অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রেম-দ্রোহ-সাম্য ও মানবতার কবি, ধ্রুপদী রিপনের শায়েরিগ্রন্থ ‘শেরগুচ্ছ’। ইতোপূর্বে উর্দু, ফার্সি এবং হিন্দি ভাষায় শায়েরির চর্চা লক্ষ্য করা গেলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘শেরগুচ্ছ’ই প্রথম সফল প্রচেষ্টা। বইটিতে ম্যাটাফিজিক্যাল বিষয়াদির পাশাপাশি ভালোবাসা এবং সামাজিক জীবনবোধের বিষয়গুলোও সমানভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। শুধু শায়েরি গ্রন্থ সম্পর্কে নয়, বরং ইসলামের সঙ্গে শায়েরির ভুল বোঝাবুঝি, বাংলাসাহিত্যে শায়েরির ভবিষ্যৎ, ব্যক্তি জীবন-পেশাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন ধ্রুপদী রিপন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু আজাদ।
কালবেলা: বাংলাসাহিত্যের এত এত শাখা থাকতে আপনি শায়েরি রচনা করতে গেলেন কেন?
ধ্রুপদী রিপন: একজন কবি কিংবা লেখকের স্বপ্ন এবং আগ্রহ থাকে সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করা। তাঁর লেখার সমৃদ্ধিতে এটা প্রয়োজন হয়। বাংলাসাহিত্যের অন্যান্য শাখায় আমার বিচরণ আগে থেকেই ছিল এবং রয়েছেও। সেখানে নতুন একটি শাখার সংযোজন হলে আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না। তবে শায়েরি লেখালেখির জন্য আমার পরিবারের প্রতি আমার একটি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা উচিত। আমি একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি এবং প্রচলিত সকল ধর্মের প্রতি আমার অগাধ সম্মানবোধ রয়েছে। মুসলিম পরিবারে লালিত-পালিত হওয়ার কারণে আমি সেখান থেকে অনেক কিছুই শিখেছি। আমি এই পরিবার থেকে যে আন্তরিকতা ও সংস্কৃতি শিখেছি তা আমাকে অনেকভাবেই ভালো থাকতে সহায়তা করেছে। এই পরিবারের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। পরিবার থেকে আমার যে প্রাপ্তি তার দায়বদ্ধতা হিসেবে এটা আমার কৃতজ্ঞতা বোধ ও আমার পক্ষ থেকে পরিবারের প্রতি একটি উপহারও বলতে পারেন।
কালবেলা: শায়েরির সঙ্গে ইসলামের একটা দূরত্ব আছে বলে মনে করেন অনেকে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ধ্রুপদী রিপন: আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধর্ম প্রচলিত রয়েছে। প্রত্যেকটি ধর্মের আলাদা আলাদা একটি আদর্শ বা চিন্তা থাকে এবং থাকবে- এটিই স্বাভাবিক। সেই চিন্তা থেকে স্পিরিচুয়ালিটিবিষয়ক যে সংযোগস্থাপনের কথা বলা হয়, দর্শনে সেটা মেটাফিজিক্যালি আলোচনা করা হয় এবং সে অনুসারে ব্যাখ্যাও করা হয়। দর্শনের ছাত্র হিসেবে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি পূর্ব থেকেই অবগত।এজন্য ইসলাম ধর্ম থেকে এই ভাবটি কীভাবে বোঝানো হয় সেটা আমি অনুসন্ধান করতে শুরু করি। এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি সহযোগিতা পেয়েছি মওলানা জালাল উদ্দিন রুমির দর্শন থেকে, সহযোগিতা পেয়েছি মির্জা গালিব ও আল্লামা ইকবালের চিন্তাধারা থেকে। এ যাত্রায় মীর তকি মীর এবং শেখ সাদীর শায়েরিকেন্দ্রিক দর্শনও আমাকে পড়তে হয়েছে, অনুপ্রাণিত করেছে। কেননা তাঁরা এই ক্ষেত্রে ইসলামিক দর্শন চিন্তায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, এবং তাঁরা আমার সম্মানিত অগ্রজ। ইসলামিক দর্শন নিয়ে ইতোপূর্বে তাঁদের অনেক তাৎপর্যপূর্ণ লেখা রয়েছে।
আর দর্শন শাস্ত্রে পড়ার সুবাদে ধর্মকেন্দ্রিক এই চিন্তা-ভাবনাগুলো আমার আগে থেকেই অল্প পরিসরে হলেও বিচরণ ছিল। এছাড়া উপরে উল্লিখিত ইসলামী দার্শনিকদের রেখে যাওয়া জ্ঞান সম্পদগুলো আমাকে শিখিয়েছে যে, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এখান থেকেও সুফিবাদের অনেক কিছুই বলা যায় এবং বলা সম্ভব।
জালাল উদ্দিন রুমি তার একটি লেখায় বলেছেন, স্রষ্টাকে পাওয়ার অনেক পথ রয়েছে। সেই পথের মধ্যে আমি প্রেমকে বেছে নিলাম। জালাল উদ্দিন রুমির সেই কথার সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই; শুধু পার্থক্যের জায়গা এটুকু যে, রাস্তা ভিন্ন হতে পারে, তবে আমাদের সকলের গন্তব্য একই।
আমি যখন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করব সেখানে লোকসানের কিছু নেই। আমার কাজটি যদি পজিটিভ হয়, যদি সেটি মানুষের কল্যাণে আসে তাহলে সেটি আমার সার্থকতা। আমার কাজ যদি মানুষের উপকারে আসে তাহলে সেটিই আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। একই সঙ্গে আমার এই কাজের মাধ্যমে আমার পরিবারকে এবং আমার সমাজকে কিছু দিতে পারছি যা আমাকে আত্মতৃপ্তি দেয়।
কালবেলা: যেহেতু আপনি অনেক সূক্ষ্মভাবে প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলেন, কিন্তু প্রশ্নটির উত্তর সবার জানা প্রয়োজন, তাই প্রশ্নটি আবার করছি, সুফিবাদকে অনেকে ইসলামের সঙ্গে বিপরীতমুখী বলে মনে করেন। এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ধ্রুপদী রিপন: আমি একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী মানুষ এবং আমি কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নই। এমনকি পৃথিবীর কোনো ধর্মকেই কটাক্ষ করে আমি কখনোই কোনো কথা বলিনি। বরং প্রত্যেকটি ধর্মকেই আমি সম্মান জানাই। হ্যাঁ এটি সঠিক যে, সুফিবাদের সঙ্গে শরীয়তভিত্তিক ইসলামের একটি দ্বন্দ্ব দেখা যায় বলে অনেকেই মনে করেন। কিন্তু এই মনে করাটা ভুল। এটি হয় মূলত ভুল বোঝাবুঝির কারণে। মওলানা জালালুদ্দিন রুমি যখন তার সুফিবাদের দর্শন লিখেছিলেন, তখন কিন্তু তাঁকে কটাক্ষ করা হয়নি। আল্লামা ইকবাল, মির্জা গালিব, শেখ সাদী বা তাঁদের মতো ইসলামিক দার্শনিকগণ যখন তাঁদের সুফিবাদের দর্শন লিখলেন তখন তাঁদেরও কিন্তু কটাক্ষ করা হয়নি। এক্ষেত্রে আপনি বলতে পারেন যে, সে যুগের সুফিবাদের চর্চা অনেক শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষণ করি। আমি মনে করি, সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অপকর্মজনিত কারণে আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আপনি লক্ষ করলে দেখবেন, এখনকার দিনের থেকে ইসলামের শুরুর দিকের সময়ে মানুষের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কিত ধারণা অনেক ভালো ছিল। সে সময় জ্ঞানী-গুণী ধর্ম তাত্ত্বিকের সংখ্যা বর্তমান অপেক্ষা অনেক বেশি ছিল, যারা ধর্মকে ভালোভাবে বুঝতেন এবং লালন করতেন। যদি সুফিবাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো দ্বন্দ্বের জায়গা থাকত তাহলে সেই যুগেই সুফিবাদকে নিষিদ্ধ করা হতো। কিন্তু এ রকম কোনো নজির পাওয়া যায় না। ফলে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, সুফিবাদ শুধু ইসলাম নয়, কোনো ধর্মের সঙ্গেই এর দ্বন্দ্ব নেই। সুফিবাদ শুধু প্রেমনির্ভর, আর সে প্রেম পরম করুণাময়ের প্রতি; ভালোবাসা যেখানে সবার জন্যই বিদ্যমান।
কালবেলা: অণুকাব্য বা খনার বচন থেকে শায়েরিকে কীভাবে আলাদা করা যায়?
ধ্রুপদী রিপন: শায়েরি লেখা হয় মূলত উর্দু, ফার্সি এবং হিন্দি ভাষায়। এই ভাষাগুলোতে আমার লেখা বা পড়ার অভিজ্ঞতা না থাকায় আমি মূলত অনুবাদ গ্রন্থ পড়েছি, ক্ষেত্রবিশেষে অডিও শুনতে হয়েছে। অণুকাব্য বা খনার বচন এবং শায়েরির মূল পার্থক্য মূলতঃ এর ভাবে। ব্যক্তিগতভাবে এটাই আমার পর্যবেক্ষণ। একটি শব্দ একটি ভাষায় যে ভাব নিয়ে ব্যবহৃত হয় অন্য ভাষায় সে ভাবটি অন্যরকম হতে পারে, এবং হয়েও থাকে। সে বিচারে অণুকাব্য ও শায়েরির ক্ষেত্রে উর্দু, হিন্দি বা ফারসি ভাষায় যে ভাব প্রকাশ করে, আমার দেশের ভাষা সেটি অন্যরকম ভাব প্রকাশ করে। অণুকাব্য এবং শায়েরির মাত্রার ঢংও আলাদা। শায়েরিতে অনেকেই অক্ষরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তের ঢঙে লেখার চেষ্টা করেছেন। অনেকে আবার ভাবকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। আমার পর্যবেক্ষণ হলো, শায়েরির ক্ষেত্রে মাত্রা জরুরি নয়, হলে ভালো- না হলে বরং এর ভাবই জরুরি।
কালবেলা : সাহিত্যে যারা নিজেদের নিয়োজিত করেছেন তাঁরা এই নতুন সংযোজন শায়েরি নিয়ে কী ধরনের মনোভাব পোষণ করেন?
ধ্রুপদী রিপন : আমি মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। তবে এর মধ্যে সদর্থক/পজিটিভ প্রতিক্রিয়ার সংখ্যাই বেশি। সাহিত্যের একটি নতুন ঢং যদি কল্যাণমুখী হয় তাহলে সেটি মানুষ গ্রহণ করবেন না কেন! আমার ধারণা, তারুণ্য সব সময় নতুনকেই সমর্থন করে। সুফিবাদ ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু নয়, বরং এটি জীব আত্মার সাথে পরম আত্মার সম্পর্ক স্থাপনের নিমিত্তে একটি প্রেমময় পথ। সুতরাং শিক্ষিত সমাজের অনেকেই বিষয়টিকে এপ্রিসিয়েট করেন। তবে অনেকে না জেনে এটিকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করেন। কেউবা আবার এটিকে হিন্দুইজম বা বুদ্ধিজমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করেন। আবার কেউ এটিকে বিজ্ঞানবিরোধী বলেও ভাবেন। সায়েরি শুধু প্রেম নিয়ে হয় তা নয়, বরং শায়েরি জীবন বোধ থেকেও লেখা হয়েছে অনেক। শায়েরি ভালোবাসার থেকেও লেখা হয়, বিরহ থেকেও লেখা হয়। এখানে বলা জরুরি যে, প্রেম এবং ভালোবাসা দুটি ভিন্ন জিনিস। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রেম মানে নিজেকে সমর্পণ করা, আত্মসমর্পণ করা। আর এটি কেবল একজনের কাছেই সম্ভব। আর তিনি হলেন সৃষ্টিকর্তা।
কালবেলা: শুধু প্রেমই কি আপনার লেখার বিষয়বস্তু? এর মাধ্যমে আপনি ঠিক কি বার্তা দিতে চেয়েছেন? বাংলাসাহিত্যে একটি নতুন বিষয় হিসেবে এর ভবিষ্যৎ কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ধ্রুপদী রিপন: শুধু প্রেম আমার লেখার বিষয়বস্তু না, এর মধ্যে জীবনবোধের বিষয় আছে, ভালোবাসার শায়েরি আছে। এরপর শুধু যে ইসলামিক সাইকোলজিক্যাল ভ্যালু থেকে লেখা সেটাও কিন্তু নয়, সমাজের অন্যান্য পয়েন্ট অব ভিউ থেকেও একাধিক লেখা বইটিতে আছে। পূর্বেই বলেছি, আমি দর্শনের ছাত্র ছিলাম, এ কারণে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব আমাকে পড়তে হয়েছে, যে ব্যাপারটি আমাকে বেশ সাহায্য করেছে। আমি হিংস্র নই, সংঘর্ষ-রক্তপাত আমার পছন্দ না। কোনো কবিই তেমনটি পছন্দ করেন বলে আমার জানা নেই। শায়েরি বাংলাসাহিত্যে তুলনামূলক নতুন। আর নতুন যে কোনো কিছুর ক্ষেত্রে অপরাপরের কাজ করবার অনেক জায়গা থাকে। সে বিবেচনায় বাংলাসাহিত্যে শায়েরির ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে অনেক উজ্জ্বল। আমার দিক থেকে শুধু এটুকু বলতে পারি, আমার অপরাপর কাজের পর্যায়ক্রমিক ধাপ হিসেবে এই ধারাটিতেও আমি অহিংসা, প্রেম, ভালোবাসা ও জীবনবোধের বিষয়গুলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি। তবে যে কোনো লেখাকে পছন্দ বা অপছন্দ করার স্বাধীনতা আমার প্রাণপ্রিয় পাঠকদের রয়েছে।
কালবেলা: লেখালেখিকে নেশা থেকে আপনি পেশা বানিয়েছেন। কিন্তু পেশা হিসেবে পুরোপুরি সাহিত্যের ওপর নির্ভর করা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে কতটা যুক্তিযুক্ত (?) বিশেষত বেশিরভাগ কবি-সাহিত্যিকই যখন এটিকে খণ্ডকালীন হিসেবে নিয়েছেন।
ধ্রুপদী রিপন: আমার লেখালেখির বয়স প্রায় ৩১+ বছর। হয়তো আমার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয় না। এর মধ্যে আমার অনেক লেখা নষ্টও হয়ে গেছে। কিন্তু লেখা বন্ধ করিনি। আমি হয়তো দিনে দিনে আরও পরিপক্ব হবার চেষ্টা করেছি। এটি ঠিক যে, এই পেশায় হয় তো সাফার করতে হয় বেশি, এবং সে বিষয়টি স্মরণে রেখেই সবার এদিকে পা বাড়ানো উচিত। তবে আশার কথা হলো, আমার পূর্ববর্তী অনেকেই লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।... এছাড়া পৃথিবীতে সৃজনশীল কোন কাজটিতে সাফার করতে হয় না, বলুন? আসলে ত্যাগ ছাড়া জগতে ভালো কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব হয়েছে বলে জানা নেই।
তবে হ্যাঁ, এটি সত্য যে, হয় তো এ রাস্তাটি অর্থনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত সুখকর নয়। কিন্তু দিনশেষে তৃপ্তি যে নেই, তা কিন্তু নয়, তৃপ্তি বিবেচনায় এটুকু বলা যায় যে, দিনশেষে আমি আমার স্বপ্নের সাথে আছি, মানুষের কল্যাণে আছি, সৃষ্টির কল্যাণে আছি; এটি আমার কাছে অনেক বড় একটি পাওয়া। আমাকে দিয়ে যদি একটি মানুষেরও উপকার হয়, একজন মানুষও যদি আলোর পথে আসেন, একজন মানুষও যদি তাঁর বোধের দরজা খুলতে পারেন, জানার চোখ খুলতে পারেন- তবে সেটিও আমার জন্য পরম স্বার্থকতা হিসেবেই বিবেচিত হবে।
আমার পূর্ববর্তী জেনারেশন যারা লিখতেন তাঁরা যে অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে খুব ভালো ছিলেন, তা কিন্তু নয়। এমনও হয়েছে যে, কবি জীবনানন্দ দাস কোনো এক পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছেন, সেই পত্রিকার সম্পাদক ফিরতি খামে লিখে পাঠিয়েছেন,- এসব আবর্জনা যেন আর না পাঠানো হয়। ওনার মতো কবিকেও এমনভাবে অপমানিত হতে হয়েছে। এরপরও উনি কিন্তু থেমে যাননি। আবার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা যদি বলি, তবে তো এটি বলতে হয়, ওনাকেও কিন্তু বিনা চিকিৎসায় দেহত্যাগ করতে হয়েছে; উনি শিক্ষিত মানুষ এবং আমার জানা মতে, উনি একজন ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে ছিলেন। উনি চাইলেই ধনিকশ্রেণির মতো জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু উনি কেতুপুরের জীবনকেই বেছে নিয়েছিলেন। আরও উদাহরণ আছে, দেশে প্রিয় লেখকদের একজন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস; আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সাহেবের পরিণতিও কিন্তু সুখকর ছিল না। তারপরও কি মানুষ আসবে না ভালো কাজের জন্য? যদি না আসে তাহলে এই সেক্টর চলবে কীভাবে? কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে, হাল ধরতে হবে, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। তবে, দেশে কিংবা পৃথিবীর মানুষ যদি বুঝতে পারত- যারা কোনো না কোনোভাবে আমাদের কল্যাণে আসছেন তাদের সামগ্রিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা জরুরি, তবে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি অনেক এগিয়ে যেত বলেই আমার মনে হয়। আর এটিও ঠিক যে, চাকরি এবং শিল্প-সাহিত্য একসঙ্গে হয় না।
এ কথা প্রসঙ্গে কাফ্কার একটি কথা মনে পড়ে গেল, কাফ্কা বলে গেছেন ‘দেহ ব্যবসা এবং সংসার একসাথে হয় না’, অর্থাৎ এতে উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং উভয়কেই ঠকানো হয়। তবে চূড়ান্ত কথা হচ্ছে আমি আসলে কিছুই হতে চাইনি, আমার নিয়তি এবং কর্ম আমাকে কবি বানিয়েছে।
কালবেলা: এখানে সরকারের কি কোনো ভূমিকা আছে?
ধ্রুপদী রিপন: এখানে দুভাবে শাসকের ভূমিকা থাকতে পারে। কবিদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো- তাঁরা সবসময় শাসকের ভুলের বিপক্ষে দাঁড়াবেন। তার অর্থ এই নয় যে, শাসককে উচ্ছেদ করা তাঁদের লক্ষ্যবস্তু। তাঁর বা তাঁদের লক্ষ্য হওয়া উচিত শাসক যেন জনগণের কল্যাণে ঠিকঠাক ভূমিকাগুলো রাখতে পারেন, সঠিক কাজগুলো করেন, সেজন্য সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়াও কবির এবং কবিদের কাজ। সেক্ষেত্রে সরকার কবিদের প্রতি বিদ্বেষসুলভ মনোভাব পরিহার করে উদার ও নৈতিক আচরণ করতে পারে। তাছাড়া আমি মনে করি, সামগ্রিকভাবে কবিরা রাষ্ট্রের কল্যাণেই কাজ করেন। তাঁরা রাষ্ট্র এবং পৃথিবীর সেবক, কবিরা জানে দেশ এবং পৃথিবী একান্তই তাঁদেরও। তাই তাঁদের দেশপ্রেম কিংবা পৃথিবীপ্রেম নতুন করে শেখানোর প্রয়োজন নেই। কবিরা আসলে মালিকরূপে সেবক। কবিরা কাউকে কষ্ট দিতে চান না। কবিরাও চান সরকার ভালো থাকুক, নয়তো জনগণের সেবা করবেন কীভাবে? এজন্য সরকার পারে কবিদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে।
কালবেলা: পাঠকদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
ধ্রুপদী রিপন: পাঠকের উদ্দেশ্যে শুধু এটুকুই বলব যে, বইটি নতুন, বিষয়টিও এ দেশে নতুনের মতো। সে বিবেচনা হৃদয়ে লালন করেই ভালোবেসে যাবতীয় সৃষ্টির কল্যাণ কামনা করে বিষয়টি লেখা হয়েছে। শায়েরির পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করতে গিয়ে দেখেছি- তাঁরা পৃথিবীর সকল প্রাণের জন্য মঙ্গল কামনা করেছেন, দোয়া করেছেন। আমার লেখায়ও প্রত্যেক প্রাণের কল্যাণের কামনাই আছে। আসলে ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা পাওয়া যায়। পাঠক যদি ভালোবাসেন, আমিও আশা করি তাঁরা ভালোবাসা পাবেন। পরিশেষে আমার বক্তব্য একটিই, এই দেশ এবং পৃথিবী আমাদের সবার। আমরা সবাই বৃহৎ পরিসরে একটি পরিবারেরই সদস্য। তাই দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সকলেই যেন ঘৃণা ছাড়ানো থেকে বিরত থাকি; জগতের সকল প্রাণ ও অপ্রাণের কল্যাণ কামনা করছি; সাদা সালাম।
মন্তব্য করুন