বাংলাদেশের একজন ছাত্রনেতা। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্যতম যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে তিনি আলোচনায় আসেন। তিনি ২০১৯ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। তিনি রাজনৈতিক দল ‘গণঅধিকার পরিষদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তিনি ছাত্র, যুব ও প্রবাসী অধিকার পরিষদের সমন্বয়ক ও গণঅধিকার পরিষদের (একাংশের) সভাপতি। রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন না দেওয়ার বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পলাশ মাহমুদ ও এম এম মুসা।
কালবেলা : ঢাকা- ১৭ আসনের উপনির্বাচন হয়ে গেল গতকাল। কেমন ছিল উপনির্বাচন?
নুরুল হক নূর : দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সরকার যতই মুখে বলুক সুষ্ঠু পরিবেশ কিংবা অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তারা নিশ্চিত করবে, তা সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশিদের চাপের কারণে ঢাকায় বিএনপিসহ অন্যান্য দল কিছু সভা-সমাবেশ করতে পেরেছে। সরকার এক্ষেত্রে কিছুটা সহনশীল হলেও ঢাকার বাইরে প্রায় প্রতিটি প্রোগ্রামে কোনো না কোনোভাবে হামলা করা হয়েছে। গতকাল নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বলতে যাদেরকে বোঝায় তারা কেউ ছিল না। হিরো আলমের মতো রাজনৈতিক দল ছাড়া একজন অপরিচিত মানুষ নির্বাচন করলেন- তাকেও যেভাবে মারধর করা হলো এটা রীতিমতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেই সরকার আগামী নির্বাচনে নিজের দলীয় প্রার্থীদের জয়লাভ করাবে। বিরোধী দলের প্রার্থীদের হামলা মামলা করে কখনো নির্বাচন থেকে উঠিয়ে দেবে, কখনো কেন্দ্র থেকে বাড়িতে লাশ পাঠাবে। এই প্রক্রিয়ায় যারা অংশ নেবে তারা সরকারকে সহযোগিতা করবে। আমি অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও বারবার বলে এসেছি, নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না। তারা সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে নির্বাচনী ফলাফল ছিনতাই করছে। ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে দিচ্ছে না। তাই তাদের অধীনে আমরা প্রত্যেকে নির্বাচন বর্জন করি। নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমেও আমরা দেশ-বিদেশে একটা মেসেজ দিতে পারি। তা আমাদের গণআন্দোলনকে বেগবান করবে।
কালবেলা : ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
নুরুল হক নূর : ভোটার উপস্থিতি শুধু গতকালকে নয়, এর আগে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া যে ছয়টি আসনে উপনির্বাচন ছিল সেখানেও মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ বা ৬ থেকে ৭ শতাংশ ভোট পড়েছিল। গতকাল গুলশানের মতো একটা এলাকায় যেখানে বেশিরভাগ শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ বসবাস করেন, যাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করার কথা গণতন্ত্রের স্বার্থে, সেখানেও দেখা গেল ৫ থেকে ৬ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। তার মানে ৯৪ থেকে ৯৫ শতাংশ মানুষ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা সরকারের বোঝা উচিত। আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, সরকারের পতন ঘটাতে পারব । এর জন্য আমরা নির্বাচন কিংবা আলোচনা বাদ দিয়ে আন্দোলনে নেমেছি। দেশের যে প্রশাসন আজ সরকারকে সহায়তা করছে তারাও ৯০- এর মতো আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। সরকার আগামী নির্বাচন নিজেদের অধীনে করতে পারবে না, তা বুঝতে পেরেছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের একটা বড় ধরনের চাপ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির পর সরকার দেখানোর চেষ্টা করেছে এখানে একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে, জনগণ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিচ্ছে। কিন্তু যেহেতু ৯০ শতাংশ জনগণ এই নির্বাচনকে বর্জন করেছে, তাই তারা ভোটের হার বাড়ানোর জন্য কিছু টাকাপয়সা দিয়ে গরিব মানুষকে ভোটকেন্দ্র নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এগুলো ফলপ্রসূ হবে না। সরকারের এই বছরের মধ্যেই বিদায় নিতে হবে।
কালবেলা : আপনাদের দলকে নিবন্ধন না দেওয়াসহ অন্যান্য বিষয়ে বিদেশি বিশেষত জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অবহিত করবেন কি?
নুরুল হক নূর : আমরা তাদের অবহিত করব না। তারা বিষয়গুলো জানে। বাংলাদেশে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে তারা বলেছে। গণতন্ত্রের বিপক্ষে যারা থাকবে এবং যারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি প্রযোজ্য হবে। নির্বাচন কমিশনও এই ভিসানীতির আওতায় আসা উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির অ্যাপ্লিকেশন শুরু হওয়া উচিত নির্বাচন কমিশনারদের ব্ল্যাকলিস্ট করে। কারণ তারা মাঠের সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন না দিয়ে সরকারের প্রেসক্রিপশনের দলকে নিবন্ধন দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে। এক্ষেত্রে যা করণীয় যুক্তরাষ্ট্র সেটা করবে, আমাদের বলার দরকার নেই। তাদের লোকজন আছে। তারাই এগুলো নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে। সরকার যে খারাপ কাজ করছে সেটি তারা বুঝে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি রাষ্ট্রদূতকে তারা অপমান করেছে, দুই জনের ওপর হামলা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি এগুলো ভুলে যাবে? ভুলে যাবে না। বিরোধীদল রাজপথে আছে এটা তারা জানে। সরকার বেলাইনে আছে। তাদের লাইনে আনার কাজ করছে পশ্চিমারা। সরকার গণতন্ত্রের ঘাতকে পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে।
কালবেলা : সম্প্রতি আপনার দলের এক নেতার ওপর হামলা হয়েছে। এর জন্য আপানার দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?
নুরুল হক নূর : আপনারা যারা পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন তাদের দুপক্ষের বক্তব্য নেওয়া উচিত ছিল। এগুলো গোয়েন্দা সংস্থার কাজ। তারা আমাদের নাজেহাল ও দল ভাঙার জন্য এগুলো করছে। ছাত্রলীগ দিয়ে হামলা করলে তাদের জন্য সেটি ডিসক্রেডিট হবে বলে তারা আমাদের দলছুট দু-তিনজনকে টাকা-পয়সা দিয়ে এই খেলাটা খেলাচ্ছে। এখানে তারা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখাতে পারল না। মানুষের সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য এই ছেলেটা বেফাঁস কথা বলছে। সে মামলা করে গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।
কালবেলা : নির্বাচন কমিশন থেকে আপনাদের দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। কেন দেওয়া হয়নি বলে আপনার ধারণা?
নুরুল হক নূর : নির্বাচন কমিশন যে সরকারের আজ্ঞাবহ একটি কমিশন এবং তারা যে সরকারের সাজানো ছকে ২০১৪-১৮ এর মতো আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সেটিই আরও স্পষ্ট হচ্ছে। গণধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, এবি পার্টির মতো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলোকে তারা নিবন্ধন দেয়নি। মূলত কোনো শক্ত দলকেই তারা নিবন্ধন দেয়নি। বরং গোয়েন্দা সক্রিয়তা এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা নতুন দুটি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। আমাদের দলকে নিবন্ধন না দেওয়ার কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, আমাদের নাকি সব উপজেলায় কার্যক্রমের সত্যতা পাওয়া যায়নি। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া শর্ত ১০০ উপজেলায় কার্যক্রমের তথ্য দিতে হবে। সেখানে আমরা ২০০ উপজেলায় আমাদের কমিটি এবং আমাদের কার্যক্রমের তথ্য দিয়েছি। তারা শর্ত দিয়েছেন এক তৃতীয়াংশ জেলায় দলের কার্যক্রম থাকতে হবে। সেখানে আমরা ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৩টি জেলায় কার্যক্রম এবং কমিটির তথ্য দিয়েছি। আমরা নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণে কোনো দিক থেকেই পিছিয়ে নেই। সরকার আমাদের নির্বাচনে যাওয়ার জন্য একটি সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই প্রস্তাব আমরা গ্রহণ না করার কারণেই আমাদের নিবন্ধন দেওয়া হয়নি।
কালবেলা : আপনাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?
নুরুল হক নূর : আমরা যেহেতু রাজপথের সক্রিয় রাজনৈতিক দল, অবাধ-নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে আন্দোলন করছি; এ আন্দোলন সফল হলে যে নিরপেক্ষ সরকার হবে তাদের কাছ থেকে নিবন্ধন নিশ্চিত করবো। বর্তমান পেক্ষাপটেও আমাদের আন্দোলন এবং আইনি প্রক্রিয়া দুটিই চলবে। আমাদের নিবন্ধন না দেওয়ার প্রতিবাদে আগামী ২৫ জুলাই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে সকাল সাড়ে ১১টায় মিছিল নিয়ে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি রয়েছে।
কালবেলা : আপনারা কি আন্দোলনে যাওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনের জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছেন?
নুরুল হক নূর : একটি রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম সব সময় চলমান থাকে। সুতরাং সুসংগঠিত দল হিসেবে আমাদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যখন নির্বাচন হবে এবং যখন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হবে তখন আমরা নির্বাচনে যাব।
কালবেলা : আমরা দেখেছি আপনাদের দলের মধ্যে একটি ভাঙন তৈরি হয়েছে। দলের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এর কি কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন কী?
নুরুল হক নূর : নির্বাচন কমিশনের তথ্য যাচাই কমিটি স্পষ্টভাবেই তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, গণধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়াকে অপসারণ এবং নতুন কমিটি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে এবং জাতীয় কাউন্সিলের নির্বাচনের মাধ্যমেই করা হয়েছে। এক্ষেত্রে গণধিকার পরিষদে আর কোনো ভাঙন নেই। গণধিকার পরিষদ ভাঙার জন্য কিছু লোক কাজ করছে। তারা গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে টাকা খেয়ে গণঅধিকার পরিষদের নামে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। যারা এসব করছে, তারা ইতোমধ্যেই নেতাকর্মীদের কাছে প্রত্যাখ্যাত। গণধিকার পরিষদে এদের কোনো অবস্থান নেই।
কালবেলা : আপনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশন আপনাদের দলের নিবন্ধন না দিলে আপনারা রাজপথে যাবেন এবং হাইকোর্টে যাবেন। সেখানেও যদি আপনারা ভালো ফল না পান তাহলে কী করবেন?
নুরুল হক নূর : ইতোমধ্যেই সকল বিরোধী দলসহ আমরা যুগপৎ আন্দোলন করছি। আমরা আশা করছি, এ বছরের মধ্যেই সরকারের পতন হবে এবং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠিত হবে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠিত হলে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে যারা নিবন্ধনের যোগ্য তাদেরকে নিবন্ধন দিবে। সেক্ষেত্রে আমরাও নিবন্ধন পাবো। আর সেটি যদি না হয়, এর মধ্যে যদি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়ে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়; তাহলে আমরা জোট করে নির্বাচনে অংশ নিবো।
কালবেলা : আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
নুরুল হক নূর : সরকারবিরোধী কোনো দলকেই নিবন্ধন দেয়নি। যে দুটি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে, তারা সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট। সেই জায়গা থেকে আমি মনে করি, এই দলগুলোর সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে। অন্যায় করা হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশন তার দল দাস চেহারা উন্মোচন করেছে। জাতির কাছে পরিষ্কার হয়েছে যে, এই ঠুঁটো জগন্নাথ মার্কা নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
মন্তব্য করুন