প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সংস্কার কাজ করে। ভীষণ রকমের সংস্কার কাজ করে। এই সংস্কার একান্তই ব্যক্তিগত এবং তা অন্য কারও কাজে আসে না। মুসলিম বা হিন্দু হিসেবে একজন যেভাবে ধর্ম পালন করেন তাতে অন্য কারও কোনো অসুবিধাও হয় না। তবে তরুণদের মধ্যে এখন নিজের ধর্ম পরিচয়ের বিষয়ে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। এটা ঘটছে মূলত ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাবে।
আমাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সম্পূর্ণটাই আমরা ইউরোপীয় সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। আমাদের এখনকার লেখাপড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সবকিছুই ইউরোপীয়দের থেকে ধার করা। এমনকি এখনকার তরুণ প্রজন্ম ইউরোপীয় সংস্কৃতিকেই বেশি সম্মানজনক সংস্কৃতি মনে করে। ছোটবেলায় আমাদেরকে ধর্ম শেখানো হয় কিন্তু নিজের ধর্ম এবং সংস্কৃতির প্রতি মূল্যবোধ শেখানো হয় না। এর ফলে তরুণরা যখন আজকের প্রভাবশালী ইউরোপীয় সংস্কৃতির সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে তখন নিজেদের অস্তিত্বকে সংকটাপূর্ণ বলে মনে করছে।
শহরের শিক্ষিত শ্রেণির তরুণদের মধ্যে এমনটা বেশি দেখা যাচ্ছে যে, অনেকে নিজের ধর্ম পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। ধর্ম পরিচয়ে তারা অস্বস্তি বা হীনমন্যতায় ভুগছে। নিজের একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয়কে তারা ভাবছে সেকেলে। ধর্মীয় পরিচয় না থাকাটাকেই তারা ভাবছে আধুনিকতা।
আমাদের এই জাতির মধ্যে একটি পারফেকশন আসতে আরও ২০-৩০ বছর সময় লাগবে। পশ্চাত্য দেশগুলোতে বাচ্চাদের শিশু ক্লাস থেকেই সৌজন্যবোধ, মার্জিত বোধ, শ্রেয় বোধ ও মূল্যবোধের ওপর যে চর্চা হয় বা শিক্ষা দেওয়া হয় আমাদের দেশে কোথাও সেটা নেই। সঙ্গত কারণেই আমাদের মধ্যে অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। আরও তিনটা জেনারেশনের পর আমাদের একটি নিজস্ব পারসেপশন আসবে যেমনটা এসেছে ইউরোপে।
তরুণদের অনেকের মধ্যে আরেক ধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে তাদের লিঙ্গ পরিচয়ে। ছেলে নিজেকে মেয়ে ভাবতে পছন্দ করছে আবার মেয়ে নিজেকে ছেলে ভাবতে পছন্দ করছে। এটাও পশ্চিমা সংস্কৃতির ফল। তবে এমন নয় যে, সারা দেশে ব্যাপকভাবে এমনটা ঘটছে। বরং দেখা যাচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে এমনটা ঘটছে। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে এই জিজ্ঞাসাগুলো উন্মুক্ত করে দেয়। একটা ছেলেকে এটা ভাবার সুযোগ দেয় যে, আমি মেয়ে হলে কেমন হবে। আবার একটা মেয়েকে ভাবার সুযোগ দেয় যে, সে ছেলে হলে কেমন হবে। ফলে তরুণরা পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবেই এই ধরনের অস্থিরতার মধ্যে পড়ছে।
সম্প্রতি অভিশ্রুতি নাকি বৃষ্টি এই বিতর্কে আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে অনেক শিরোনাম হয়েছে। জনমানুষের মধ্যেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে ঘটনাটি। বৃষ্টি একটি মুসলিম পরিবারের মেয়ে কিন্তু সে নিজেকে হিন্দু ধর্মীয় পরিবারে জন্ম বলে এবং নিজেকে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দেয়। তার এই কর্মকাণ্ড বা মানসিক রূপান্তরের বিষয়ে অনেক প্রশ্ন আসে সামনে। হয়তো তার মধ্যেও ধর্ম নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা বা অ্যাডভেঞ্চার জেগেছিল যে এ রকম করে দেখি কি হয়। অনেক তরুণের মধ্যেই এ ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
তরুণদের মধ্যে জাতীয় মূল্যবোধ তৈরিটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। একটি জাতীয় পারসেপশন তৈরি হওয়াটা জরুরি। তরুণ প্রজন্মের কাছে নিজের সংস্কৃতির সম্মানবোধটা তৈরি করে দিতে হবে আমাদেরকেই।
ড. নেহাল করিম: সাবেক অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন