রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১
ডা. সাঈদ এনাম 
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:৪৯ পিএম
আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২৪, ০৭:৩৩ এএম
অনলাইন সংস্করণ

মিডিয়া কি তবে আত্মহত্যায় প্ররোচনা জোগাচ্ছে?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বিখ্যাত জার্মান নোবেলিস্ট ইউহান ওয়াফগ্যাং ভন গোথের ‘দি সরো অব ইয়াং ওয়ার্থার’ একটি জনপ্রিয় ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। এই লাভ স্টোরি ১৭শ সালের শেষের দিকে সারা বিশ্বের তরুণ-তরুণীদের কাছে হৈ চৈ ফেলে দেয়। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকায় নানা দেশে নানা ভাষায় এটি মুদ্রিত হতে থাকে।

উপন্যাসের মূল নায়ক ওয়ার্থার। ত্রিভুজ প্রেমের বলি হয়ে তিনি তার প্রেমিকার স্বামীর পিস্তল দিয়ে অগোচরে আত্মহত্যা করেন। গল্পটি সে সময়ে সারা ইউরোপে ব্যাপক সাড়া ফেলে। কিন্তু উপন্যাসের নেতিবাচক প্রভাবে ঘটতে থাকে একের পর এক দুঃখজনক ঘটনা।

গল্পটি পড়ে ইউরোপের অনেক তরুণ-তরুণী প্রভাবিত হন, প্ররোচিত হয়ে একইভাবে তারা আত্মহত্যা করতে থাকেন। গল্পের নায়ক আর্থারের মতো তারাও আত্মহত্যার সময় হলুদ প্যান্ট ও নীল জ্যাকেট পরেন। বিশেষ করে কাজটি তারাই করতেন, যারা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে ছিলেন।

একপর্যায়ে জার্মান সরকার বাধ্য হয় গোথের কালজয়ী বইটি নিষিদ্ধ করতে। অথচ নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এই উপন্যাসকে আখ্যা দিয়েছিলেন ইউরোপীয় ইতিহাসের বিখ্যাত লাভ স্টোরি বলে।

আরেকটি রহস্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে ১৯৬২ সালে। যেদিন আমেরিকান এক সেলিব্রিটি আত্মহত্যা করে বসেন। তিনি ছিলেন হলিউডের সে সময়ের বিখ্যাত নায়িকা মেরিলিন মনরো। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই অভিনেত্রীর আত্মহত্যার পরের মাসে আমেরিকায় রহস্যজনকভাবে তরুণ-তরুণীদের মাঝে সুইসাইডের ঘটনা বাড়তে থাকে।

এ নিয়ে মার্কিন স্বাস্থ্য প্রশাসন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। শুরু হয় গবেষণা। তারা দেখেন মেরিলিন মনরো’র সুইসাইডের ঘটনাটি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায়। যার পরিণতিতে আত্মহনন বাড়ছে।

মেরিলিন মনরোর বর্ণিল জীবন, চকচকে রঙিন ছবি, তার পরকীয়ার গল্প, সুখ-দুঃখ, সর্বোপরি তার আত্মহত্যার মুহূর্তের চমকপ্রদ বর্ণনা, এসব নিয়ে চিত্তাকর্ষক গল্প সংবাদ মাধ্যমে লাগাতার প্রকাশ অন্যদের আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিতে থাকে।

আত্মহত্যার ঘটনার বিশদ বিবরণ ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট বা অন্য কোন যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বসাধারণের কাছে তুলে ধরলে, যারা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকেন, অর্থাৎ যারা দীর্ঘদিন ধরে ‘আত্মহত্যার পরিকল্পনা করতে থাকেন’, তাদের জন্যে আত্মহত্যা করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে পথ খুঁজে পান, অর্থাৎ তারা প্ররোচিত হয়ে আত্মহত্যা করেন।

ওয়ার্থার ইফেক্ট কী?

মিডিয়ার মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়া আত্মহত্যার নাম দেওয়া হয় ওয়ার্থার ইফেক্ট (Werthe Effect)। ১৯৭৪ সালে আমেরিকান সোশিওলজিস্ট ডেভিড ফিলিপ সর্বপ্রথম ‘ওয়ার্থার ইফেক্ট’ সম্পর্কে ধারণা দেন।

‘ওয়ার্থার ইফেক্ট’ নাম নেওয়া হয় জননন্দিত জার্মান লেখক ওয়েফগ্যাং গোথে’র লাভ স্টোরি ‘দ্য সরো অব ইয়াং ওয়ার্থার’ থেকে। যে চরিত্রের মাধ্যমে প্ররোচিত হয়ে তরুণ-তরুণীরা আত্মহত্যার পথে পা বাড়ায়।

কপিক্যাট সুইসাইড কী?

এক আত্মহত্যায় প্রভাবিত হয়ে আরেকটা আত্মহত্যাকে বলা হয় ‘কপিক্যাট সুইসাইড’। অনেক সময় সুইসাইড কন্টাজিয়াসও বলা হয়।

এ ভয়ংকর বিষয়টি আমাদের অনেকের কাছে নতুন। আমরা অজান্তে নিজের আত্মীয়ের বা অন্যের আত্মীয়ের আত্মহত্যার ঘটনাটি মনের মাধুরী মিশিয়ে, রং চং মাখিয়ে ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশদভাবে লিখি বা উপস্থাপন করি। এতে পরোক্ষভাবে আমরা আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়ে থাকি।

অথচ মিডিয়ার দায়িত্ব সব ধরনের অপমৃত্যুর বিরুদ্ধে কথা বলা। এগুলো প্রতিরোধ করা। আসুন, সচেতনতার পাশাপাশি আত্মহত্যার নেতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরি। এতে সমাজে বা পরিবারে ঝুঁকিতে থাকা অন্য কেউ প্ররোচিত হবে না।

সুইসাইড ক্লাস্টার কী?

ভ্রান্তভাবে সুইসাইডের খবরে প্ররোচিত হয়ে বড় পরিসরে বা গ্রুপ আকারে সুইসাইড হতে পারে। একে বলে সুইসাইড ক্লাস্টার (Suicide Cluster)। সুইসাইড ক্লাস্টার দু’রকমের।

মিডিয়া কর্তৃক প্ররোচিত হয়ে একই সময়ে বিভিন্ন এলাকায় যখন অনেকজন সুইসাইড করে, তাকে বলা হয় মাস ক্লাস্টার (Mass Cluster)। এটি টাইম স্পেসিফিক। সাধারণত সেলিব্রিটিদের আত্মহত্যার পর এমনটা হয়।

আবার একই স্থান ও প্রায় সমসাময়িক অনেকগুলো সুইসাইড একত্রে হলে তাকে বলে পয়েন্ট সুইসাইড (Point Suicide)। সাধারণত কলেজ সহপাঠীর আত্মহত্যায় এমন দেখা যায়।

আত্মহত্যা মহাপাপ। আত্মহত্যাকারীর আত্মা কখনো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। পবিত্র কোরআনে সুরা নিসায় মহান আল্লাহতায়লা বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়ালু। যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি ও জুলু্মের মাধ্যমে এ কাজ করবে, তাকে আমি আগুনে পোড়াব’।

আমাদের প্রিয় রাসুলুল্লাহ (স.) নিজে আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়াননি। সুতরাং বুঝা যায়, তিনি একে কতটা ঘৃণা করতেন।

ডা. সাঈদ এনাম এমবিবিএস (ডিএমসি) এমফিল (সাইকিয়াট্রি) বিসিএস (হেলথ) সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ ফেলো, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিম অ্যাসোসিয়েশন

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিলেট কারাগারেই চিকিৎসা চলছে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নানের

৬ কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ : মাহফুজ

রায় দিয়ে ‘বাবার ট্রাস্টে’ টাকা নেন বিচারপতি

‘সাংবাদিকরা সমাজে মেডিয়েটরের ভূমিকা পালন করে থাকেন’

দুর্গাপূজায় সনাতনীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে বিএনপি : মাহবুবের শামীম

নাসা স্পেস অ্যাপস প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিভাগে চ্যাম্পিয়ন জবি

ষড়যন্ত্র বানচালে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে : প্রিন্স

কার হাতে কত সোনার মজুত?

পিএসসির চাকরির পরীক্ষা নিয়ে সমন্বয়ক সারজিসের স্ট্যাটাস

যে কোনো সময় ইরানে হামলা চালাবে ইসরায়েল

১০

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঢাকার শাখা ব্যবস্থাপক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

১১

লন্ডন থেকে দেশে ফিরছেন টুকু

১২

কলেজ অধ্যক্ষকে বাঁচাতে ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি

১৩

প্রতিটি শহীদ পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা দেওয়া উচিত : মেজর হাফিজ

১৪

সংসদের মেয়াদ ৪ বছর চায় গণঅধিকার পরিষদ

১৫

আন্দোলনে হামলাকারী হেলমেট বাহিনীর অন্যতম সদস্য মনিরুল গ্রেপ্তার

১৬

বিএনপি সম্প্রীতির রাজনীতি করে : আমিনুল হক

১৭

আ.লীগ শাসনামলেই হিন্দু সম্প্রদায় বেশি অত্যাচারিত হয়েছে : অ্যাডভোকেট সালাম

১৮

চীনের ক্যান্টন ফেয়ারে ৪র্থ বার অংশ নিচ্ছে ওয়ালটন

১৯

মেয়েদের এতিমখানায় গিয়ে কেন ‘রেগে গেলেন’ জাকির নায়েক?

২০
X