প্রেম! ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু ধাক্কাটা দিতে পারে ভূমিকম্পের মতো! যারা প্রেমে মজেছেন, টুকটাক অভিজ্ঞতা আছে, তারাই বলতে পারেন যে এর মধ্যে অন্যরকম নেশা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- প্রেমে সফল হলে ভালো কিন্তু ব্যর্থ হলে কি কেউ মানসিক রোগী হয়ে যায়? নাকি এটা শুধু বাংলা সিনেমার ‘মেলোড্রামা’ আর রোমান্টিক কবি-সাহিত্যিকদের ‘কাব্যিক অতিরঞ্জন’?
বিজ্ঞান কী বলে?
প্রেম মূলত ব্রেইনের ডোপামিন সেরোটোনিন আর অক্সিটোসিন এর খেলা। প্রেমে ব্যর্থ হলে বা ‘রিলেশন ব্রেকআপ’ প্রেমিক প্রেমিকাদের প্রচণ্ড মানসিক পীড়া দেয়, কিন্তু এ দুঃখজনক ঘটনা সরাসরি প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে মানসিক রোগ তৈরি করে না। তবে যদি কারও মস্তিষ্কে মানসিক রোগের জন্য জিনগত প্রবণতা (Predisposing Factor) থাকে, তাহলে প্রেমে ব্যর্থতা ট্রিগার (Precipitating Factor) হিসেবে কাজ করতে পারে।
ধরুন, আপনার কাছে একটা লোডেড রিভলভার আছে। এটা হলো Predisposing Factor- অর্থাৎ জিনে বা পরিবারে মানসিক রোগ আছে। এখন যতক্ষণ না ট্রিগারে চাপ পড়ছে, গুলি বের হবে না। প্রেমে ব্যর্থ হওয়া, চাকরি হারানো বা অন্য বড় মানসিক ধকল হলো সেই Triggering Factor। ট্রিগার চাপলেই গুলি বের হবে!
অর্থাৎ, কেবলমাত্র প্রেমে ব্যর্থ হলেই মানসিক রোগ হবে না, আগে থেকেই নিকটাত্মীয়ের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার প্রবণতা থাকে, তাহলে সেটার প্রকাশ ঘটতে পারে।
সিনেমার মতো প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ‘বাউল’ হওয়া?
সিনেমায় দেখি, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কেউ রাস্তায় ছেঁড়া কাপড় পরে ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে, কেউ ল্যাম্পপোস্ট জড়িয়ে ‘ওগো প্রিয়া’ বলে কাঁদছে! বাস্তবে কি এমন হয়?
উত্তর : না, হয় না।
যদি সত্যিই প্রেমে ব্যর্থ হলেই মানুষ মানসিক ভারসাম্য হারাতো, তাহলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ট্রাফিক সিগন্যালে লাল-সবুজ বাতির বদলে ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকারা হাতে হারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো! ট্রাফিক কন্ট্রোল করতো।
বাস্তবতা হলো- প্রেমে ব্যর্থ হলে প্রেমিক প্রেমিকা কিছুদিন কষ্ট পান, মন খারাপ থাকে, হয়তো একটু গোপনে কাঁদেনও। কিন্তু ধীরে ধীরে বাস্তবতা অনুধাবন করেন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। তবে একটু সময় লাগে, জীবনের ঘটে যাওয়া একটি প্যাথেটিক ঘটনা ভুলতে কম হলে ৬ মাস সময় লাগে
বারবার প্রেমে জড়ানো বা বারবার ব্যর্থ হওয়া : এটা কি মানসিক রোগ?
কেউ কেউ বারবার সম্পর্কে জড়ান, বারবার ব্যর্থ হন, তবুও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে প্রেমে ঝাঁপ দেন! বিষয়টা কি কপালের দোষ, নাকি এর পেছনে বিজ্ঞান আছে?
বিজ্ঞান বলে, এ রকম বদ অভ্যাস Borderline Personality Disorder (BPD)-এর লক্ষণ হতে পারে। এই ব্যক্তিরা খুব দ্রুত আবেগের চূড়ায় ওঠেন, আবার খুব দ্রুত হতাশায় ডুবে যান। সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা অনেকসময় অনিশ্চিত আচরণ করেন। এদের মধ্যে ‘ইম্পালসিভিটি’, ‘সেক্সুয়াল প্রোমিসকুইটি’ ও ‘চিটিং গ্যাম্বলিং’ প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
একটি মজার কেস স্টাডি!
একবার আমি একটি দম্পতির কেস পেয়েছিলাম, যেখানে প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার পর দুজনেরই Schizophrenia Spectrum Disorder-এর লক্ষণ প্রকাশ পায়! পরে তদন্ত করে দেখা গেল- তাদের দুজনের পরিবারেই মানসিক রোগের ইতিহাস ছিল! প্রেমে ব্যর্থতা ছিল কেবল একটি কাকতালীয় ঘটনা, যা তাদের লুকানো মানসিক অসুস্থতাকে প্রকাশ করে দেয়। এই কেস নিয়ে আমার লেখা রয়েল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টস, ইংল্যান্ডের নিউজলেটারে প্রকাশিত হয়েছিল।
উপসংহার :
প্রেমে ব্যর্থতা কষ্টদায়ক, কিন্তু মানসিক রোগ সৃষ্টি করে না। তবে যদি কারও জিনে মানসিক রোগের প্রবণতা থাকে, তাহলে প্রেমে ব্যর্থতা সেটাকে ট্রিগার করতে পারে। তাই প্রেমে ব্যর্থ হলে হতাশ না হয়ে জীবনকে নতুনভাবে নেওয়া, জীবনে প্রতিষ্ঠিত লাভকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে সফল কাম হবার ধ্যান ধারণায় নিজেকে মনোনিবেশ করা উচিত।
লেখক : ডা. সাঈদ এনাম, এমবিবিএস (ডিএমসি,কে-৫২) এম ফিল সাইকিয়াট্রি, (বিসিএস -২৪), সহযোগী অধ্যাপক, সিলেট মেডিকেল কলেজ।
মন্তব্য করুন