২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সার্কুলারের মাধ্যমে প্রতি বছর মার্চ মাসের প্রথম সোমবার আর্থিক সাক্ষরতা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সে অনুযায়ী ২০২৩ সালের ৬ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আর্থিক সাক্ষরতা দিবস পালন করা শুরু হয়। একইভাবে আজ মার্চ মাসের প্রথম সোমবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে পালিত হচ্ছে আর্থিক সাক্ষরতা দিবস।
আর্থিক জ্ঞান অর্জন করা মানে শুধুমাত্র টাকা সঞ্চয় বা বিনিয়োগ করা নয়, বরং এটি একটি সুসংগত আর্থিক পরিকল্পনা, জ্ঞান এবং দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আর্থিকভাবে সক্ষমতা অর্জন করতে হলে আমাদের নিজেদেরকে আর্থিক দিক থেকে শিক্ষিত করতে হবে। এর ফলে আমরা চলমান জীবনযাত্রার বিভিন্ন বাধাগুলো মোকাবিলা করতে পারব এবং আমাদের ভবিষ্যৎকে আরও সুরক্ষিত করতে পারব।
আমাদের দেশের এখনো ৭২ শতাংশ মানুষ আর্থিক জ্ঞান থেকে দূর রয়েছে, এমনকি প্রায় ৩ কোটি মানুষ এখনো ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে আর্থিক জ্ঞানের বিকল্প নেই। আর্থিক জ্ঞান অর্জনের ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ ও সুরক্ষিত হতে পারে। একটি সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ গড়তে আর্থিক জ্ঞান অর্জনের ন্যূনতম ৪টি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে যেগুলো আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। ১. ব্যক্তি জীবনে আর্থিক জ্ঞানের গুরুত্ব :
ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনার মূল ভিত্তি হল আর্থিক জ্ঞান। আমাদের বাজেট পরিকল্পনা, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ঋণ পরিচালনার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে আর্থিক বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা যেমন সঞ্চয় স্কিম, নির্দিষ্ট মেয়াদের আমানত, ঋণ সুবিধা ইত্যাদি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে আমাদের এই জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আর্থিক জ্ঞান শুধু বর্তমান আর্থিক অবস্থাকে সুদৃঢ় করে না, ভবিষ্যতের জন্যও সঠিক পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
২. সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাধ্যমে সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ :
ব্যাংকিং সেবার অন্যতম গুরুত্বপুর্ন দিক হল সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগ। নিয়মিত সঞ্চয় করে এবং তা সঠিকভাবে বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা যে কোনো আর্থিক সংকট বা জরুরি অবস্থায় আমাদের নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারি। আমাদের ছোট ছোট সঞ্চয় বা বিনিয়োগগুলোও সময়ের সাথে সাথে বড় হতে থাকে, যেটি আমাদেরকে একটি সুদৃঢ় ও স্থিতিশীল আর্থিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিনিয়োগ পণ্য যেমন সঞ্চয়পত্র, ট্রেজারি বন্ড, ট্রেজার বিল, মিউচুয়াল ফান্ড, সিকিউরিটিজ ও বিমা পলিসি ব্যবহার করে আমারা আমাদের সম্পদের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারি এবং লাভজনক ফলাফল অর্জন করতে পারি।
৩. আর্থিক জ্ঞান অর্জনে ব্যাংকের ভূমিকা :
ব্যাংক শুধু আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম নয়, বরং এটি আর্থিক জ্ঞানের একটি শিক্ষণীয় প্ল্যাটফর্মও বটে। ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন আর্থিক শিক্ষা কর্মসূচি, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও নানাবিধ সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এই শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে আমরা সঠিক বিনিয়োগের কৌশল, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং ভবিষ্যৎ আর্থিক পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করতে পারি। ব্যাংকের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাবৃন্দ বা প্রতিনিধিগণ আমাদের আর্থিক লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।
৪. সঠিক ও দায়িত্বশীল আর্থিক পরিকল্পনা :
আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সঠিক ও দায়িত্বশীল আর্থিক পরিকল্পনা অপরিহার্য। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের আয়, ব্যয় এবং সঞ্চয়ের মধ্যে সঠিক সমন্বয় সাধন করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে খরচের হিসাব রাখা, অপ্রয়োজনীয় খরচ এড়ানো এবং ভবিষ্যতের জন্য সঠিক বিনিয়োগের পরিকল্পনা তৈরি করা এই পরিকল্পনার মূল উপাদান। ব্যাংকের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে আমরা সহজেই আমাদের খরচ, সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের হিসাব রাখতে পারি, যা আমাদেরকে আর্থিক স্বচ্ছতা এবং আর্থিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।
পরিশেষে ‘আর্থিক জ্ঞান অর্জন করি, সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ গড়ি’ এমন একটি প্রত্যয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সঠিক আর্থিক জ্ঞান এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা শুধু বর্তমান আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে পারি না, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি মজবুত ভিত্তি তৈরি করতে পারি। ব্যাংকের সহায়তায় আর্থিক শিক্ষা ও সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নতি নিশ্চিত করতে পারি। তাই, আসুন সবাই মিলে আর্থিক জ্ঞান অর্জন করি এবং একটি সুরক্ষিত, সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ি।
লেখক : এম এম মাহবুব হাসান, ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক ইমেইলঃ [email protected]
মন্তব্য করুন