হে দেশ মাতা, একাত্তরে হাজার বছরের পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত হওয়ার পর তুমি নিশ্চয় আশায় বুক বেঁধেছিলে যে তোমার সন্তানরা পরাধীনতার গ্লানি-মুক্ত আলো-বাতাসে বেড়ে উঠবে এবং তোমাকে মর্যাদার শিখরে তোলে পৃথিবীর রাণীর আসনে বসাবে। তোমার এ ধারণা মোটেও অমূলক নয়। প্রত্যেক দেশ মাতার এমন আশা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তুমি নিশ্চয় সম্যক অবগত।
তোমার গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত। তোমার অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসহ সকল প্রতিষ্ঠান খোলস সর্বস্ব। তোমার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসনিক এবং বিচার ব্যবস্থায় জনগণের কোনো আস্থা নেই। তোমার সন্তানরা পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ এবং রেষারেষি-হানাহানিতে ব্যস্ত। তাদের অন্তর জটিলতা, কুটিলতা, প্রতিহিংসাপরায়নতা এবং পরশ্রীকাতরতায় পরিপূর্ণ। তোমার অর্থনীতি চরম দুর্দশাগ্রস্ত এবং তুমি আজ দেশি-বিদেশি ঋণের জালে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আজ তোমার স্বাধীনতার মর্যাদাও প্রশ্নবিদ্ধ। তোমার সন্তানদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা পরাধীন কিংবা স্বৈরাচারী আমল থেকেও সীমিত।
বিদেশে তোমার ভাবমূর্তি প্রচণ্ড সংকটে। আগে তোমার সন্তানরা তো ভিসা ছাড়া অনেক দেশ ভ্রমণ করতে পারত। আর এখন তো সেই সকল দেশের ভিসার জন্য অমর্যাদাহীনভাবে দীর্ঘ লাইন-এ দাঁড়াতে হয়। সবুজ পাসপোর্টধারী তোমার সন্তানদের আজ পৃথিবীর কোনো বিমানবন্দরে মর্যাদার চোখে দেখা হয় না। কোথাও কোথাও আমাদের ইমিগ্রেশনের লাইন থেকে আলাদা করে অপেক্ষা করতে বলা হয়। আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সহযাত্রীরা আমাদের অসহায়ত্ত দেখে করুনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এসব দেখে খুব প্রয়োজন না হলে আমি কোনো দেশে যেতে চাই না। কিন্তু, তোমার অন্য সন্তানদের তো জীবিকা-শিক্ষা-ব্যবসা কিংবা চিকিৎসার জন্য বিদেশে ছুটতে হচ্ছে। তাহলে তারা কি এভাবে অপমান-অপদস্ত হতে থাকবে?
আবার তোমার সন্তানরা যারা হজ করতে যায় তারা অন্য দেশের হাজিদের তুলনায় বেশি অর্থ ব্যয় করেও তাদের তুলনায় কম সুযোগ-সুবিধা পায়। আর মর্যাদায় তো বাংলাদেশি হাজিরা কেবল আফ্রিকার দরিদ্রপীড়িত কিছু দেশের হাজিদের সাথে তুলনীয়। মক্কাতে বাংলাদেশি হাজিরা যেসব এলাকায় থাকে, কাবা শরিফের সেসব এলাকার গেটগুলো দায়িত্বরত প্রহরীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো নোটিশ ছাড়া বন্ধ করে দেয়। আর মিনাতে বাংলাদেশি হাজিদের জন্য বরাদ্দকৃত তাঁবুর ধরন এবং টয়লেট ব্যবস্থাপনার বাজে চিত্র হয়তো আর দ্বিতীয়টি নেই।
কিন্তু, কেন তোমার এ দশা? তোমার তো সবই ছিল। তোমার উর্বর মাটির সমতুল্য পৃথিবীতে তো কোনো মাটি নেই। তোমার মাটিতে আঙুলের চাপে ফল-ফসলের বীজ বপন করা যায়। তা কি পৃথিবীর অন্য কোথাও সম্ভব? তোমার বুক চিরে যত নদি-নালা প্রবাহিত হয়েছে তা পৃথিবীর অন্যত্র কোথাও নেই। তুমি সৌন্দর্য্যমণ্ডিত কাশ্মীর কিংবা ইউরোপের দিকে তাকাও- সেখানে কি এত নদী-নালা খাল বিল আছে? তুমি নদী-নালা খাল-বিল পরিবেষ্টিত সবুজে ঠাঁসা এক অপূর্ব দেশ মাতৃকা যার কোনো তুলনা নেই। তোমার আলো-বাতাস তো পৃথিবীর সেরা। এত মৃদু-মন্দ বাতাস আর রোদ্রোজ্জল আকাশ তো পৃথিবীর কোথাও নেই। আর ঋতু বৈচিত্র্যে তুমি তো তুলনাহীন।
তাহলে কীসের অভাবে তুমি আজ নিঃস্ব ও রিক্ত? তোমার সন্তানরা কি হাবা-গোবা? না, তা মোটেও নয়। তোমার সন্তানরা এই মাটির পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ মেধাবী। আর তার কারণ-তোমার মাটি, পানি, আলো-বাতাস, ঋতু বৈচিত্র্যতা এবং তোমার মমতার ছায়া। তবে কি প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব তুমি আজ নিজেকে গুটিয়ে রেখেছো। কে বলেছে তোমার প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব আছে? তোমার সুন্দরবন পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। তোমার কক্স'স বাজার সৈকত পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ সমুদ্র সৈকত। তুমি বান্দর বন, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, সিলেট এবং মৌলভীবাজারে ইউরোপের সকল সৌন্দর্য বিছিয়ে রেখেছ। হ্যাঁ, তোমার খনিজসম্পদ কিছু কম। তোমার তা বেশি দরকার নেই। তোমার সন্তানের কেউ তেলের খনি, কেউ সোনার খনি কিংবা কেউ হীরকের খনি হয়ে উঠার মতো মেধা আছে। আর খনিজসম্পদ বেশি থাকলে তো বর্গী, ব্রিটিশ রাজ কিংবা পাকিস্তানিদের মতো নূতন উপনিবেশিক মোড়লরা তোমার বুকে আবারও লুটতরাজ চালাবে।
তবে তোমার সন্তানরা কি ভীরু, কাপুরুষ, ঘরকুনো কিংবা অলস? তা মোটেও নয়। তার সাক্ষী তো তুমি নিজেই। একাত্তরে বাঁশের লাঠি এবং গাঁদার বন্দুক হাতে নিয়ে কীভাবে বীরবিক্রম করে মাত্র নয় মাসে তোমাকে হানাদার মুক্ত করেছিলাম। যদিও স্বৈরশাসকের পতন ঘটাতে ৯ বছর লেগেছিল। সেও তো তোমার সন্তান, তাই আমরা তাকে একটু সময় দিয়েছিলাম। কিন্তু সে যখন সীমা অতিক্রম করল, তখন তাকে কোনো ছাড় দেয়নি। দেখছো না রুটি-রুজির সন্ধানে তোমার সন্তানরা স্নেহময়ী মা, সদ্য বিবাহিত স্ত্রী কিংবা শিশুসন্তান রেখে জীবন বাজি রেখে বন, জঙ্গল, পাহাড় ডিঙিয়ে কিংবা প্লাস্টিকের ভেলায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশে ভিড় করছে। মরুর দেশে তপ্ত বালুতে সামান্য বেতনে ১৮ ঘণ্টা ঘাম ঝরাচ্ছে। বিদেশে তোমার সন্তানদের নামে ফাঁকিবাজ, চোর কিংবা অন্য কোনো অপবাদ নেই। বরং তারা সৎ, একনিষ্ঠ এবং পরিশ্রমী হিসাবে পরিচিত। তোমার সন্তানরা ধর্মভীরু, অতিথি পরায়ণসহ আরও নানা গুনে গুণান্বিত।
স্বাধীন পথচলার মাত্র ৫৩ বছরে তাহলে কেন ঘরে-বাইরে সর্বত্রই তুমি আজ মর্যাদাহীন এবং পর্যদুস্ত? এর প্রধান কারণ হলো তোমার সন্তানরা শুধু ব্যক্তিগত সুবিধা বা সুখ খোঁজে। অন্য কথায়, প্রত্যেকে যে কোনো মূল্যে শুধু একা ভালো বা সুখী থাকতে চায়। এক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায় বিচার করেনা কিংবা যুক্তিতর্ক এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করে না । কেউ চায় না অন্যরা তার থেকে বেশি ভালো বা সুখে থাকুক। তাই অন্যের দুঃখে অনেকে ব্যথিত হতে পারলেও কেউ অন্যের সুখে সুখী হতে পারে না। কেবল অর্থকে তারা ভালো থাকার বা সুখী হওয়ার একমাত্র উপায় হিসাবে বিবেচনা করে। তাই ন্যায়-অন্যায়ের বাদ-বিচার না করে কবরের মাটি কিংবা শ্মশানের চিতার আগুন স্পর্শ করা না পর্যন্ত অর্থের পিছনে ছুটছে।
প্রত্যেকেই চায় ভালো কিছু কিংবা সেরাটা শুধুই তার থাকবে। আর উচ্ছিষ্ট যদি কিছু থাকে তা প্রতিবেশী বা দেশবাসীর জন্য। ফলে সবার কপালে উচ্ছিষ্টই জোটে। আবার প্রত্যেকেই চায় যে কোনো মূল্যে সবকিছু তাকেই আগে পেতে হবে। নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা শৃঙ্খলা, আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতি পালনের মোটেও তোয়াক্কা করে না। ফলে সর্ব ক্ষেতেই আমরা অন্যায়-অবিচার এবং বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত । এক কথায়, তোমার সন্তানরা বিসৃঙ্খলার এক ভয়ঙ্কর ভাইরাস-এ পরিণত হয়েছে যার প্রভাব দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রবাসেও পড়ছে।
তুমি আমাদের শেখাতে পারোনি যে, একা ভালো থাকা যায় না, বরং ভালো থাকার মূল মন্ত্র হচ্ছে সামষ্টিক ভাবে ভালো থাকা। ‘ইন্ডিভিজুয়াল কনভেনিয়েন্স ইজ দি মাদার অব অল কালেকটিভ ইনকনভেনিয়েন্সেস'- করোনা মহামারির এই সর্বজনীন শিক্ষা আমরা কেউ শিখিনি। তোমার শিক্ষিত সন্তানরাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। ইউরোপ এই শিক্ষা শিখেছে ১৪-১৭ শতাব্দীতে রেনেসাঁর সময়। পরবর্তীকালে অন্যান্য জাতিও শিখেছে। এই শিক্ষা ইসলামী দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু তোমার সন্তানদের বেশিরভাগ মুসলিম হলেও কেউ এই শিক্ষা রপ্ত করিনি। আমাদের অগ্রজদের কাছ থেকে এই শিক্ষা কেউ পাইনি। এই মৌলিক শিক্ষার অভাবেই তোমার সন্তানরা দিশা হারা, পথ হারা এবং কাণ্ডারি হারা । আমরা প্রত্যেকেই স্বেচ্ছাচারী এবং ক্ষমতার ছোয়া পেলে সবাই স্বৈরাচারী হয়ে যাই। যাকে যেখানে বসানো হচ্ছে শুধু নিজে বা ব্যক্তিগতভাবে ভালো থাকার নিমিত্তে প্রতিষ্ঠান গিলে খাচ্ছে। কেউ কেউ আবার আস্ত দেশটাও গিলে খাচ্ছে। এই রাঘব বোয়াল গোছের সন্তানদের অন্তহীন ক্ষুধার জন্যই তোমার সব থাকতেও কিছুই নেই।
এ থেকে মুক্তি পেতে শিশু শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগতভাবে ভালো থাকার পরিবর্তে সামষ্টিকভাবে ভালো থাকার শিক্ষা দিতে হবে এবং এই শিক্ষা অনুশীলনের জন্য ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। এই শিক্ষা কার্যক্রম এখন শুরু করলে সমাজে তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতে তিন জেনারেশন (অর্থাৎ ৫০-৬০ বছর) লাগবে। তাই সময় থাকতে তোমার সন্তানদের দায়িত্বশীল অংশকে বোঝাও তারা যেন নিজেরা সামষ্টিকভাবে ভালো থাকার শিক্ষা রপ্ত করে তা সকল ক্ষেত্রে অনুশীলন করে এবং অন্যেদের তা অনুশীলনে উৎসাহিত করে। আর তা না হলে ১০০ বছর পেরোনোর আগেই তুমি খোলস সর্বস্ব এক ধূসর ভূখণ্ডে পরিণত হবে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
মন্তব্য করুন