কালবেলার ফেসবুক পেজে (Kalbela Online) বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ‘গণমাধ্যমে ভিসানীতি কি বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ?’ বিষয়ে পাঠকের মতামত জানতে চাওয়া হয়। সেখান থেকে বাছাইকৃত ২০টি মতামত প্রকাশ করা হলো।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমকেও যুক্ত করার কথা শোনা যাচ্ছে। একটি দেশের গণমাধ্যম এবং এর কর্তাব্যক্তিদের বিষয়ে এ ধরনের হস্তক্ষেপ বিষয়ে পাঠকদের মধ্যে দুই ধরনের অবস্থান লক্ষ করা গেছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভিসা নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করে মো. জহিরুল ইসলাম লেখেন, ‘স্কুল-কলেজে পড়ার সময় শিক্ষকরা আমাদের সংবাদপত্র পড়ার জন্য উৎসাহ এবং আদেশ দিতেন। বিশেষ করে সম্পাদকীয় কলাম পড়তে বলতেন। কিন্তু আফসোস! বর্তমানে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম বিশেষ দলের গোলামির জিঞ্জির গলায় নিয়ে দলের ব্যক্তির গুণকীর্তন, তেলবাজি, অপরাধ ডাকা দেওয়াসহ অন্যায় আচরণ করছে। এ অবস্থায় দেশের নিরীহ মানুষ যখন কিছুই করতে পারছে না, তখন আন্তর্জাতিক তৎপরতা জরুরি বলে মনে করি। তাই গণমাধ্যমের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা কোনোভাবেই বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়।’
স্বাধীন দেশের গণমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগকে সমর্থন না করলেও নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার পক্ষে সাখাওয়াত এইচ রাব্বি লেখেন, ‘গণমাধ্যমে ভিসানীতি অবশ্যই বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। তবে বাছাইকৃত কিছু গণমাধ্যমে ভিসানীতি বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়। গণমাধ্যমকে হতে হবে আপসহীন এবং সদা সত্য উপস্থাপনে নির্ভীক। কিন্তু গণমাধ্যম যদি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সমর্থন করে তবে ভিসানীতি বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়; বরং আমরা এটিকে ‘‘লাগাম টানা’’ বলতে পারি।’
ভিন্নমতের পাঠকও কম নন। পরিমল দাস মনে করেন, ‘গণমাধ্যমে ভিসানীতি গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের শামিল, যা গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে বাধার সৃষ্টি করে।’
নাজমুল ইসলাম লেখেন, ‘এটি পুরোপুরি একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। দেশের আইন অনুযায়ী গণমাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীন। গণমাধ্যম কোনো কিছু লঙ্ঘন করলে রাষ্ট্র দেশের আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের নাকগলানো পুরুপুরি অবৈধ এবং বাইডেন সরকারের জন্য লজ্জাজনক।’
আলমগীর হোসেন লেখেন, ‘গণমাধ্যমকে ভিসানীতিতে যুক্ত করার আদৌ কোনো যুক্তি রয়েছে কি না আমার জানা নেই। গণমাধ্যম বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টা নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। আমাদের দেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাহলে কেমন হয়।’
গণমাধ্যমে ভিসানীতির ফলে এর কর্মীরা মানসিক চাপে ভুগবেন বলে মনে করেন মো. স্বাধীন মালিক। তিনি লেখেন, ‘আমি মনে করি, গণমাধ্যমে ভিসানীতি বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। গণমাধ্যমে ভিসানীতি আরোপ হলে এর কর্মীদের কাজ ৫০% বাধাগ্রস্ত হবে। কাজের মানসিকতা হারিয়ে যাবে। কারণ গণমাধ্যম হচ্ছে সংবাদ প্রকাশের একটি মাধ্যম, যা নিম্নশ্রেণি থেকে উচ্চপর্যায়ের সব ধরনের খবর এবং গণমানুষের মতামত প্রকাশ করে। গণমাধ্যম ছাড়া অন্য সবখানে ভিসানীতি আরোপ করতে পারে।’
তবে স্বাধীন মালিকের মতো পাঠকদের মতামতের সঙ্গে একমত নন বড় একটি অংশ। তারা মনে করেন বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে এ চাপ কার্যকর হবে। কিন্তু কীভাবে তারও ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে পাঠকরা লেখেন,
মনিরুল ইসলাম : বরং বাংলাদেশের বাকস্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে আমেরিকার ভিসা সীমাবদ্ধতা নীতি কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে।
মো. আবদুল নুর : গণমাধ্যম যদি জনগণের কাছে সঠিক সংবাদ তুলে না ধরে, তাহলে তাদের ভিসানীতির আওতায় নিয়ে আসা উচিত।
কেএম ইয়ার হোসেন : দালাল মিডিয়া ছাড়া সবার বাকস্বাধীনতা আগে থেকেই খর্ব করা হয়েছে। অতএব দালাল মিডিয়া ছাড়া এ নিষেধাজ্ঞায় কোনো মিডিয়ার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।
এস রহমান : আমেরিকা যদি সত্যিই এই নীতি করে থাকে তাহলে সেটা গণমাধ্যমের বাকস্বাধীনতা খর্ব করবে। এ ব্যাপারে আমি শতভাগ একমত। তবে সেই গণমাধ্যম কারা? তারা হলো একদল চাটুকার, মেরুদণ্ডহীন, লেজুড়বৃত্তিক গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের মেরুদণ্ডই যদি সোজা না থাকে তাহলে সেই গণমাধ্যম দেশের জন্য ক্ষতিকর। সুতরাং ভিসানীতি যদি দুর্বল গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করতে পারে তাতে আপত্তি কি?
এসএম মাহাদি হাসান : গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপ করা হলে তা আমাদের সরকারের ব্যর্থতা। এর জন্য সরকার দায়ী। সাংবাদিকরাও দায় এড়াতে পারেন না। আমরা স্বাধীন হয়েও অন্য রাষ্ট্র আমাদের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে বা ভিসানীতি প্রয়োগ করছে। এ বিষয়টি আমাদের জন্য লজ্জাজনক।
আলিম উদ্দিন দুর্জয় : বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো তার পেশাদারত্বের জায়গা থেকে সরে গিয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের এজেন্ট হিসেবে গত এক যুগের বেশি সময় ধরে নিপীড়নের অংশীদার হিসেবে কাজ করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের উল্টো অবস্থান নিয়েছে। সংগত কারণেই বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর বর্তমান অবস্থানের প্রেক্ষাপটে ভিসানীতির মধ্যে পড়াটা একদম যুক্তিযুক্ত।
তন্ময় আহমেদ কামাল : বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভুয়া সংবাদ সম্প্রচার করা হচ্ছে। এতে দেশের মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। এ জন্যই ভিসানীতি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তাই গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ করলে তা ভুল হবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মো. তাজুল ইসলাম ফুল মিয়া : গণমাধ্যমে ভিসানীতি বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হতে যাবে কেন? তারাতো বাকস্বাধীনতা উন্মুক্ত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যম নিরপেক্ষ না হয়ে যখন একপাক্ষিক চাটুকারিতা করে, সাংবাদিকতার নামে হলুদ সাংবাদিকতা করে তখনি বাধ্য হয়ে সেসব গণমাধ্যমকে ভিসানীতির আওতায় আনা হচ্ছে। এতে গণমাধ্যম সঠিক রাস্তায় ফিরে আসবে বলে মনে করছি।
মোজাম্মেল হক : যেসব দালাল সাংবাদিক শুধু সরকারের গুণগান করার জন্য গণভবনে যান এবং সরকারি টাকা খরচ করে সরকারের সফর সঙ্গী হওয়ার জন্য দিনরাত সরকারের গুণকীর্তন করেন, তাদের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয়েছে।
মো. সাজ্জাদ হুসেন : বর্তমান পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমে ভিসানীতি বাকস্বাধীনতার জন্য সহায়ক। কারণ, বর্তমানে গণমাধ্যমের একাংশের মধ্যে একপক্ষকে তুষ্ট করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করে একটি পক্ষকে তুষ্ট করছে। ভিসানীতি প্রয়োগে কিছুটা যদি নিরপেক্ষ ভূমিকায় গণমাধ্যম ফিরে আসে, তাতে জনগণ সুস্থ, সঠিক তথ্য জানতে পারবে।
মো. ইদান খান : বাংলাদেশের গণমাধ্যমের প্রতি দেশের মানুষের নূন্যতম আস্থা নেই । কারণ, গণমাধ্যমে দেশের গণমানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে না। গণমাধ্যমের কার্যক্রমে মানুষ হতাশ। লেজুড়বৃত্তিক, মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রচার করারই যেন গণমাধ্যমের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হলুদ সাংবাদিকতার কারণে মানুষ বর্তমানে গণমাধ্যমকর্মীদের সুবিধাভোগী শ্রেণি হিসেবে মনে করে। তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞায় সাধারণ মানুষ উল্লাস করবে, এটাই এখন স্বাভাবিক। এমনকি তারা মারা গেলে মানুষ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে দ্বিধা করবে না। এগুলো হচ্ছে মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
খান মাহি : মোটেই হস্তক্ষেপ নয়। গণমাধ্যম হচ্ছে আয়নার মতো। যেখানে বিভিন্ন বাস্তবিক তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়। যখন এসব গণমাধ্যম পক্ষপাতমূলক আচরণ করে বা পক্ষপাতমূলক তথ্য প্রচার করে অথবা বাস্তবিক তথ্য তুলে না ধরে অপ্রাসঙ্গিক তথ্যে মনোনিবেশ করে তখন গণতন্ত্রকে আয়নার পেছনে রাখা হয়। মানুষ তখন তথ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। গণমাধ্যমই গণতন্ত্র বিকাশের অন্যতম বাহক। তাই গণমাধ্যম হওয়া উচিত নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও পক্ষপাতহীন। মার্কিন এই নিষেধাজ্ঞা গণমাধ্যগুলোকে তাদের প্রকৃত কার্যাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে এবং দালালি প্রতিবেদন হতে বিরত রাখবে।
আসাদুল্লাহ নোমান : গণমাধ্যমে ভিসানীতি বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়। কারণ, নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে কেন? একটু সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যই তো। আর সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হলে গণমাধ্যমকে অসত্য এবং পক্ষপাতমূলক সংবাদ প্রচার বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের অনেক মিডিয়া সরকারের পক্ষে ভুয়া সংবাদ প্রচার করে। এ জন্য আমেরিকা গণমাধ্যমের ওপরও ভিসানীতি প্রয়োগ করছে। এটি বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়। বাক স্বাধীনতা হলো সত্য সংবাদ প্রচার। কোনো অসত্য, পক্ষপাতিত্বমূলক সংবাদ প্রচার করা বাকস্বাধীনতা নয়।
মো. সাইফুল আজম : লেজুরবৃত্তিক গণমাধ্যম বা গণমাধ্যম ব্যক্তিদের ওপর ভিসানীতির প্রয়োগ কখনোই বাকস্বাধীনতার হস্তক্ষেপ নয়। বাংলাদেশে বিদ্যমান গণমাধ্যম এখন আর গণমানুষের কথা বলে না। তারা বলে সরকারের কথা। তারা করে সত্যের অপলাপ। বাংলাদেশে বর্তমানে যত গণমাধ্যম আছে তার ৯৫ ভাগই সরকারকে তোষামোদ করে সংবাদ প্রকাশ করে বা করতে বাধ্য হয়। কিছু কিছু গণমাধ্যম তো একেবারেই নির্লজ্জের মতো সরকারের গোলামের ভূমিকা পালন করে। এসব গণমাধ্যম এবং তাদের পদস্থ কর্মকর্তাদের ওপর ভিসানীতির প্রয়োগকে আমি সমর্থন করি।
গ্রন্থনা : আব্দুল্লাহ আল মাছুম
মন্তব্য করুন