাদের ঠান্ডা রাখতে হয়, এলাকার নেতাদের ঠান্ডা রাখতে হয়। ছাত্র নেতারা যেহেতু চাকরি করেন না তাদের তো একটা ব্যাপার আছে। নেতাদের অনেক পয়সা খরচ করতে হয়, তাদেরও একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু ইউএনও, এডিসি ও ডিসিদেরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পয়সা দিতে হয়! তারা তো রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত কর্মকর্তা! অবাক কাণ্ড! আমরা যখন এসএসসি পরীক্ষা দিতাম বা বড়দের পরীক্ষা দেখতে যেতাম তখন দেখতাম মেজিস্ট্রেটের গাড়ি দেখলে সবাই তটস্থ হয়ে যেত। তিনি এসে সমস্ত হল, ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতেন। দু’চারজন শিক্ষার্থীদের বহিস্কার করতেন। তাহলে তারাও কি টাকা নিতেন? সম্ভবত না কারন সমাজ তখনো এত স্মার্ট হয়নি।

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় আর মেজিস্ট্রেটদের দেখা নেই কিংবা তাদের তখন বেল ছিলনা কারন তখন দেশে মার্শাল ল জারি ছিল (এরশাদের)। পরীক্ষা দেখতে আসতেন সেনা কর্মকর্তারা। ল্যাফটেনেন্ট এবং ক্যাপ্টেন পর্যায়ের অফিসারগন পরীক্ষার হল ঘুরে ঘুরে দেখতেন। তারা কি পয়সা নিতেন? খুব সম্বব না। তারা দেখতাম অধ্যক্ষ এবং স্যারদের ‘স্যার’ সম্বোধন করতেন এবং আগেই হাত উঁচু করে সালাম দিতেন। বিষয়টি ঐ সময় লক্ষ্য করেছি। এ বিষয়টিও এখন আর নেই অর্থাৎ কলেজের শিক্ষকদের সেনা অফিসারদের ‘স্যার’ বলা, আগে সালাম দেওয়া। সেই বিষয়টি যে উঠে গেছে তা নিজেই লক্ষ্য করেছি যখন প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।

সমাজ এখন অনেক এগিয়েছে আর তাই এসব কান্ড! ইউএনও, এডিসি, ডিসি... সবাই তাহলে বখরা আদায় করেন! সমাজ এতদূর এগিয়েছে তা বুঝতে দেরি হলো! তারা তো প্রচলিত অর্থে দেশের মেধাবী সন্তান, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যাডার সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত হন। নেতাদের এলাকা ভাগ করা থাকে, লঞ্চঘাট, বাস স্ট্যাান্ড বাজার সব জায়গা থেকেই তারা চাঁদা আদায় করেন-- যেন এক বৈধ নিয়ম! এ নিয়ে আবার ভাগ-বাটোয়ারায় সমস্যা হলে নিজেদের মধ্যে মারামারি খুনাখুনি পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এসব জায়গা থেকে বখড়া পান কিনা জানিনা। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের বখড়া নিতে হয়? সমাজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে? কেউ একবারও কি চিন্তা করছি? কি হয়েছে সমাজের? মানুষ কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে?

মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক; সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভাব বাংলাদেশ

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১০

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১১

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১২

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৩

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৪

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৫

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৬

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৭

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৮

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

১৯

জুলাই বিপ্লবে আহত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বাবুকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড

২০
X