রাষ্ট্রে রাজনৈতিক শুভশক্তি কার্যকরভাবে উপস্থিত না থাকলে অন্য সবকিছু ভেঙে পড়তে বাধ্য। রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার ও তার কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানগুলো উত্তরাধিকার বা ধারাবাহিকতার জন্য অপরিহার্যভাবে বিদ্যমান থাকতে হয়। কিন্তু সেগুলো দেশের মানুষের কল্যাণে কতটা ভূমিকা রাখছে কিংবা মানুষের ন্যায়সংগত অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে কিনা তা নির্ভর করে দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বকীয় শক্তিমত্তায় কোন অর্থে ও কীভাবে কাজ করছে।
রাজনৈতিক দল দ্বারা রাষ্ট্রক্ষমতা যে কোনো কৌশলে ধরে রাখতে গেলে সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের জনগণের জন্য কাজ করছে কি না সে তদারকি বজায় রাখা সম্ভবপর হয় না ও তাদের জবাবদিহিতার ক্ষেত্রগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন চলমান থাকলে তদারকি ও জবাবদিহিতায় অলক্ষ্যেই একধরণের দায়মুক্তিও ঘটে যায়। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকারের সব অঙ্গগুলো প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে নিজেদের অনেকটা স্বেচ্ছাচার সমৃদ্ধ হয়ে ক্ষমতাবান মনে করে ও সে ক্ষমতার দুর্বৃত্তায়িত চর্চাসহ নানাবিধ অনৈতিকতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে।
রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত মানুষগুলো দেশের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে সন্নিবেশিত থাকলেও সে মানুষগুলোই রাষ্ট্রের মালিকরূপে দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্রিয়াশীল হয়ে যায়।কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেরকমটিই হয়েছে।
এখানে দেশের জনগণ আক্ষরিক অর্থেই প্রজার জীবনযাপন করছে। অপরদিকে প্রজাতন্ত্রের (কর্মকর্তা) কর্মচারীদের একটি অংশ রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর সঙ্গে অবশ্যই রাজনীতির দুর্বৃত্ত শক্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবলয়ের মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী শ্রেণি যুক্ত রয়েছে।
আধুনিককালে এ গোষ্ঠীটিকে ‘অলিগার্ক শ্রেণি’ বলা গেলেও আসলে এটি নব সংস্করণের জমিদার শ্রেণি। ফলে দেশের সমাজব্যবস্থাটি নতুন রূপের উপনৈবিশকতার আকার ধারণ করেছে। পুঁজির বিকাশ বা কুক্ষিগত পুঁজি সবটাই এই সকল নব্যজমিদারদের হাতেই। সাধারণ মানুষ এখানে নিরুপায়, প্রতারিত, বিপন্ন ও অসহায় প্রজাসম !
ইদানীং প্রকাশিত খবরগুলোতে দেশে সৃষ্ট এই নব্য জমিদারশ্রেণির সামান্য কিছু নমুনাচিত্র উঠে এসেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই এগুলোর আলোচনায় দেশের মানুষ বেশ জড়িত হয়ে পড়েছে এবং অনেকের মধ্যে এসব নিয়ে একটা ‘হা-পিত্যেশ’ জাতীয় মনোভাব কাজ করছে। ধারাবাহিকভাবে এরূপ ‘স্যাম্পল’ খবর প্রকাশের অন্তর্নিহিত কারণ ‘ভিন্ন’ কিনা সে প্রশ্ন বলবৎ রেখেও বলা যায়, এ ঘটনাগুলো আকস্মিক নয়, ধারাবাহিক অন্যায় চর্চার অনিবার্যতা। এখানে দেশের সামষ্টিক স্বার্থের প্রতি নজর দেওয়া হয়নি বহুদিন এবং এখনও হচ্ছে না। বরং দেশের সামষ্টিক স্বার্থ ও অগ্রগতিকে একরকম গলাটিপে ধরে রাখা হয়েছে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির ভুল ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বড় বাজেট, মেগাপ্রকল্প এগুলোকে বলা হচ্ছে অগ্রগতি। অপরদিকে মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, শিল্প-সংস্কৃতির মানোন্নয়ন,কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী বিনোয়োগ-শিল্পায়ন, অর্থ-ব্যাংক ব্যবস্থাপনার নৈতিক মান, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুস্থ প্রতিযোগিতা,জনশক্তির প্রবাসে ও দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান,কৃষিতে সময়োপযোগী মনোযোগ, ভূমির সঠিক ব্যবহার, নগরায়ণে বাস্তবানুগ পরিকল্পনা, পানি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, বনভূমি-কৃষিভূমি-নদী-জলাশয়-সংরক্ষণ-সদ্ব্যবহার,পরিবেশ সুরক্ষা, রাস্তাঘাট নির্মাণে সার্বিক উপযোগিতা বিবেচনা—এসব মৌলিক বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। কিন্তু এই সকল ক্ষেত্রগুলো উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য প্রাধিকার পাওয়া উচিত।
উল্লিখিত খাতগুলোসহ গণতন্ত্র ,মানবাধিকার, মুক্ত চিন্তা, বাকস্বাধীনতা, বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে ঠেলে রেখে সার্বিক অগ্রগতির পথে দেশের যাত্রারম্ভও সম্ভবপর নয়। এখানের কথিত অগ্রগতির সঙ্গে দেশের অধিকাংশ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই, মানুষ এগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত অংশীজন নয়। বরং মুষ্টিমেয় নব্য জমিদাররাই এই অগ্রগতির পুরো সুফলভোগী। ফলে বাংলাদেশ একটি চরম বৈষম্যপূর্ণ দেশ পরিণত হয়েছে, দেশটি সার্বিক অর্থেই খাদের কিনারে! রাজনীতির অশুভশক্তির বিরামহীন চর্চা কিছু মানুষকে আলাদিনের চেরাগ ধরিয়ে দিয়েছে। সে চেরাগের লেলিহান শিখা পুরো দেশটিকেই খেয়ে ফেলছে। কিন্তু অবধারিতভাবেই সে শিখা নেভানোর সক্ষমতা এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। দেশের মানুষকে দিতে হচ্ছে এর মাশুল বা চড়ামূল্য।
অসহায় হয়ে পড়া দেশের মানুষ এখন যা দেখছে সেগুলো অন্যায্যতার পাহাড়ের একেবারে যৎকিঞ্চিত এবং এগুলো বিবেচনাহীন, নির্দয়, আপাত আশ্চর্যজনক বা স্বাভাবিক বোধের বাইরে মনে হতেই পারে। তবে দৃশ্যমান আলোচিত এরূপ প্রচ্ছায়া কয়েকটির অন্তরালে এ জাতীয় ঘটনার সহস্র প্রবাহ চলছে দেশে ক্ষমতাবৃত্তভূক্ত শ্রেণিটির মধ্যে এটি ধারণাই করা যায় এবং এর ফলে পুরোপুরি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে দেশের সত্যিকারের অগ্রগতি।
জার্মান দার্শনিক ও মনোবিদ এরিক ফ্রম অগ্রগতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ছয় দশক আগে বলেছিলেন, ‘অগ্রগতি কেবল তখনই ঘটে, যখন অর্থনীতি, আর্থরাজনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিসরে স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন হয়। এর কোনো একটা ক্ষেত্রে অগ্রগতি যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে অন্য যেকোনো জায়গার অগ্রগতিটা বাধাগ্রস্ত হয়’।
এই যে ‘অন্য যে কোনো জায়গায়’ অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে,সকল মানুষ যুক্ত করে যে অগ্রগতি সেটি এখানে বাধাগ্রস্ত করে রাখা হয়েছে মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য এবং মুষ্টিমেয় মানুষের দ্বারা। এই বাধার শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার কোনো ক্ষীণ আশাও মানুষের সামনে নেই। এখানে অর্থনীতি, আর্থরাজনীতি, সাংস্কৃতিক পরিসরে স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন তো এক অলীক কল্পনা !
মোতাহার হোসেন চৌধুরী : গবেষক ও রাজনীতি-অর্থনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন