মালদ্বীপে এসে বহুদিনের পুরোনো সাধটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। সাধটি হচ্ছে মহাসাগরে মৎস্য শিকার। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে ভারত মহাসাগরে মৎস্য শিকার। ছোটবেলা থেকেই বড়শি দিয়ে মাছ ধরা আমার শখ। কিন্তু সাগর বা মহাসাগরে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা বা সাহস কোনোটাই আমার হয়নি কোনো দিন। বয়স হয়ে গেলে অনেকের সাহস কমে, আবার অনেকের নাকি বেড়ে যায়। আমি কোন দলে ঠিক বুঝতে পারছি না। অনেকের বড়ো হতে দেরি লাগে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্বন্ধেই বলেছিলেন, ‘আমি বড় হয়েছি অনেক দেরিতে”।
মালদ্বীপের প্রতিটি দ্বীপ আসলে এক একটা আলাদা বিচ্ছিন্ন রাজ্য, সারা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। আমরা যে দ্বীপে ছিলাম ওদের ম্যানেজমেন্টকে জানালে এবং পর্যাপ্ত ইচ্ছুক মৎস্য শিকারি পাওয়া গেলে ওরা রাতে দ্বীপ থেকে বেশ দূরে ভারত মহাসাগরের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যায় বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জন্য। আমি আর আমার ষোলো বছরের ছেলে মিলে ঠিক করলাম আজ রাতেই যাবো মাছ ধরতে। স্ত্রী আর কন্যা কিছুটা বিরক্ত হলেও শেষমেশ বাধা দিলো না।
সূর্য যখন ডুবুডুবু তখন একটা বড়ো আকারের স্পিডবোটে করে আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হলো ভারত মহাসাগরের সেই নির্দিষ্ট স্থানে। আয়োজকরা জানে কোথায় বেশি মাছ পাওয়া যায়। আমি ভেবেছিলাম অনেক শিকারি উঠবে বোটে। কিন্তু দেখলাম তা না, শিকারি উঠেছে মাত্র ছয়জন। আমি আর আমার ছেলে বাদে এক মাঝ বয়সী ইতালীয় দম্পতি ও তার ছেলে এবং একজন লিকলিকে লম্বু হাঙ্গেরিয়ান যুবক। মিনিট চল্লিশেক প্রচণ্ড গতিতে চলার পর স্পিডবোট সেই নির্দিষ্ট স্থানে নোঙর ফেললো। তখন চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে, আকাশে শুক্লা ত্রয়োদশীর চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চাঁদের নীলাভ মায়াবী আলোয় ভারত মহাসাগরের উত্তাল জলরাশি ছোট্ট খেলনার মতো বিরামহীন ভাবে দুলিয়া যাচ্ছে বোটটিকে। চারিদিকে অদ্ভুত ঘোরলাগা একটা পরিবেশ, পুত্র সহ এমন পরিবেশে আমার ভয় লাগার কথা কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে আমার ভয় লাগছিলো না। শুধু ভাবছিলাম, এমন অন্ধকারে মাছ ধরবো কী করে, বড়শির ফাৎনা দেখবো কীভাবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। বিরামহীন দুলুনির কারণে দাঁড়িয়ে থাকাই ছিল দুঃসাধ্য।
এমন অবস্থায়, নোঙর ফেলা হয়ে গেলে আমাদের সবার হাতে কালো কুচকুচে একজন মালে গাইড একটা করে বড়শি ধরিয়ে দিলো। বড়শিগুলোর না ছিল কোনো ছিপ, না ছিল কোনো ফাৎনা। শুধু একটা গোলাকার প্লাস্টিকের রিংয়ে সুতা পেঁচানো আর বড়শিতে গাঁথা হলো টুনা ফিশের এক টুকরো মাংস। বড়শির ওপরেই প্রায় ১০০ গ্রাম ওজনের একটা গোলাকার সিসা বাঁধা, তাই পানিতে ফেলতেই পুট করে বড়শিসহ সুতা খুব দ্রুত ভারত মহাসাগরের অন্ধকার পানির মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগলো। সুতো ছাড়ছি তো ছাড়ছি, কিন্তু অনেকক্ষণ পরেও বড়শির তলিয়ে যাওয়া শেষ হচ্ছিল না। একপর্যায়ে সুতো স্থির হলো, তখন বুঝতে পারলাম বড়শি এখন মহাসাগরের তলদেশ স্পর্শ করেছে। ঘোর কাটিয়ে আমিও কিছুটা স্থির হলাম।
বড়শির দিকে মনোনিবেশ করার আগে মালে গাইডের কাছে কিছু পরামর্শ চাওয়ার আশায় তাকিয়ে দেখি তিনি কৈলাসের উঁচুদরের সন্ন্যাসীর মতো গভীর উদাস দৃষ্টি নিয়ে তাকেয়ে আছেন জোৎস্না মাখা আকাশের দিকে, মৎস্য শিকারের মতো জগতের তুচ্ছ ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নেই। তবে অন্য দুই মালে তাদের নিজেদের ভাষায় বকবক করেই যাচ্ছিলো। মালেরা যখন কথোপকথন করে তখন কি বলে বোঝা না গেলেও কিছু কিছু শব্দ পরিচিত মনে হয় ,তাই ওদের কথা শুনতে আমার বেশ ভালোই লাগে।
মালেদের নিজেদের এ ভাষাকে বলে ধিবেহী ভাষা বা দিবেহী ভাষা । পৃথিবীর মাত্র চার লাখের মতো মানুষ এ ভাষায় কথা বলে । মালদ্বীপ ছাড়াও ভারতের লক্ষদ্বীপেরও হাজার দশেক মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। পৃথিবীর প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে তাই মাত্র চার লাখ লোকের ভাষাকে আমাদের ছোট ভাষা বলে মনে হতে পারে কিন্তু পৃথিবীতে এমন ভাষাও আছে যে ভাষায় এখন শুধুমাত্র একজন মানুষ কথা বলতে পারে। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের সোলোমন দ্বীপের তানিমা ভাষা বা পেরুর আমাজন অঞ্চলের পিঞ্চি ভাষায় এখন শুধুমাত্র একজন করে মানুষ কথা বলতে পারে। এদের দু’জনের মৃত্যুর পর এ ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। সত্যি করে বলতে গেলে বর্তমানে প্রতি চল্লিশ দিনে পৃথিবী থেকে এমনি ভাবে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে।
মাছের গল্প থেকে ভাষার গল্পে চলে গেলাম, আবার মাছের গল্পে ফিরে আসি। আমি বোটে উপস্থিত মালে মৎস্য শিকার বিশেষজ্ঞ বা ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করলাম, মাছ খোট দিলে বুঝবো কীভাবে। উনি বললেন, চোখ বন্ধ করে তোমার সমস্ত ধ্যান তোমার আঙুলে পেঁচানো সুতার ওপর নিবিষ্ট করো। মহাসাগরের সীমাহীন জলরাশির ওপর এমন উছলে পড়া চাঁদের আলোয় বেরসিকের মতো কেমন করে চোখ বন্ধ রাখি। আমি চোখ খোলা রেখেই যতোটা সম্ভব আঙুলে সুতার টান অনুভব করার চেষ্টা করছি। একটু পরেই দেখলাম ইতালীয় দম্পতি চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। তারা দুজনে মিলে একটা মাছ টেনে তুলে ফেলে দ্বিতীয়বার বড়শি ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে তবে তার স্ত্রীর আনন্দ চিৎকার তখনো শেষ হয়নি। তার ছোট ছেলেটা বাবার অদ্ভুত প্রতিভায় বিস্মিত হয়ে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে মাছটা দেখছে। খুব সম্ভবত সে জীবনে প্রথম কোনো জীবন্ত মাছ দেখছে। ওদিকে হাঙ্গেরিয়ান যুবককে দেখলাম মাছ ধরার দিকে তেমন মনোযোগ নেই, সে তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে আর একটু পরপর নিজে নিজেই বলছে, Shit, oh shit…
এমন না যে বড়ো কোনো মাছ তার বড়শি থেকে ছুটে গেছে বা মাছ ধরায় তার আদৌ কোনো আগ্রহ আছে। তবু সে ক্রমাগত কিছু সময় পরপর বলছে, Shit, oh shit…
ওই ব্যাটা ‘হাঙ্গেরিয়ান শিট’ কে দেখলাম নিতান্ত উত্তেজনাহীন ভাবে সুতা তুলছে আর আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে তার বড়শিতে উঠে এসেছে একটা চকচকে মাছ। বোটে থাকা মালে মৎস্য ওস্তাদ বললো এটি Bluestripe Snapper. মাছ দেখে হাঙ্গেরিয়ানের মধ্যে কোনো উত্তেজনা নেই, ঠিকমতো সে মাছের দিকে তাকালোও না, শুধু বললো, Shit, oh shit.
ওদিকে ইতালীয় দম্পতির দ্বিতীয় Bluestripe Snapper ধরার আনন্দ চিৎকার শুরু হয়েছে। আমি আর আমার ছেলে বোকার মতো একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি। আমরা তখন পর্যন্ত আমাদের আঙুলে কোনো মাছের টানই অনুভব করিনি, মাছ ধরা তো বহু দূরের কথা। একদিকে ইতালি অন্যদিকে হাঙ্গেরি আর আমরা বাপ-বেটা দুই খাস মাছের দেশের বরিশাইল্লা বাঙাল, বোকার মতো এদিক-সেদিক তাকাচ্ছি আর বারবার বিনা কারণে বড়শি উঠিয়ে টোপ বদল করছি।
আমার মতো যারা আধা পাকা মাছ শিকারি তাদের একটা সর্বজনীন রোগ আছে, সেটা হচ্ছে যখনই মাছ না ধরা দেয় তখন জায়গার দোষ দিয়ে জায়গা বদল করা। আমরা দুই বাপ-বেটাও তাই করলাম। আমরা জায়গা বদল করে ইতালীয়রা যেদিকে মাছ ধরছিল সেই দিকে আমাদের দুটি বড়শি ফেলে আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকলাম। আর যাই হোক রাষ্ট্রীয় মান-ইজ্জতের ব্যাপার, ততক্ষণে হাঙ্গেরিয়ান আবার তার মুখমণ্ডলে মহা বিরক্তিভাব দেখিয়ে তার দ্বিতীয় Bluestripe Snapper ধরে ফেলেছে। অর্থাৎ ইতালি ২, হাঙ্গেরি ২, বাংলাদেশ ০
আমি এবার কোনো উপায়ান্তর না দেখে বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে চাঁদের জ্যোৎস্নাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বোটের ওস্তাদের কথামতো চোখ বন্ধ করে অনেকটা হিমালয়ের ধ্যানমগ্ন সাধুর মতো আমার ডান আঙুল উঁচু করে সুতার টান অনুভব করার জন্য সম্পূর্ণ মনোযোগ নিবিষ্ট করলাম। মনে হলো ধ্যানে কাজ হচ্ছে, হঠাৎ আঙুলে হালকা একটা মৃদু টান অনুভব করলাম। আল্লাহর নামে দিলাম এক রাম টান। টানের চোটে আমার আঙুল কেটে যাওয়ার মতো অবস্থা; কিন্তু সুতা একটুও উঠলো না। আমি ভাবলাম বিরাট মাছ, তাড়াতাড়ি সেই উদাস মালে ওস্তাদকে ডাক দিলাম। সে সুতা ধরে টান দিয়ে নির্মোহ ভাবে শুধু বললো, কোরাল।
অর্থাৎ আমার বড়শি প্রবাল শিলায় আটকে গেছে। ওস্তাদ বললো, বঁড়শি যখন একদম তলদেশ স্পর্শ করবে তখন তাকে টেনে ৩ থেকে ৪ ফুট ওপরে উঠিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে হবে, তাহলে বড়শিও প্রবালে আটকাবে না আবার মাছ ধরার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। কেননা মাছেরা প্রবালের ওপর দিয়ে ঘোরাঘুরি করতে বেশি পছন্দ করে। ওস্তাদজি কী এক অদ্ভুত কৌশলে হাত বাঁকিয়ে একটা মৃদু টান দিলেন আর সঙ্গে সঙ্গে বড়শি ছুটে গেলো।
আমি এবার মহাসাগরের তলদেশ থেকে চার-পাঁচ ফুট উঁচুতে বড়শি ফেলে ধ্যানমগ্ন সাধুর মতো চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। আমার পুত্রও আমাকে অনুসরণ করলো। কিছুক্ষণ পর আবার খুব জোরালো একটা টান অনুভব করলাম আর সঙ্গে সঙ্গে দিলাম, আবার এক রাম টান। উত্তেজনায় আমার সারা তখন শরীর কাঁপছে। আমি দক্ষ জেলের মতো খুব দ্রুত সুতা টানতে লাগলাম। মিনিটখানেক পরে যখন সুতা ওঠানো শেষ হলো তখন আবিষ্কার করলাম মাছ তো নেই-ই আমার বড়শিও নেই। আমি সঙ্গে সঙ্গে মালে ওস্তাদকে দেখালাম, স্বল্পভাষী ওস্তাদ সেই একই নির্মোহ স্বরে শুধু বললো, বারাকুডা।
অর্থাৎ, ভয়াবহ এক বারাকুডা হাঙর আমার বড়শি কেটে নিয়ে গেছে। আমি হতোদ্যম হলাম না, ভাবলাম মাছ পাই আর না পাই, ভারত মহাসাগরের একটা ভয়ানক বারাকুডা তো আমার বড়শি গিলেছে। এই সীমাহীন মহাসাগরের নিচে একটা অচেনা হাঙরের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক তো স্থাপিত হলো। এই বারাকুডা পুরুষ না মহিলা কে জানে, তবে পুরুষ বা মহিলা যা-ই হোক তাকে নাকে নোলক পরার মতো আমার বড়শি আর গোলাকার সিসার এ অলংকার পরে বেড়াতে হবে সারা জীবন। এটাই বা কম কী, আর ও দুই ইউরোপীয় তো ধরেছে ছোট ছোট মাছ আর আমি তো ধরতে গিয়েছিলাম বিশাল বারাকুডা। বীর বাঙালি মারে তো গণ্ডার আর লুটে তো ভাণ্ডার।
তবে মুখে যতোই গণ্ডার মারি না কেন ততক্ষণে ইতালীয়রা তাদের তৃতীয় মাছ ধরে ফেলেছে আর এবারেরটা আগেরগুলোর চেয়ে বেশ বড়ো। মালে ওস্তাদ বললো, এটার নাম Bluefin Trevally.
অন্যদিকে হাঙ্গেরিয়ানও তার তৃতীয় Bluestripe Snapper ধরে আর একবার উচ্চারণ করলো, Shit, oh shit. অর্থাৎ, ইতালি ৩, হাঙ্গেরি ৩, বাংলাদেশ ০
ততক্ষণে আমরা দুই বাঙাল আসন্ন পরাজয়ের লজ্জায় কুঁকড়ে গেছি আর ওই ব্যাটার “শিট শিট” শুনতে শুনতে মহাবিরক্ত হয়ে উঠছি। তবে মাছ ধরার প্রধান অস্ত্র হচ্ছে অটল ধৈর্য, আমরা দুজন আবার সেই ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে শুরু করলাম। ওস্তাদ আমাকে আবার নতুন বড়শি লাগিয়ে দিলো। আমি বড়শি ফেলে একাগ্রচিত্তে আবার ধ্যানগম্ভীর স্তরে চলে গেলাম। কতক্ষণ এমন ধ্যানগম্ভীর স্তরে ছিলাম মনে করতে পারি না, হঠাৎ আঙুলের ডগায় একটা মৃদু টান অনুভব করলাম। আর যায় কই, দিলাম এক টান। বুঝতে পারলাম কিছু একটা বিঁধেছে। সুতা টানতে টানতে শেষমেশ দেখি একটা Bluestripe Snapper আমার বঁড়শি গিলে লাফাচ্ছে। এবার আমার পুত্রের বিকট আনন্দ চিৎকারে বোটের সবাই হকচকিয়ে গেলো। অবশেষে অন্তত মানইজ্জত তো কিছুটা হলেও রক্ষা হয়েছে। আমি এবার চোখ বন্ধ করে বললাম, আল্লাহ, আমার পুত্র অন্তত একটা ছোট মাছ হলেও যেন পায়। আমার প্রার্থনা আল্লাহ মনে হয় শুনলেন। দেখলাম পুত্র আমার খুব জোরে সুতা টানছে আর বলছে, বাবা, মনে হয় কিছু একটা পাইছি।
সত্যি সত্যি দেখা গেলো সেও ভারত মহাসাগর থেকে একটা Bluestripe Snapper বঁড়শিতে বিঁধিয়ে তুলে ফেলেছে। তখন আমার কী যে আনন্দ লাগছিল তা আমি ভাষায় বোঝাতে পারবো না। ছেলেমেয়েদের আনন্দে বাবা-মা যে কত বেশি গুণ আনন্দিত হয় তা ছেলেমেয়েরা বোঝে অনেক পরে, যখন বোঝে তখন আর বেশি সময় হাতে থাকে না। দেখতে না দেখতেই আমি আঙুলে আবার একটা টান অনুভব করলাম আর এবার মহা উত্তেজনায় টেনে তুললাম একটা মাঝারি আকারের কমলা রঙের মাছ। স্বল্পভাষী ওস্তাদকে দেখলাম এবার খুব খুশি, সে বললো, এটা Two Spotted Red Snapper, তোমার মাছটাই সবচেয়ে সুস্বাদু।
তারপর অনেকক্ষণ বড়শি ফেলে আমরা সবাই বসে রইলাম; কিন্তু আমাদের কেউই আর কোনো মাছ পেলাম না। একসময় আমাদের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলো, আমরা সবাই বড়শি গুটিয়ে নিলাম আর আমাদের বোট আবার আমাদের দ্বীপের দিকে চলতে শুরু করলো। অর্থাৎ, ‘ওস্তাদের মাইর শেষ রাইতে’-এর কারণে ট্রায়াংগুলার সিরিজ ড্র। ফাইনাল স্কোর, বাংলাদেশ ৩, ইতালি ৩, হাঙ্গেরি ৩
ইতালীয় ভদ্রলোককে দেখলাম সে এ সময়টাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তার স্ত্রী আর সন্তানের ছবি তুলতে চাচ্ছে; কিন্তু বোটের দুলুনির কারণে সুবিধা করে উঠতে পারছে না। আমি বললাম, তুমি তোমার পরিবারের সঙ্গে বসো, আমি তোমাদে ছবি তুলে দিই। গ্রাদজিয়ে, গ্রাদজিয়ে বলতে বলতে সে মহাখুশিতে তার স্ত্রী আর সন্তানকে জড়িয়ে ধরে পোজ দিলো আর আমিও পটাপট চার-পাঁচটা ছবি তুলে দিলাম।
ফিরতে ফিরতে ওস্তাদ বললো যে, আমরা যদি ১৬ ডলার দিই তাহলে আমাদের চারটা মাছ গ্রিল করে রেস্টুরেন্টে এক ঘণ্টার মধ্যে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। আমি তাকে আমাদের পিতা-পুত্রের দুটো Bluestripe Snapper আর আমার Two Spotted Red Snapper গ্রিল করে দিতে বললাম। তখন ইতালীয় ভদ্রলোক বললো আমরা যদি চার নম্বর মাছ হিসেবে তার ধরা Bluefin Trevally-টাও গ্রিল করে খাই তাহলে সে খুব খুশি হবে। আমি বোটের ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করলাম যে এগুলো কোনো বিষাক্ত মাছ কি না। পটকা মাছ খেয়ে তো আমাদের দেশের অনেক মানুষ মারা যায়। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার এক মফস্বল শহরে একবার এক রেস্টুরেন্টে এক কোরিয়ান বন্ধু আমাকে লাঞ্চের দাওয়াতে একটা আস্ত সুইট সাওয়ার ফিশ অর্ধেক খাওয়ার পর বলেছিল যে, ওই প্রজাতির মাছ খুব দামি আর বিষাক্ত, শেফ যদি অভিজ্ঞ না হয় তবে অনেক ক্ষেত্রে বিপদ হতে পারে। আমি ব্যাটার কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলাম। আরে ব্যাটা তুই আমাকে ওই জিনিস খাওয়ালি কেন আর খাওয়ালিই যখন তখন এ কথা মনে করিয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিল। বলাই বাহুল্য, এ কথা শোনার পর আমি টেবিলের আর কোনো খাবারই মুখে দিইনি সেদিন।
আমাকে আশ্বস্ত করে ওস্তাদ বললো, এগুলো খুব সুস্বাদু মাছ, হরহামেশা মানুষ এগুলো খাচ্ছে, এ নিয়ে আমার চিন্তা করার দরকার নেই। ততক্ষণে তীব্রগতিতে অন্ধকার ভেদ করে আমাদের বোট দুলে দুলে এগিয়ে চলছে। বাতাসে আমাদের সবার চুল উড়ছে। হাঙ্গেরিয়ানকে দেখলাম অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে একা একা কী যেন বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে। বোটের ইঞ্জিনের বিকট শব্দে ওর কোনো কথাই শোনা যাচ্ছে না। ঠিক তখনই আমার মাথার সেই পুরোনো ঝিঁঝি পোকা ডাকা শুরু করলো। এই ঝিঁঝি পোকার কাজ হচ্ছে আমার অজান্তেই আধা প্রাসঙ্গিক বা প্রায় অপ্রাসঙ্গিক বিষয় আমার মস্তিষ্কের চিন্তার সার্কিটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া।
যে চিন্তাটা আমার মাথার মধ্যে তখন ঘুরপাক খেতে শুরু হলো সেটা হচ্ছে, এ পৃথিবী সৃষ্টির আগেই তো সৃষ্টিকর্তা জানতেন যে ২০২২ সালের ৭ অক্টোবর রাত্র ৮টার সময় ভারত মহাসাগরের এ নির্দিষ্ট স্থানে এ দু’টি নির্দিষ্ট মাছ আমার হাতে ধরা পড়বে, ক্রনিক বিষাদগ্রস্ত এ হাঙ্গেরিয়ান ও এ মহাসুখী ইতালীয় দম্পতি আমাদের সফর সঙ্গী হবে। এ তিনজন মালে আমাদের সহযোগী হবে আর এমন ত্রয়োদশী চাঁদের ছিটকে পরা আলোয় ঠিক এ নির্দিষ্ট সময়ে আমরা সবাই এখানে একত্রিত হবো ও মোট নয়টি মাছ ধরবো আর একটি বারাকুডা তার গালে আমার বড়শি বিঁধিয়ে ফেলবে। সবকিছুই তিনি হুবহু জানতেন, তাঁর অজানা কিছু নেই, কিছু থাকতেই পারে না। কোরানে বলা হয়েছে,
“তাঁর কাছেই অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে। এগুলো তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা আছে, তিনিই জানেন। কোন পাতা ঝরে না; কিন্তু তিনি তা জানেন। কোন শস্যকণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুষ্ক দ্রব্য পতিত হয় না; কিন্তু তা সব প্রকাশ্য গ্রন্থে রয়েছে।“ (সুরা আল আন-আম, আয়াত ৫৯)
“পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয় আসে আমি তা সংঘটিত করার পূর্বেই তা লিপিবদ্ধ থাকে, আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ।“ (সুরা হাদিদ, ২২)
বাইবেলেও পূর্বেই সবকিছু লিপিবদ্ধ থাকার প্রায় একই রকম ভাবে বলা হয়েছে। বাইবেলের Contemporary English Version থেকে এমন একটা লাইন এখানে উল্লেখ করছি,
“Your eyes saw my embryo, and on your scroll every day was written that was being formed for me, before any one of them had yet happened.”
এতে তো মনে হয় সব কিছু পূর্বনির্ধারিত (Pre-destined), তাহলে তো আসলে আমাদের free will বলে কিছু নেই। আবার অন্যদিকে কোরানের বহু আয়াতে মানুষের free will-এর কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, যেমন,
‘শপথ পৃথিবীর এবং যিনি তা বিস্তৃত করেছেন, তাঁর, অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন, যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়। এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।’ (সুরা আশ-শামস, আয়াত ৬-১০)
এ আয়াতে তো প্রমাণিত হয় আমার free will ঠিকই আছে। নাকি শুধু মানুষের free will আছে, অন্য কারো নেই। অর্থাৎ ওই মাছ দুটির free will নেই কিন্তু আমার free will আছে, আমি হয়ত ইচ্ছে করলে মাছ ধরতে নাও যেতে পারতাম। আসলেই কি তাই?
আমি কি ইচ্ছে করলে নাও যেতে পারতাম? আমার যাওয়াটাও কি পূর্বনির্ধারিত না?
আসলে কোনোভাবেই সমীকরণটা না। হাজার বছর ধরে ইসলামি পণ্ডিতরা এ নিয়ে বিতর্ক করছেন কিন্তু সমীকরণটা কেউ ধরতে পারছেন না। ইসলামি পণ্ডিতদের মধ্যে দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দী ধরে তকদির নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে , এদের মধ্যে তাকদির নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন ইমাম গাজ্জালি। তিনি তার বিখ্যাত কিতাবুল কদর (Book of Divine Destiny) গ্রন্থে লিখছেন, What is not destined will not reach you, even if it be between your two lips.
অন্যদিকে দিকে আমাদের স্বামী বিবেকানন্দ সরাসরি ভাগ্যকে বাতিল করে দিয়ে বলেছেন, “ভাগ্য বলে কিছু নেই, যা আছে তা হলো শুধুমাত্র কর্মের ফল, যা প্রত্যেকের চেষ্টা ও যত্নের ফলে গড়ে ওঠে।“
আসলে মানবজাতি যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ বিতর্ক করেই যাবে, এর কোন সুরাহা হবে না, তবে আমার মনে হয় free will আর destiny-র মধ্যে একটা ম্যাজিক্যাল সমীকরণ আছে, যেটা সেই তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না । তিনি ইচ্ছে করলেই খুব সহজে এ সমীকরণটা মানবজাতিকে বুঝিয়ে দিতে পারেন কিন্তু তিনি ইচ্ছে করেই সেটা মনুষকে বুঝতে দেন না। তিনি এ নিয়ে রহস্য করেন, হয়ত রহস্য করতেই তিনি পছন্দ করেন আর জগতের এ গভীর রহস্যের আমরা কতোটুকিই বা জানি । সত্যি করে বলতে গেলে আমরা এর কিছুই জানিনা। সারা পৃথিবীর লেখকদের মহাগুরু লিও টলস্টয়ই তো বলেই দিয়েছেন, “The only thing that we know is that we know nothing — and that is the highest flight of human wisdom.”
বোটের নাবিকদের চিৎকারে হঠাৎ চিন্তার রেশটা কেটে গেলো, মাথার ভেতরে এতক্ষণ ধরে চলমান নিয়তি আর ফ্রি উইলের পরস্পর বিপরীতমুখী ঝিঁঝি পোকার জটিল ডাকাডাকি বন্ধ হয়ে গেলো। তাকিয়ে দেখি আমাদের বোট ধীরে ধীরে দ্বীপের পোতাশ্রয়ের ডকে ভিড়ছে। চাঁদের অবারিত রুপালি আলো মহাসাগরের বিরামহীন ঢেউয়ে ঢেউয়ে প্রতিফলিত হয়ে একটা অদ্ভুত সম্মোহনী বিভ্রম সৃষ্টি করেছে। এ এমন বিভ্রম যে এ থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না। আমি আর আমার ছেলে সেই সম্মোহনী চাঁদের আলোয় সাগরের পাড়ে বসানো বিশাল লম্বা কাঠের ডেকের ওপর দিয়ে মনের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়া অদ্ভুত এক সুখানুভূতি নিয়ে free will সহকারে নীরবে দ্বীপের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। নাকি আমরা যে এভাবে হেঁটে যাবো সেটাও পূর্বনির্ধারিত ছিল ?
মাহফুজুল হক জগলুল: স্থপতি
মন্তব্য করুন