‘মানসম্মত শিক্ষা’ বিষয়টি আমরা প্রতিনিয়তই আমাদের চারপাশে শুনতে পাই, কথায় কথায় আমরা বলি বর্তমানকালে আমরা শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষাদান করছি তা মানসম্মত নয়। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল ঈর্ষণীয় পর্যায়ে গেলেও আমরা বলি ফল ভালআ হয়েছে কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আসলে মানসম্মত শিক্ষা কী? কী শিক্ষা গ্রহণ করলে বা কীভাবে গ্রহণ করলে শিক্ষাকে আমরা মানসম্মত বলব সে বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের থাকা দরকার।
বস্তুত এককথায় মানসম্মত শিক্ষা কী তা সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। বিভিন্ন শিক্ষাবিদ বিভিন্নভাবে হয়তো বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করবেন তবে কিছু বিষয় সবার মতামতের ক্ষেত্রেই সাধারণ বা কমন থাকে আর সেগুলোর মধ্য দিয়েই আমরা বলতে পারি মানসস্মত শিক্ষা আসলে কী। মূলত মানসম্মত শিক্ষা হচ্ছে একগুচ্ছ বিষয়, তারমধ্যে পাবলিক পরীক্ষার ফল ওই গুচ্ছের একটিমাত্র অংশ। কাজেই পাবলিক পরীক্ষায় উচ্চতর গ্রেড পাওয়াকেই আমরা মানসম্মত শিক্ষা বলতে পারি না।
মানসম্মত শিক্ষা মানে কি ক্যাডেট কলেজে, ভিকারুন্নেসা, রাজউক, আইডিয়াল বা নটরডেমে পড়া? মানসম্মত শিক্ষা মানে কি জিপিএ-৫ পাওয়া কিংবা সব বিষয়ে এ প্লাস বা গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া? মানসম্মত শিক্ষালয় মানে কি হোমওয়ার্ক দিয়ে শিক্ষার্থীদের সর্বদাই চাপের মধ্যে রাখা? মানসম্মত শিক্ষা মানে কি ঘনঘন অভিভাবক সভা ডাকা?
আসলে যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আমারা খুব ভালআ বা মানসম্মত শিক্ষালয় বলে থাকি সেগুলোর দিকে একটু তাকালে আসলে আমরা কী দেখতে পাই? এ প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি করেনা বা তৈরি করার মেকানিজমও তাদের নেই। তারা হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী বাছাই করে। বাছাই প্রক্রিয়াও কোনো ধরনের সৃজনশীলতা বা মেধা তৈরির কথা বলে না। শুধু পাবলিক পরীক্ষায় কী ধরনের প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয় সেই আদলে কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে তাদের বাছাই করা হয়। এভাবে বাছাই করার পর শুরু হয় একটির পর একটি পরীক্ষা, জোর করে প্রাইভেট পড়ানো, পড়াতে পড়াতে কোনো একটি বিষয়কে তেঁতো করে ফেলা হয়। তারপর পাবলিক পরীক্ষায় তারা অবতীর্ণ হয় যেখানে ওইসব বিষয়গুলোই তারা দেখতে পায়। তাই পরীক্ষায় ভালো করে। সবাই বাহবা দেয়। শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুল ও কলেজে যেসব বিষয়গুলো বারবার করে প্রাকটিস করেছে, যেগুলোর ওপরই তাদের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় , তাদের পঠিত বিষয়ের বাইরে থেকে যদি কিছু আসে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই তা পারে না। কিন্তুু তাদের সেভাবে প্রাকটিস করালে তারা কিন্তু পারতো। কিন্তু স্কুল কলেজেগুলো সে ধরনের প্রাকটিস করায় না কারন যদি পরীক্ষায় ভালো না করে। আর তারা তো নিশ্চিত, পরীক্ষায় বইয়ের বাইরে থেকে কিছুই আসবে না। এখন যে নামে সৃজনশীল বলা হচ্ছে তাতেও কিন্তু প্রকৃত সৃজনশীলতার অনুসরণ করা হয়না। বাজারে প্রাপ্ত গাইড বই থেকেই শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নেয় আর একই বিষয় কিন্তু পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে আসে, শিক্ষার্থীরা অনেক নম্বর পায়।
একজন শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর তার কতটুকু কী জানা উচিত? ২০১৫ সালের এক অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী বলেছিলেন, পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পড়তে পারেন, লিখতে পারে না, সাধারণ যোগ-বিয়োগও পারেনা। অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর কিংবা এসএসসি পাশ করার পর কোনো বিষয় তাদের কতটুকু জানা উচিত। এ বিষয়গুলো যেমন সব শিক্ষকদের জানা উচিত তেমন শিক্ষার্থীদেরও। কিন্তু আমরা জানি পরীক্ষায় কী আসবে। আর পরীক্ষায় একই ধরনের প্রশ্ন বছরের পর বছর আসতে থাকে। সেই পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করেই আমরা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানকে বলে থাকি , ‘মানসম্মত’ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আনন্দের মাধ্যমে সঠিক ধারণা দেওয়া, শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণেরর মাধ্যমে শিক্ষাদান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলো শ্রেণিকক্ষে নিশ্চিত করাটাও মানসম্মত শিক্ষাদানের মধ্যে পড়ে। একটি বিষয় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া, মুখস্থ করানো, সঠিক ধারণা শিক্ষার্থীদের না দিয়ে মুখস্থ করানো ইত্যাদি বিষয়গুলোই ঘটছে। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা অনেক নম্বর পেয়ে যাচেছ। এ অবস্থায় আমরা কী বলব, আমাদের শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করছে বা মানসম্মত শিক্ষা তাদের দেওয়া হচ্ছে?
আমরা আশা করব, অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর একজন শিক্ষার্থী নিজ ভাষায় অর্থাৎ বাংলায় সুন্দর করে নিজ সম্পর্কে লিখতে পারবে, দরখাস্ত করতে পারবে, প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পারবে। কিন্তু অনন্য ব্যতিক্রম ছাড়া অনেকেই পারে না। গণিত বা বিজ্ঞান যে কোনো বিষয়েই হোক প্রশ্ন সব সময় ট্রাডিনশাল। ট্রাডিশনের বাইরে গেলেই শিক্ষার্থীরা আর পারছে না। গণিত একটু ফিগার পরিবর্তন করে দিলেই আর পারেনা। ইংরেজির ক্ষেত্রে ভয়াবহ অবস্থা। তাদের ইংরেজিতে কথা বলে কমিউনিকেট করতে শেখানো হয়না, ইংরেজি শুনে বুঝতে পারার প্রাকটিস করানো হয় না। নিজ থেকে কিছু লিখতে দিলে লিখতে পারে না, নিজ বইয়ের নির্দিষ্ট স্থানটুকু যেটুকু পরীক্ষায় আসবে সেটুকু ছাড়া বাইরের কিছু দিলে পড়ে বুঝতে পারেনা। অথচ ইংরেজিতে মার্কস পেয়ে যাচ্ছে আশি, নব্বই এবং একশর কাছাকাছি। এই অবস্থাই সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে, শিক্ষার্থীরা পাস করে যাচ্ছে, উচ্চতর গ্রেড পাচ্ছে কিন্তু মানসসম্মত শিক্ষা তারা পাচ্ছে না। একটি উদাহরণের মাধ্যমে আমরা আমাদের কী ধরনের শিক্ষা দিচ্ছি তা বোঝা যাবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেসব পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় সেগুলোর প্রশ্ন এরূপ ঢাকার অপর নাম কী? উত্তর : জাহাঙ্গীরনগর। এটি নিজের তৈরি করার কিছু নেই, যে মুখস্থ করবে সে জানবে, যে করবে না সে জানবে না। কিন্তু প্রশ্নটি যদি এরূপ হতো ঢাকার অপর নাম জাহাঙ্গীরনগর কেন? এটি বিশ্লেষণমূলক। শিক্ষার্থীদের চিন্তায় ফেলে দেবে। তাদের চিন্তন দক্ষতা বাড়বে, বিশ্লেষণমূলক ক্ষমতা বাড়বে। কিন্তু এই ধররেন প্রশ্ন শিক্ষার্থীরা দেখে না, তাদের এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্ততও করা হয় না।
আবার যারা সত্যিকার অর্থে এই অবস্থার মধ্যেও বিজ্ঞান ও গণিতে ভালো করছে, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাগ্রিকালচার কিংবা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ভালো বিষয়ে ভর্তি হচ্ছে। সেখানেও কৃতিত্বের সাথে পাস করছে। পাস করার পর আবার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশের সরকারি চাকরিতে যোগদান করছে। যোগদান করার পর ডাক্তারদের উচিত সহানুভূতির সাথে রোগীদের সাথে কথা বলা কারণ চিকিৎসা শুধু রোগ নির্ণয় করে ওষুধ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, রোগীকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার জন্য তার সাথে ভালোভাবে কথা বলতে হয়, তার মনে সাহস যোগাতে হয়, তার কী হয়েছে সে সম্পর্কে ব্যাখ্য দিতে হয়। কিন্তু আমাদের ডাক্তাররা কী করেন? কয়েক সেকেন্ড দেখার পরেই রোগীর সাথে কোনো ধরনের কথাবার্তা না বলেই এক তরফাভাবে একটি প্রেসক্রিপশন লিখে দেন, অনেক ক্ষেত্রে তাদের হাতের লেখাও বোঝা যায় না। আমরা এখানেও বলতে পারি, ডাক্তার মানসম্মত শিক্ষা পাননি। আর একটি বিষয় তো স্পষ্টতই দেখা যায়, আমাদের দেশ থেকে মেডিকেল পাস করে যাওয়া ডাক্তারদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও তার স্বীকৃতি নেই, সেখানে আবার দু’তিন বছর মেডিকেলে পড়ার পর এমবিবিএস-এর স্বীকৃতি পান।
একজন ইঞ্জিনিয়ার পাস করার পর যখন কাজের বিনিমেয়ে ঘুস নেওয়ায় জড়িয়ে পড়েন তখন আমরা নিশ্চয়ই বলব, তিনি মানসম্মত শিক্ষা পাননি। অন্যান্য পেশায় কর্মরত কর্মকর্তারা জনগণের সেবক হওয়ার পরিবর্তে তাদের ভক্ষক, বস, মালিক ইত্যাদির ভূমিকায় নামেন। তার অর্থ হচ্ছে, তারা উপযুক্ত শিক্ষা পাননি। তারা যে দেশের এবং জনগণের সেবক তা তারা বুঝতে পারেন না অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষা পাননি।
স্কুল কলেজে পড়ার সময় শিক্ষার্থীদের কিছু বাস্তব সামাজিক দক্ষতা অর্জন করতে হয়। যেমন বড়দের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয়, ছোটদের কীভাবে স্নেহ করতে হয়, অচেনা একজন মানুষকে কীভাবে সম্বোধন করতে হয় ইত্যাদিও কোয়ালিটি এডুকেশনের আওতায় পড়ে। আর তা না হলে বিষয়ে ভালো হয়ে ডাক্তার হবে এবং শুধু রোগ আর ওষুধের নাম জানবে কিন্তু জানবে না সত্যিকারের মানবতা। কাজেই আমাদের শিক্ষার্থীদের শুধু উচ্চ নম্বর প্রাপ্তির ব্যবস্থা ও নিশ্চয়তা না করে তার পাশাপাশি সামাজিক দক্ষতা, মানবতা, প্রয়োজনীয় মানবিক গুণাবলি এবং যেসব বিষয় তারা পড়ে সেগুলোর সঠিক ধারণা দেওয়ার দিকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষা বর্তমানে দিচ্ছি তা কতটা মানসম্মত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তির মাধ্যমেই তা বুঝা যায়। তিনি বলেছেন- ‘শিক্ষক দোকানদার, বিদ্যাদান তার ব্যবসায়, নোটের নুড়ি কুড়াইয়া ডিগ্রির বস্তা বোঝাই করিয়া তুলিতেছে, কিন্তু তাহা জীবনের খাদ্য নহে।’
মন্তব্য করুন