অধ্যাপক ড. মো: ছিদ্দিকুর রহমান
প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৪, ০৬:২৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে

চলমান শিক্ষক আন্দোলনের দ্রুত যৌক্তিক সমাধান জরুরি

অধ্যাপক ড. মো: ছিদ্দিকুর রহমান
সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলসহ তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ছবি : সংগৃহীত
সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলসহ তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ছবি : সংগৃহীত

২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দিন বদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন করেছিল তাতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ১০.১ ধারায় শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতন কাঠামো ও স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন এবং স্বতন্ত্র কর্মকমিশনের কথা বলা হয়।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ সামাজিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে সব স্তরের, ধারার শিক্ষকদের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা এবং দায়-দায়িত্বের বিষয় গভীরভাবে বিবেচনা করে তা পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়।

সেখানে বলা হয় যে, প্রকৃত অর্থে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা দেওয়া না হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে শিক্ষকদের দেশবিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয় এবং শিক্ষাখাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রাপ্ত বৈদেশিক বৃত্তি ও প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়। আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়নের কথাও বলা হয়।

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট নাগরিক আবশ্যক। এ কারণেই স্মার্ট গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে হবে এবং সেটি করতে হলে স্মার্ট শিক্ষক আবশ্যক। এ লক্ষ্যে অবশ্যই কালক্ষেপণ না করে ২০০৮ সালে প্রতিশ্রুত নির্বাচনী সনদ ও ২০১০ সালের প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

যে জনগোষ্ঠী পেনশনভোগী নয় তাদের অন্তর্ভুক্তির জন্য সর্বজনীন পেনশন নামে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা– এ চারটি স্কিম চালু করা হয়। অথচ যেখানে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ সুবিধা ও ভবিষ্যৎ আর্থিক সুরক্ষা জরুরি, সেখানে ১৩ মার্চ ২০২৪ তারিখে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হলো।

এ স্কিমটি ২০২৪ সালের ৩০ জুনের পরে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন, তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হলো। এতে এ শিক্ষকেরা কীভাবে তাদের পেনশনের ক্ষেত্রে আর্থিক সুবিধাবঞ্চিত হবে তার বিভিন্ন দিক ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিন্ন দিক নিয়ে পরিসংখ্যানের আলোকে তা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আলোচনা করা হলো।

২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে ২০২৩ সালে বিভিন্ন মাসে যে মুদ্রাস্ফীতি ছিল, তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতির উপাত্ত দেওয়া হয়েছে। সে উপাত্তের জ্যামিতিক গড় নিয়ে আমি মুদ্রাস্ফীতির চিত্র নির্ণয় করেছি। ২০২৩ সালে গড় মুদ্রাস্ফীতি ছিল খাদ্যে ১০.০৪ এবং খাদ্য বহির্ভূত আইটেমে ৯.১২।

ধরা যাক, একটি শিক্ষক পরিবারের ২০২৪ সালে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য খরচ মাসে গড়ে ২৩ হাজার টাকা হতে ৩৯ হাজার টাকা এবং খাদ্য বহির্ভূত খরচ মাসে গড়ে ৩২ হাজার টাকা হতে ৮৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ, ২০২৪ সালের গড় মাসিক খরচ ৫৫ হাজার টাকা হতে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এই অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি প্রতি বছর অব্যাহত থাকলে ৩৬ বছর শেষে একই জীবন-যাত্রার মান ধরে রাখার জন্য উক্ত শিক্ষক পরিবারের গড় মাসিক খরচ দাঁড়াবে ১৪ লাখ ৬১ হাজার ১০০ টাকা হতে ৩২ লাখ ৮১ হাজার টাকা প্রায়। এটি হবে একটি ভয়াবহ অবস্থা।

এবার কাঙ্ক্ষিত গড় গড় মুদ্রাস্ফিতি যদি খাদ্যে ৭.০০ এবং খাদ্য বহির্ভূত আইটেমে ৬.০০ হয় এবং এটি যদি প্রতি বছর অব্যাহত থাকে, তবে ৩৬ বছর শেষে একই জীবন-যাত্রার মান ধরে রাখার জন্য উক্ত পরিবারের গড় মাসিক খরচ দাঁড়াবে ৫ লাখ ২৩ হাজার টাকা হতে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা প্রায়।

এ কারণে গড় মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মুদ্রাস্ফিতিকে একটি কাঙ্ক্ষিত সীমার মধ্যে রাখার কোনো বিকল্প নেই। তাই দেশের মানুষের জীবন-যাত্রার মান ঠিক রাখার জন্য মুদ্রাস্ফীতির সাথে মিল রেখে সরকারকে পরিকল্পনা সাজিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হয়। এ জন্য সরকারকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে মিল রেখে মহার্ঘভাতা ও পে-স্কেল প্রণয়ন করতে হয়।

উপরিউক্ত শিক্ষক যদি ৩০ জুন, ২০২৪ এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ৩৬ বছর পর পেনশনে যান, তাহলে তিনি পেনশনসহ অন্যান্য যে সুযোগ সুবিধা পাবেন তার পরিমাণ কত হবে তা মনে হয় আর পরিসংখ্যান বা অঙ্ক করে দেখানোর প্রয়োজন নেই। সেটা হবে সর্বশেষ বেতন স্কেলের ভিত্তিতে।

এবার যদি উপরিউক্ত শিক্ষক ৩০ জুন ২০২৪ এর পরে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন এবং ৩৬ বছর চাকরি করার পর অবসরে যান, তাহলে তিনি কিন্তু প্রত্যয় স্কিম অনুসারে মাসিক মাত্র ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা করে আজীবন পেনশন পাবেন। পেনশনার যদি ৭০ বছর বয়সে মারা যান, তবে পেনশনারের স্পাউস মাত্র পরবর্তী ৫ বছর প্রতি মাসে একই হারে পেনশন পাবেন, স্পাউসের বয়স এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, পেনশনার বা তার স্পাউস আর কোনো আর্থিক সুবিধা পাবেন না। অথচ তখন মাসিক খরচের পরিমাণ ৫ লাখ ২৩ হাজার টাকা থেকে ১১ লাখ ৭ হাজার টাকা হতে পারে ওপরের হিসাব অনুসারে যদি মুদ্রস্ফীতি খাদ্যে ৭ শতাংশ এবং খাদ্য বহির্ভূত আইটেমে ৬ শতাংশ এর মধ্যে ঘোরাঘুরি করে। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, তখন পেনশনার এবং তার স্পাউস প্রত্যয় স্কিমে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

এজন্য যেসব ব্যবস্থা সরকারকে নেওয়া প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম হলো ঘুষ-দুর্নীতি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা। একটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে যে জনগোষ্ঠী ভূমিকা রাখবে তাদের স্মার্টভাবে গড়ে তোলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দেওয়া অতীব জরুরি। সুতরাং অতি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কিম থেকে প্রত্যাহার করে ইশতেহারে প্রতিশ্রুত আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি।

অধ্যাপক ড. মো. ছিদ্দিকুর রহমান: শিক্ষক, পরিসংখ্যান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক সহসভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কৃষ্ণচূড়ার লালে লাল কুমিল্লার পথঘাট

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াত

ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে কঠোর নির্দেশনা রাজউক চেয়ারম্যানের

রাঙামাটিতে পিকআপ-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ৫

বৈশাখী মেলায় জুয়া ও অশ্লীল নাচ, প্যান্ডেলে আগুন দিল বিক্ষুব্ধ জনতা

ব্যাংক এশিয়ায় চাকরির সুযোগ

ভারতীয় যুদ্ধবিমান থেকে ধাতব বস্তু পড়ে বাড়ি বিধ্বস্ত

ভারতের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে পাকিস্তানের সব দল

রোমে বাংলাদেশ হাউস পরিদর্শন প্রধান উপদেষ্টার

কাশ্মীরে দুপক্ষের মধ্যে আবারও গোলাগুলি

১০

সিন্ধুতে হয় পানি, না হয় ভারতীয়দের রক্ত ​​বইবে : বিলাওয়াল ভুট্টো

১১

গান লিখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরও করলেন

১২

আবহাওয়া নিয়ে ঢাকাবাসীর জন্য কোনো ভালো খবর নেই

১৩

ভারতের বিষয়ে সৌদি আরবকে জানাল পাকিস্তান

১৪

এক বাইকে ঘুরতে বের হয় ৩ বন্ধু, পথে প্রাণ গেল একজনের

১৫

কুয়েটের ভিসি-প্রোভিসিকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন

১৬

পহেলগামে হামলা / ঘটনার ১০ মিনিট পরই কীভাবে মামলা হলো, বাড়ছে সন্দেহ

১৭

সীমান্তে বিজিবি-বিএসএফ সাক্ষাৎ, জিরো লাইন পরিদর্শন 

১৮

২৬ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৯

যুদ্ধের শঙ্কায় ‘অপারেশন রুমে’ ব্যস্ত পাকিস্তান

২০
X