তামাক একটি প্রাণঘাতী দ্রব্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাক ব্যবহারের ফলে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তামাক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে তামাক কোম্পানিগুলো নানামুখী কূটকৌশল অবলম্বন করে। তামাক কোম্পানির এ হস্তক্ষেপকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)’ বাস্তবায়নে অন্যতম একটি বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ৩টি তামাক কোম্পানি- ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল (পিএমআই), ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) ও জাপান টোব্যাকো (জেটি) সামগ্রিক তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডকে দুর্বল করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও তামাক কোম্পানির ভয়ানক কূটকৌশল থেকে মুক্ত নয়। দেশি-বিদেশি তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে আসছে। আর এই প্রভাবিত করার উপায় হিসেবে তারা নানামুখী কৌশল অবলম্বন করে থাকে, যার মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ, বিভ্রান্তিমূলক ফ্রন্ট গ্রুপ তৈরি, গবেষণায় সহায়তা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, সামাজিক অর্থায়ন এবং কৌশলী প্রচারণা ও অপপ্রচার অন্যতম।
বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়তই অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে আসছে। বিক্রয়কেন্দ্রে সিগারেটের প্যাকেট ডিসপ্লের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের জন্য বিক্রেতাদের মাসিক চুক্তিতে টাকা দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। সিগারেট বিক্রির বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়ে আকর্ষণীয়ভাবে দোকান সাজিয়ে দেওয়া, বিক্রেতাদের বোনাস, উপহার ও সুবিধা দেওয়া সহ নানাভাবে অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করছে তামাক কোম্পানিগুলো। এমনকি তামাক চাষিদের ভর্তুকি মূল্যের সার ও সেচ সুবিধাও দিচ্ছে তারা।
মূলত- তামাক কোম্পানিগুলো তাদের স্বার্থ হাসিলে আইনের সংশোধনী দুর্বল করে দিতেই ফ্রন্ট গ্রুপগুলোকে ব্যবহার করে। তামাক কোম্পানিগুলো প্রচারণা চালায় যে, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন হলে দেশে ৭০ লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর তথ্য অনুসারে দেশে বিড়ি কোম্পানিতে শ্রমিক নিয়োজিত আছে মাত্র ৪৬ হাজার। আর দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ বাজার দখলে রেখেছে দুই বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি বিএটিবি ও জেটিআই। তামাক কোম্পানির প্রতিবেদন অনুসারে তাদের কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ১৭৬৯ জন (বিএটিবির ১,৬৬৯ জন এবং জেটিআইয়ের প্রায় ১০০ জন)। এই দুই কোম্পানি বিভিন্ন পণ্যের দোকানি, যারা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে সিগারেট বিক্রি করে, তাদের নিজের কর্মী হিসেবে দেখিয়ে এই মিথ্যা গল্প ফাঁদছে।
তামাক কোম্পানিগুলো তাদের পক্ষে মিথ্যা তথ্য-প্রমাণাদি তৈরি করতে বিভিন্ন গবেষণা কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করে। ‘তামাক চাষের আর্থসামাজিক সুবিধা’, ‘গ্রামীণ জীবিকায়নে তামাক উৎপাদন’ প্রভৃতি শিরোনাম দিয়ে ভুল তথ্য প্রচার ও তথ্য গোপন করে তারা বিভিন্ন নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সচেষ্ট থাকে।
সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কর্মসূচির মাধ্যমে অর্থায়ন করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীর বিপক্ষে অবস্থান নিতে প্রভাবিত করে তামাক কোম্পানিগুলো। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সামাজিক বনায়ন, বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ইত্যাদি বিভিন্ন লোক-দেখানো কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তারা প্রমাণ করতে চায় যে তামাক কোম্পানিগুলো সমাজের জন্য প্রয়োজনীয়। এমনকি এসব কর্মকাণ্ডে তারা বিভিন্ন নীতি নির্ধারকদেরও সম্পৃক্ত করে। বিভিন্ন সময়ে তামাক কোম্পানির এমন কার্যক্রমে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত হতে দেখা গিয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিযোগিতা ও চাকরি দেওয়ার নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে তামাক পণ্যের প্রচারণা।
গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেও তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীসমূহের ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা উপস্থাপনের চেষ্টা করে। আইন সংশোধন হলে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাবে, চোরাচালানকৃত তামাকজাত পণ্যের অবাধ বাজার তৈরি হবে ইত্যাদি বিকৃত তথ্যগুলো গণমাধ্যমে উপস্থাপন করে তারা সর্বস্তরের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।
অথচ, বাংলাদেশে ২০০৫ সালে যখন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়, সে বছর তামাক হতে রাজস্ব ছিল ২ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। পরবর্তী অর্থবছর ২০০৫-০৬ এ রাজস্ব আদায় হয় ৩ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে যখন আইনটি সংশোধন হয়, সে বছর তামাক থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ছিল ১০ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তামাক খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে মোট ৩২ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। আইন পাস ও আইন আরও শক্তিশালী করার পরও, কর বৃদ্ধির ফলে গত ১৮ বছরে তামাক থেকে রাজস্ব আয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১১ গুণ। যদিও ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দেশে তামাক ব্যবহার প্রায় ১৮% কমেছে (গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভে)। অতএব এটা পরিষ্কার যে তামাক নিয়ন্ত্রণ হলে রাজস্ব বাড়ে এবং তামাক ব্যবহার কমার মাধ্যমে রোগ ও মৃত্যু কমে।
তামাক কোম্পানি এইসব মিথ্যাচারের মাধ্যমে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করছে। শিশু-কিশোরদের ধূমপানের নেশায় আকৃষ্ট করতে তারা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ধূমপানের স্থান তৈরি করে দিচ্ছে, বিক্রয়স্থলে আগ্রাসী বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। দেশে ভেপিং ও ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়াতে যুবকদের নিয়ে গোপনে ভেপিং মেলার আয়োজন করছে। যা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ধূমপানে আসক্ত করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ধ্বংসের পাঁয়তারা।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৮ সালে দেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসা ব্যয় ছিল ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। দেশে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো ভয়ংকর অসংক্রামক রোগ বেড়েই চলেছে। যার অন্যতম প্রধান কারণ তামাক ব্যবহার। এ সকল রোগের চিকিৎসা খরচ যোগাতে গিয়ে, প্রতিবছর দেশের প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। এই তথ্যগুলো তামাক কোম্পানিগুলো আড়াল করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য প্রচার করে জনগণকে ছেলে ভোলানো গল্প শোনাতে চায়।
বাংলাদেশে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) এই সময়ে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। এমতাবস্থায় ২০৪০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে এই বিদ্যমান আইনকে আরো শক্তিশালী ও বাস্তবমুখী করতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অন্যান্য প্রস্তাবের সাথে ছয়টি সংশোধনী প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবগুলো হলো- বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সকল সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, পাবলিক প্লেস, গণপরিবহন ও কর্মক্ষেত্রে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বাতিল করা, ই-সিগারেট ও হিটেড টোব্যাকো আমদানি ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা, খুচরা শলাকা ও মোড়কবিহীন বিক্রয় নিষিদ্ধ করা এবং সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির চিত্র ৫০ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৯০ ভাগ করা।
তাই আমাদের প্রত্যাশা, তামাক কোম্পানির এসব বানোয়াট ছেলে ভোলানো গল্পে বিভ্রান্ত না হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সচেতন হবেন এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করতে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো অতিদ্রুত পাস করে আইনে রূপদানের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।
লেখক : শিবানী ভট্টাচার্য্য। আহ্বায়ক, তামাকবিরোধী মায়েদের ফোরাম ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
মন্তব্য করুন