আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির পাশাপাশি আমাদের দেশের অঞ্চলভেদে আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতি রয়েছে। অঞ্চলভেদে প্রত্যেকটির স্বাতন্ত্র্য-ভিন্নতা খুবই স্পষ্ট। একটির সঙ্গে অন্যটির যোজন ব্যবধানতুল্য। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা সর্বাধিক দুর্বোধ্য। অপরাপর অঞ্চলের মানুষের পক্ষে এ দুই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা বোঝা সহজ তো নয়ই, প্রায় অসম্ভব। আঞ্চলিক ভাষাগুলোর বর্ণমালা নেই বিধায় লিখিত আকারে স্থায়িত্বের উপায়ও নেই। আঞ্চলিক ভাষা টিকে থাকে-বেঁচে থাকে শুধু ভাষার ব্যবহারে এবং মানুষের মুখে মুখে। নানা বিবর্তনে পৃথিবীর অগণিত আঞ্চলিক ভাষা লুপ্ত হয়ে গেছে। তার প্রধান এবং একমাত্র কারণটি বর্ণমালাহীন আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার লোপ পাওয়ায়। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার না হলেই সেই ভাষা লুপ্ত হওয়ার পথ ধরে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা সারা দেশের মানুষের কাছে বিস্ময়ের-কৌতুকেরও বটে। এমন দুর্বোধ্য ভাষা দেশের সব অঞ্চলের মানুষদের বিস্মিত করে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি কিছু আঞ্চলিক সামাজিক আচার-সংস্কৃতিও রয়েছে। সেসব সামাজিক আচার দেশের অপরাপর অঞ্চলের সামাজিক আচারের সঙ্গে মেলে না। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমই বলা চলে।
ধর্মীয় উৎসব-পার্বণকে কেন্দ্র করে অঞ্চলভেদে কতিপয় সামাজিক আচার-সংস্কৃতির চরম অমিল লক্ষ করা যায়। যার সঙ্গে ধর্মের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। কোরবানি কারও জন্যই ফরজ (বাধ্যতামূলক) নয়। বিত্তশালীদের জন্যও নয়। কোরবানি ওয়াজিব এবং হজের অনিবার্য আনুষ্ঠানিকতা। কোরবানি দেওয়া সামাজিক মর্যাদা-অমর্যাদার বিষয়ে পরিণত এখন। বিত্তবানরা কোরবানি দেয়। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। যারা বিত্তবান নয়, তারাও সামাজিক মর্যাদা লাভ বা ক্ষুণ্নের আশঙ্কায় অধিক কষ্টেও কোরবানি দিয়ে থাকে। তবে মেয়ের বিয়ের পর প্রথম কোরবানির ঈদে জামাইবাড়িতে আস্ত গরু-খাসি এবং মসলা, ঘি, চিনি, সেমাই, পোলাওর চাল হতে নানা কাঁচা খাদ্য পাঠানোর সামাজিক আচার-রেওয়াজ একমাত্র চট্টগ্রামেই দেখা যায়। যারা সামর্থ্যবান, তাদের ক্ষেত্রে এসব সামাজিকতা পালন মোটেও অসাধ্যের বিষয় নয়। তবে যাদের সামর্থ্য নেই, তাদেরও মেয়ের এবং নিজের সম্মান রক্ষার তাগিদে নিরুপায়ে বিত্তবানদের অনুকরণে সামর্থ্যানুযায়ী জামাইবাড়িতে ঈদের আগে গরু-খাসি এবং কাঁচা খাদ্যসামগ্রী পাঠাতে হয়। আর্থিক কারণে এর ব্যত্যয় ঘটলে সমাজে, জামাইবাড়িতে বিড়ম্বনাপূর্ণ অসম্মানের মুখে পড়তে হয়। ঋণ করে হলেও এ অদ্ভুত সামাজিকতা পালনে কমবেশি সব কন্যার পিতাকে বাধ্য করে। গরুর স্থলে খাসি কিংবা গরুর আকৃতি ছোট হলে জামাইবাড়ি থেকে সে গরু বা খাসি ফেরত দেওয়ার অজস্র ঘটনাও ঘটে থাকে। নিরুপায়ে কন্যার পিতাকে ছোট গরুর স্থলে বড় গরু এবং খাসির পরিবর্তে গরু পাঠিয়ে মেয়ের এবং নিজের মান রক্ষায় আত্মনিয়োগ করতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে তেমন ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। ছোট গরুর কারণে ক্ষুব্ধ মেয়ের শ্বশুর গরু ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরে বেচারা মেয়ের বাবা ঋণ করে ছোট গরুর বদলে বড় গরু পাঠিয়ে নিজের এবং মেয়ের মান বাঁচিয়েছিলেন। আমার দেখা সেই ঘটনা তো ভুলতে পারব না। কোরবানিকেন্দ্রিক এই উদ্ভট এবং অদ্ভুত সামাজিক আচার চট্টগ্রামে যুগ-যুগান্তর ধরে টিকে রয়েছে। একই নিয়ম রোজার সময়ও দেখা যায়। নতুন জামাইর বাড়িতে অঢেল কাঁচা এবং রান্না করা ইফতার পাঠানো। মেয়ের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার মতো এসব সামাজিক আচার প্রতিটি কন্যার পিতাকে বাধ্যতামূলক বহন করতে হয়। এ ছাড়া ঈদে মেয়ে, জামাই এবং জামাইর পরিবারে নতুন জামাকাপড় পাঠানোর সামাজিক বিধান তো রয়েছেই। মহরম মাস মুসলিম সম্প্রদায়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মাস রূপে বিবেচিত। তেমনি শোকের মাস হিসেবেও গণ্য করা হয়। কারবালা প্রান্তরে এজিদের বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল ইমাম হোসেনের বাহিনী। যার চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে অজস্র অনুসারীসহ ইমাম হোসেনকে নির্মম হত্যার মধ্য দিয়ে। মুসলিম সম্প্রদায়ের শিয়াদের শোকের আনুষ্ঠানিকতা বহুবিধ। তবে সুন্নি মুসলিমরাও ১ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত নানা আনুষ্ঠানিকতায় শোক পালন করে থাকে। মহরমের ১০ তারিখ আশুরার দিনটি কেন্দ্র করে নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা দেশজুড়ে পালিত হয়। আশুরার দিনটি কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে ব্যতিক্রমী কাণ্ড ঘটে। শোক পালনের সঙ্গে যার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। নেই সংগতিও। প্রায় প্রতিটি কন্যাসন্তানের পিতাকে মেয়ের বিয়ের পর আশুরার দিনে রান্না করে পোলাও-কোরমা, আস্ত মুরগির রোস্টসহ (স্থানীয় ভাষায় দুরুস-পোলাও) অঢেল খাদ্য পাঠানোর সামাজিক আচার-রেওয়াজ রয়েছে। এ সামাজিক আচার পালনে ব্যর্থ হলে কন্যার পিতা-পরিবারের সামাজিক মানমর্যাদা প্রশ্নের মুখে পড়ে এবং মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে মুখরক্ষার উপায় থাকে না। তাই শতকষ্ট হলেও অভাগা কন্যাসন্তানের পিতাদের এ নিষ্ঠুর সামাজিক আচার পালনে বাধ্য হতে হয়।
শবেবরাত শব্দটি আরবি নয়। ফার্সি শব্দ। আমাদের উপমহাদেশে দিনটি অধিক গুরুত্বে ধর্মীয় গাম্ভীর্যে পালিত হয়ে থাকে। অথচ আরব দেশে শবেবরাত দিনটি ধর্মীয়ভাবে পালনের কোনো নজির নেই। ব্যক্তিগতভাবে পাঁচ বছর ইরাকের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূত্রে ছিলাম। শবেবরাতের দিনে বা রাতে ন্যূনতম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সেখানে দেখিনি। মুসলিম অধ্যুষিত ইরাকে শবেবরাত পালনের অভিজ্ঞতা এখানে স্মরণ করছি। আমার প্রথম কর্মস্থল ছিল উত্তর ইরাকের কিরকুকে। সেখানেই প্রথম শবেবরাত পালন করেছিলাম। এদিন সরকারি ছুটি ছিল না। ছিল না দিনটিকে কেন্দ্র করে সামান্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। আরবিভাষী ও কুর্দিভাষী স্থানীয়দের কাছে দিনটির বিষয়ে জিজ্ঞেস করে কারও কাছেই সদুত্তর পাইনি। তারা অবাক হয়েছে দিনটির ধর্মীয় ব্যাখ্যা শুনে। দিনটি পালন তো পরের কথা, দিনটির ধর্মীয় তাৎপর্য সম্পর্কে অকপটে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। আমাদের দেশের কিছু প্রবাসী কর্মজীবী মানুষ স্থানীয় এক মসজিদে মাগরিব-এশার নামাজ আদায়ের পর বিশেষ নামাজ আদায়ে মসজিদ ত্যাগ না করায় মসজিদের কেয়ারটেকার তাদের মসজিদ ত্যাগের বারবার তাগিদ দিলেও, মসজিদ ত্যাগ না করে তারা নামাজরত ছিল। অগত্যা কেয়ারটেকার পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে নামাজরত সবাইকে ধরে থানা হাজতে নিয়ে যায়। এ নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেলে বাগদাদে বাংলাদেশ দূতাবাসে সংবাদ দেওয়া হয়। পরদিন সকালে দূতাবাসের লোক এসে পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে বুঝিয়ে আটককৃতদের হাজতমুক্ত করে। ইরাকের অপরাপর দিনগুলো থেকে এ দিনটিকে পৃথকভাবে দেখার সুযোগ আমার হয়নি। সাধারণ দিনের মতো তাৎপর্যহীনরূপেই দিনটি দেখেছি। চট্টগ্রামে দিনটিতে পূর্বাপর ধর্মীয় সামাজিক আচারের নিয়মে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে খাদ্য পাঠানোর সামাজিক আচার রয়েছে। রান্না করা পোলাও, কোরমা, আস্ত মুরগির রোস্ট পাঠানোর সামাজিক বাধ্যবাধকতা কন্যাসন্তানের পিতা-পরিবারকে পালন করতে হয়।আমাদের স্থানীয় সমাজ আজও সামন্ত যুগের ধারাবাহিকতা বহন করে চলেছে। তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এসব সামাজিক আচার। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত আঞ্চলিক উদ্ভট সামাজিকতা সৃষ্টির মূলে সমাজের ধনিকশ্রেণির সমাজপতিরা নিশ্চয়ই দায়ী। আমাদের সমাজের সমাজপতিরা আর্থিকভাবে অধিক সচ্ছল। তাদের বিত্ত-বৈভব প্রদর্শনের জন্য তারা সমাজে নিজেদের জাহির করতেই এসব সামাজিক আচারের প্রচলন করেছে। নিজেদের অর্থের জৌলুস প্রকাশ করতেই চালু করেছে উৎসব-পার্বণকেন্দ্রিক হরেক সামাজিক আচার-রেওয়াজ। যেগুলো সাধারণের জন্য অনাচারতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় সমাজপতিদের আদেশ-নির্দেশে সমাজ চালিত হয়ে থাকে। তাদের আরোপিত সামাজিক আচারগুলো সমাজে প্রচলনের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণের জন্য মারাত্মক দুর্ভোগের সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক কারণে এসব নিষ্ঠুর-অমানবিক সামাজিকতা সাধারণের জন্য চরম বিড়ম্বনার বোঝাস্বরূপ, যেটি তাদের নিয়মিত ভারাক্রান্ত করে চলেছে। নিদারুণ অর্থদণ্ডের মাশুল তাদের দিতে হয় সামাজিক বাধ্যবাধকতার অজুহাতে। বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলেও নানা অসংগতিপূর্ণ সামাজিক আচার নিশ্চয়ই রয়েছে। এসব অপ্রয়োজনীয়-গুরুত্বহীন এবং অনৈতিক সামাজিক আচারের অবসান অপরিহার্য। সামাজিক সচেতনতায় যতদ্রুত সম্ভব প্রয়োজন অনাকাঙ্ক্ষিত এসব নির্মম সামাজিকতার স্থায়ী অবসান। যেসব সামাজিকতা সাধারণের জন্য পীড়নমূলক, সেগুলো পরিহার আবশ্যিক।এক মৃত ব্যক্তির জানাজা পড়ানো নিয়ে পাশাপাশি দুই মসজিদের ইমামের তীব্র বিবাদ দেখে হতবাক হয়েছিলাম। জানাজার ইমামতি কে করবে, এ নিয়ে পরস্পরের তীব্র বাকযুদ্ধ। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। মৃতের পরিবারের ওপর পরস্পর চাপ সৃষ্টি করছে জানাজার ইমামতি করার উদ্দেশ্যে। অবশেষে সামাজিকভাবে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম মৃতের প্রতি অত্যধিক ভালোবাসায় তারা জানাজা পড়ানোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা-প্রতিযোগিতায় পরস্পর একে অন্যের বিরুদ্ধে বিবাদে লিপ্ত হয়েছে। পরে জেনেছি আসল উদ্দেশ্য অন্যখানে। জানাজায় ইমামতিতে ইমামকে অর্থ প্রদানের রেওয়াজ চট্টগ্রামে রয়েছে। এ ছাড়াও দাফন প্রক্রিয়া, মিলাদ, কুলখানি-কোরআন খতমসহ নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন নিশ্চিত হবে সেই ইমামের দ্বারাই; যিনি জানাজার ইমামতির সুযোগ পাবেন। অর্থনৈতিক কারণেই দুই ইমামের পরস্পর বিবাদ-প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল কারণ ছিল। দেশের অন্য কোনো অঞ্চলে জানাজার ইমামতির জন্য ইমামকে অর্থ প্রদানের নজির আছে বলে জানা নেই। কিন্তু চট্টগ্রামে যে রয়েছে, সেটা আমি স্বয়ং প্রত্যক্ষ করেছিলাম। কবি নজরুলের মানুষ কবিতায়—হায় রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
মন্তব্য করুন