ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণার জন্য ২০১০ সালে গ্লোবাল হেলথ কাউন্সিল (ইউএসএ) তাকে ‘নিক সাইমন্স স্কলার’ নির্বাচিত করে। তার একটি গ্রন্থসহ ৭০টির বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক প্রকাশনা আছে। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসকে সামনে রেখে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সায়েন্টিফিক স্টাডি অব পপুলেশনসহ বিভিন্ন পেশাগত আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামের সঙ্গে কালবেলার কথা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা
কালবেলা: আজ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘জেন্ডার সমতাই শক্তি : নারী ও কন্যাশিশুর মুক্ত উচ্চারণে হোক পৃথিবীর অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন’। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি অর্জন করেছে? মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৭ কোটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.২২ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৭ কোটি ৩০ লাখ (স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ২০২৩ প্রতিবেদন)। আমরা যদি বাংলাদেশের এ জনসংখ্যার সঙ্গে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজতে চাই তাহলে এ বছর দিবসের একটি প্রতিপাদ্য বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। জেন্ডার সমতা বজায় থাকলে উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। ফলে জেন্ডার সমতার শক্তি উন্মোচনে আমাদের এ বিশ্বে অসীম সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নারী ও মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখতে তাদের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে যদি বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জনসংখ্যা দিবসের সঙ্গে সংযুক্ত করি তাহলে আমরা দেখতে পাই জনসংখ্যার আকারে নারী-পুরুষের যে অনুপাত তা প্রায় সমপর্যায়ে থাকলেও নারীরা রয়েছে ৫০.৪৩ শতাংশ (জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২)। এখন আমরা যদি জেন্ডার সমতার কথা বিবেচনা করি, জনসংখ্যা বিজ্ঞানে আমরা দেখতে চাই নারী-পুরুষরা জনগোষ্ঠীগত আকারে সব জায়গায় সমান সুযোগ পাচ্ছে কিনা বা সব জায়গায় উভয়ের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা। নারী-পুরুষ বা সুরক্ষাহীন কোনো জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিনা। সে প্রেক্ষাপটে এ বছরের জনসংখ্যা দিবসের যে প্রতিপাদ্য সেখানে দেখা যায় বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে নারীরা পুরুষের তুলনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে পৌঁছালেও এখনো অনেক ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে রয়েছে এবং সেই পিছিয়ে যাওয়ার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সূচকটি রয়েছে তা হলো অর্থনৈতিক সূচক। শ্রমবাজারে অংশগ্রহণে পুরুষের থেকে নারীরা অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো সর্বশেষ শ্রম জরিপ ২০২২-এর প্রভিশনাল প্রতিবেদন অনুযায়ী আমরা দেখতে পেয়েছি নারী-পুরুষের মধ্যে আগের চেয়ে ব্যবধান কিছুটা কমলেও এখনো যথেষ্ট ব্যবধান বিদ্যমান। এক্ষেত্রে শ্রমবাজারে ৪২.৬৭ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে যেখানে পুরুষরা রয়েছে ৭৯.৭১ শতাংশ অর্থাৎ শ্রম বাজারে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের প্রায় অর্ধেক। কাজেই এখানে জেন্ডার সমতার জায়গাটা নিশ্চিত হচ্ছে না। আমরা যদি রাজনৈতিক ক্ষেত্রের দিকে তাকাই। আমরা দেখি পৃথিবীর মাত্র ছয়টি দেশে পার্লামেন্টে ৫০ শতাংশ নারী সদস্য রয়েছেন। অর্থাৎ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতার জায়গাটি নিশ্চিত নয়। আমাদের দেশের পার্লামেন্টে নারীদের জন্য পঞ্চাশটি আসন সংরক্ষিত রয়েছে। এ পঞ্চাশজনসহ যদি আমরা ধরি—আমরা দেখতে পাব বাংলাদেশের পার্লামেন্টে নারী রয়েছেন মাত্র ২১ শতাংশ। অতএব, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীরা জেন্ডার সমতার অবস্থানে নেই। আমরা যদি শিক্ষাক্ষেত্রের দিকে তাকাই, নিম্ন মাধ্যমিক বা প্রাথমিক পর্যায়ে টোটাল নেট এন রোলমেন্ট ৯০ শতাংশ (জাতিসংঘের স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ২০২৩)। কিন্তু মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় অনেক কম। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ জেন্ডার সমতার অবস্থানে এখনো নেই। ১৯৯৪ সালে মিসরের কায়রোতে জনসংখ্যা এবং উন্নয়নবিষয়ক যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন (আইসিপিডি) অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখান থেকে জনসংখ্যা ও উন্নয়ন ভাবনায় প্যারাডাইম শিফট ঘটে যেখানে জনসংখ্যাকে দেখা হয় গুণগত মানদণ্ডে। এর আগে জনসংখ্যাকে দেখা হতো সংখ্যা বা পরিমাণগত অবস্থান থেকে। সুতরাং ১৯৯৪ সাল থেকে জেন্ডার সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রজনন স্বাস্থ্য, নারীর অধিকার, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা এ বিষয়গুলো জনসংখ্যা উন্নয়নের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পৌঁছেছে। প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়। ওই সময় থেকেই পরিবার পরিকল্পনায়—নারী এবং পুরুষ দুজনের সম্মতিতে ভিত্তিতে সন্তান গ্রহণ, কত বিরতিতে, কয়টি সন্তান, পদ্ধতির ব্যবহার—ইত্যাদি যৌথ সিদ্ধান্তের ব্যাপার বলে স্বীকৃতি পায়। এখানে কেউ কাউকে জোর প্রয়োগ করতে পারবে না। নারী এবং পুরুষ যৌক্তিকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিবেন। ১৯৯৪ সালের কায়রোর এই জনসংখ্যা সম্মেলনের ২৫ বছরপূর্তিতে ২০১৯ সালে কেনিয়ার নাইরোবিতে আরও একটি সম্মেলন হয়। এখান থেকে তিনটি প্রতিশ্রুতি প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশও এই প্রতিশ্রুতির অন্তর্গত। সেই তিনটি প্রতিশ্রুতির মধ্যে একটি প্রতিশ্রুতি হলো ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার শূন্যের কোঠায় নিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতিটি হচ্ছে—পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদা শূন্যের কোঠায় নিয়ে যেতে হবে এবং তৃতীয় প্রতিশ্রুতিটি হচ্ছে, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা শূন্যের কোঠায় নিয়ে যেতে হবে। এ প্রতিশ্রুতির মধ্যে সংযুক্ত রয়েছে—বাল্যবিয়ে, জেনিটাল মিউটিলেশনের ন্যায় ক্ষতিকারক অভ্যাস দূরীকরণ। আমাদের বাংলাদেশের জন্য যেমন বাল্যবিয়ে বিষয়টি মূলত প্রাসংগিক—তেমনি জেনিটাল মিউটিলেশন বিষয়টি আফ্রিকা বা সাব-সাহারান অঞ্চলের দেশের জন্য অধিকতর প্রযোজ্য। লক্ষ্যণীয়, বাংলাদেশে এখনো বাল্যবিয়ের হার অনেক উচ্চ-দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বাধিক। এই বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে পুরুষ এবং নারীদের যদি আমরা তুলনা করি আমরা দেখতে পাই বাল্যবিয়ের মূলত শিকার বেশিরভাগই নারী। বাংলাদেশ জনমিতিক ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের প্রতি দুজনের একজন বাল্যবিয়ের শিকার অর্থাৎ ১৮ বছরের আগেও বিয়ে হয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ বাংলাদেশ স্যাপল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স ২০২২ রিপোর্টে দেখতে পেয়েছি, বাংলাদেশের বাল্যবিয়ের হার ২০২১-এর তুলনায় ২০২২-এ বেড়ে গেছে। বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার ফলেও জেন্ডার অসমতা তৈরি হচ্ছে। কারণ বাল্যবিয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নারীর শিক্ষা এবং এ ছাড়াও আরও অনেক কিছু। বাল্যবিয়ের ফলে নারী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্কুল থেকে পড়াশোনা ছেড়ে দেন। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজগুলোর পড়াশোনায় দেখা যায়, নারীরা প্রাথমিক পর্যায়ে ভালো অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু বাল্যবিয়ের কারণে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে গিয়ে এক ধরনের ব্যবধান তৈরি হয় এবং এরই ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের শ্রমবাজার পর্যন্ত প্রভাবিত—অর্থাৎ এখানেও জেন্ডার অসমতা তৈরি হচ্ছে। আমরা যদি জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার কথা বলি সেখানেও আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের ২০২৩ সালের স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি চারজনের একজন নারী তার ইন্টিমেট পার্টনার দ্বারা সহিংসতার শিকার হন। প্রায় ৩৬ শতাংশ নারী যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না এবং ২৩ শতাংশ নারী নিজের স্বাস্থ্য যত্ন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন না। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের যে ১৭টি অভীষ্ট রয়েছে সেখানেও জেন্ডার সমতার কথা উল্লেখ আছে। বিশেষ করে টেকসই উন্নয়নের পাঁচ (জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সব নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন) ও তিন (অভীষ্টে—সব বয়সী সব মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ)-অভীষ্টে রয়েছে। এ বছরের বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তাই এক্ষেত্রে সরকারকে এবং অন্যান্য অংশীজনদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে জেন্ডার অসমতা দূরীকরণে ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে পদক্ষেপ নিতে হবে।
কালবেলা: বাংলাদেশ এমন একটি উন্নয়নশীল দেশ যেখানে সম্পদ বলতে শুধু এর জনসংখ্যা। আমরা এখন যে নীতিতে এগোচ্ছি সেটি কী ঠিক আছে? মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম : বাংলাদেশের ১৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষের মধ্যে যদি কর্মক্ষম মানুষকে ধরা হয় যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছর তাহলে দেখা যাবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের পর একমাত্র বাংলাদেশেই এত বেশি জনসম্পদ রয়েছে। জনসংখ্যাকে তিনটি দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা যায়। একটি হচ্ছে সংখ্যা, দ্বিতীয়ত এই সংখ্যাটি একটি চ্যালেঞ্জ, তৃতীয়ত : এই সংখ্যাটি একটি সম্ভাবনা। সবকিছুই নির্ভর করছে আমি এই জনসংখ্যাকে কীভাবে ব্যবহার করছি। লক্ষ্যণীয়, বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বেশি। ২০৩৬-৩৭ সালের পর কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধীরে ধীরে কমে আসবে এবং নির্ভরশীল জনসংখ্যার পরিমাণও বাড়তে থাকবে। এই প্রেক্ষাপটে তাই ২০১২ সালে প্রণীত সরকারের জনসংখ্যা নীতিটি আপডেট করা খুবই প্রয়োজন। কারণ তৎকালীন নীতিটি ছিল টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার পূর্বেকার প্রেক্ষাপটে মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল। সেটাকে একটি গতানুগতিক নীতি হিসেবেই দেখতে পাই। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করে যার একটু বর্ধিত রূপ হলো ২০১২ সালের জনসংখ্যা নীতি—যার অনেক লক্ষ্যমাত্রাই আমরা অর্জন করতে পারিনি। নীতিটি বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিধায় নতুন একটি নীতিমালার আওতায় তাদের কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকার ডেমোগ্রাফিক ডিভাইডেন্ডকে নীতি কৌশলের আওতায় এনেছে। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্মক্ষেত্র বা চাকরির সুযোগ তৈরি করতে হবে। সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল দরকার। কর্মসংস্থান তৈরি করার পূর্বশর্ত হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগ হলেই কেবল নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রবাসী শ্রমিক অদক্ষ বা অর্ধ দক্ষ। সে ক্ষেত্রে আমাদের দরকার দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশকে শ্রমবাজার খুঁজতে হবে। সরকার এই জনসংখ্যাকে দুইভাবে ব্যবহার করতে পারে। স্থানীয় শ্রমবাজারে কর্মের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। আরেকটি হচ্ছে বৈশ্বিক বাজারে চাহিদার ভিত্তিতে তাদের কাজে লাগানো। সেটি করার জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। আমরা প্রতিনিয়ত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলছি। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির বিপ্লব আসছে। সেই অনুযায়ী আমার দেশের শ্রমশক্তি বিশ্ববাজারে প্রবেশ করার মতো যথেষ্ট দক্ষ কিনা সেটা সরকারকে বিবেচনা করতে হবে। সরকারকে কয়েকটি জায়গায় খেয়াল করতে হবে, প্রথমত আমাদের যে কর্মক্ষম জনবল রয়েছে তা বিশ্বের অনেক দেশেরই নেই, দ্বিতীয়ত আমাদের দেশের কর্মক্ষম জনবল ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তৃতীয়ত : কর্মক্ষম জনবলের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে। সুশাসন এবং নীতি কর্মকৌশলগুলো বাস্তবায়নের জন্য মনিটরিং করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় আমাদের নীতি আছে, কর্মকৌশল আছে, কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না। কর্মকৌশল গ্রহণের সময় আমাদের একটি ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে দেখতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে তা চলবে না। জনসংখ্যাকে উন্নয়নের কেন্দ্র বিন্দুতে রেখে ভাবতে হবে। শুধু মাথাপিছু আয় বাড়ানো বা জিডিপির গ্রোথ বাড়ানোর কথা ভাবলে হবে না। কর্মক্ষম জনেগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে জিডিপির গ্রোথকে আরও ত্বরান্বিত করার ব্যাপারটিই হচ্ছে জনমিতিক লভ্যাংশ। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই কর্মক্ষম জনসংখ্যার কারণে সুবিধা পেয়ে আসছে। তবে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেতে হলে পৃথিবীর অন্যান্য অংশের বিভিন্ন দেশ যারা এ সুবিধা পেয়েছে এমনকি পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও পেয়েছে আমাদের তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে এবং নীতিনির্ধারকদের এই বিষয়টি আমলে নিতে হবে। শুধু কর্মকৌশলের মধ্যে থাকলে হবে না সেগুলোকে প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে—স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি কৌশলের মাধ্যমে। জনসংখ্যার মাত্রিকতাগুলোকে বুঝে সে অনুযায়ী সঠিক পরিকল্পনা করলেই কেবল আমাদের সামনে সুযোগ থাকবে একটি সম্ভাবনাময় কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের।
কালবেলা: আমরা কী শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যথাযথ বিনিয়োগ করছি? মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম : মানসম্পন্ন শিক্ষা দরকার। যদি আমরা মার্কেট ড্রিভেন গ্রাজুয়েট তৈরি করতে চাই তাহলে আমাদের বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষা নিয়ে আমাদের বড় ধরনের পরিকল্পনা দরকার। চিন্তা করতে হবে আমি কী প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করব নাকি মাধ্যমিক—নাকি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায়। বাংলাদেশে কারিগরি খাত সবচেয়ে অবহেলিত। আমরা মনে করি সন্তানদের শুধু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর তৈরি করব। কিন্তু বিশ্ব শ্রমবাজারের পরিপ্রেক্ষিতে সবার মাস্টার্স করার দরকার নেই। এসএসসি বা এইচএসসি পর্যন্ত পড়ার পর তাকে চিন্তা করতে হবে কোন জায়গায় সে যাবে। যার আগ্রহ নেই তাকে সে জায়গায় নিয়ে কোনো লাভ নেই। এ জায়গায় যদি আমরা সঠিক বিনিয়োগ করতাম তাহলে কোরিয়ার মতো দেশে আমরা দক্ষ জনশক্তির শ্রমবাজার তৈরি করতে পারতাম। আমরা সেসব জায়গায় দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারতাম। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের গাইড লাইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতে হবে। আমরা তার ধারে কাছেও নেই। যতটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয় তাও মন্ত্রণালয় ব্যবহার করতে পারছে না অভিযোগ রয়েছে। জনসংখ্যা বাড়ছে, মানুষের চাহিদা বাড়ছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার অনেক বেড়ে গেছে। সেবাপ্রাপ্তিতে তারা বড় ধরনের সমস্যায় পড়ছে। মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য দুটো জায়গায় বিনিয়োগ করা জরুরি—শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য। এই দুটো হচ্ছে মানব পুঁজি তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই দুটো জায়গাতেই বাংলাদেশের বিনিয়োগ সবচেয়ে কম।
কালবেলা: জনসংখ্যার সুযোগ সদ্ব্যবহারে সরকারের কোন দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত? মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম : বাংলাদেশ সরকারকে বিবেচনা করতে হবে ২০৩৭ সালের কথা। এটাকে আমরা প্রথম ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের সময়কাল বলছি। বাজেট এক বছরের ঘটনা। এক বছর শেষ আবার পরের বছর। কিন্তু ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের একটি নির্দিষ্ট টাইম বাউন্ড আছে। এটার সুযোগ আর ভবিষ্যতে পাব না । কারণ, একটা পর্যায়ে নির্ভরশীলতার হার বেড়ে যাবে। জনসংখ্যার মোট প্রজনন হার কমে আসবে। আমাদের সুযোগ রয়েছে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাতে বিনিয়োগ করার। এসব জায়গায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করলে সুশিক্ষিত গ্রাজুয়েট কীভাবে তৈরি করবে? সেগুলো করার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা দরকার। ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়ার যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে হবে। আমেরিকার মতো দেশে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে উপরের দিকে আছে তাদের বেশিরভাগই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর বিনিয়োগ করে। আমাদের কয়টা ইন্ডাস্ট্রি আছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিনিয়োগ করেছে? অন্যদিকে আমরা বাণিজ্যনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় ঢুকে গেছি। শিক্ষার যে প্রকৃত উদ্দেশ্য—নৈতিকতা মূল্যবোধ, সমাজবান্ধব শিক্ষা ও পরিবেশ, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা, এগুলোতে ঘাটতি আছে। সরকারকে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে। আমরা মুখে বলি, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু পদক্ষেপ নেই উল্টো। আমরা বলি সুস্বাস্থ্য সব সুখের মূল। কিন্তু আমরা সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে কতটুকু বিনিয়োগ করেছি। এগুলো নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা দরকার। আমাদের আগে যারা ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন মডেলের তৃতীয় পর্যায়ে গিয়েছে তাদের উদাহরণ কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশে প্রজনন হার এবং মৃত্যুর হার দুটোই তুলনামূলকভাবে কম এজন্য আমরা একটা ফেভারেবল বয়স কাঠামোর ভেতরে রয়েছি। কিন্তু এটা তো সারা জীবন থাকবে না। ২০৩৬-৩৭ সাল পর্যন্ত হয়তো বা অনুকূল থাকবে কিন্তু এরপরে আমাদের বয়স্ক জনগোষ্ঠী বেড়ে যাবে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুত বয়স্ক জনসংখ্যা বাড়ছে।
কালবেলা: অনেকেই বলছেন প্রযুক্তির প্রসার ঘটলে কর্মসংস্থান সংকোচিত হয়ে যাবে। তখন জনসংখ্যা আমাদের মতো দেশের জন্য বোঝায় পরিণত হবে কী? মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম : প্রত্যেকটা জিনিসের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ থাকে। আপনার নীতি কর্মকৌশল কীভাবে কাজ করছে সেটি মুখ্য বিষয়। প্রযুক্তির আরও নতুন নতুন সংস্করণ আসবে। সেটা ধীরে ধীরে আরও ভালোর দিকে যাবে। এখন সে প্রযুক্তিকে ব্যবহারে সক্ষমতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী আমি তৈরি করতে পারছি কিনা। যখন প্রথম কম্পিউটার এলো ’৯০-এর দশকে; আমার মনে আছে সেই কম্পিউটারের কারণে প্রচুর বেকার তৈরি হয়ে যাবে এমন একটা চিন্তা ছিল। পরে আমরা দেখেছি না সেটা ঘটেনি। প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের সাহায্যে আউটসোর্সিং করে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। ২০ বছর আগেও আউটসোর্সিং নিয়ে চিন্তা করেনি। এখন আমাদের যেটি করতে হবে সেটি হচ্ছে বৈশ্বিক শ্রমবাজারের চরিত্রের পরিবর্তনে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের ধরতে হবে কোনো ডাইমেনশনে এই পরিবর্তনটা হচ্ছে। যেমন ভবিষ্যতে শ্রমবাজারে কেয়ার ইন্ডাস্ট্রি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেবে। কারণ বয়স্ক মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। যেটি জাপান বা অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে আমি কোন জায়গাটায় বিনিয়োগ করছি সেটা জরুরি। আমি নার্সিংকে ঠিকমতো গুরুত্ব দিচ্ছি কিনা সেটা জরুরি। ফিলিপাইনের উদাহরণ দেওয়া যায়। নার্সিং বা মেডিকেলের ডাক্তার তৈরিকে তারা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ছোট দেশ হলেও তারা আমাদের থেকে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। তারা দক্ষ জনগণ তৈরি করছে, সুশিক্ষিত করছে এবং সে অনুযায়ী তারা বিদেশে শ্রমবাজারে যাচ্ছে। আরও একটা উদাহরণ দেই। কিউবা এমন একটি দেশ—যারা প্রচুর ডাক্তার এবং নার্স তৈরি করে। ধরেন অস্ট্রেলিয়া মানুষ পাঠাবেন। এখন অস্ট্রেলিয়ার শ্রমবাজারে কোন ধরনের জনগোষ্ঠীর চাহিদা রয়েছে, সেই জায়গাটি খেয়াল করতে হবে। যারা কৃষক তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়াতে পারছে কিনা। দামটা সে সঠিকভাবে পাচ্ছে কিনা, মার্কেটের তথ্য সম্পর্কে তার জানা আছে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দিলে প্রযুক্তিকে অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা যাবে। আমি যদি নিজে উৎপাদক হই এবং পর্যাপ্ত তথ্য আমার কাছে থাকে তাহলে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কাটা কমে আসবে বরং প্রতিযোগিতা বাড়বে। আমরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কোন পর্যায়ে আছি সেটি খেয়াল করতে হবে। আমাদের মার্কেটের কাঠোমা কী? এটি এখন একটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতর রয়েছে। মার্কেটে মুনাফা সর্বোচ্চকরণের বিষয় রয়েছে। যার হাতে প্রযুক্তি বেশি থাকবে, দক্ষতা বেশি থাকবে, তথ্য বেশি থাকবে, সে-ই বেশি সুবিধা নিবে। নীতিনির্ধারকের ক্ষেত্র থেকে আমাকে যেটা করতে হবে তা হলো—তাদের কাছে তথ্য এবং পুঁজির সরবরাহ বাড়াতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শ্রম আছে কিন্তু পুঁজি নেই। পুঁজিকে প্রযুক্তির সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে হবে।
কালবেলা: জনসংখ্যার প্রকৃত পরিমাণ জানা পরিকল্পনার জন্য জরুরি। সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি জনসংখ্যা শুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তার তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। জনশুমারির তথ্য নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী? মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম : প্রযুক্তি আমাদের সঙ্গে আছে। এবার ট্যাব ব্যবহার করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব শুমারির জন্য যথাযথ ও কার্যকর তদারকি এবং সক্ষমতা দরকার। যাদের নিয়োগ করা হয়েছে তারা সঠিকভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে কিনা সেগুলোকে যাচাই করা দেখা জরুরি। এগুলো বিজ্ঞাননির্ভর কাজ। মূল কথা হলো, সব মানুষকে গণনায় আনতে হয়। এটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। আমার অনেক গণনাকারী দরকার। যাদের আমরা নিয়োগ দিচ্ছি তারা যথার্থভাবে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে কিনা সেটা জানা দরকার। যেমন ধরেন, ডিজেবল পপুলেশনকে চিহ্নিতকরণের কথা বলা হচ্ছে। এখন ১৩ রকমের ডিজাবিলিটি আছে। আমাদের গণনাকারীকে যদি যথাযথ প্রশিক্ষণ না দেওয়া হয় তাহলে সে কীভাবে বুঝবে? তাহলে প্রযুক্তি থাকলেও যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকলে সেখানে কোনো লাভ হবে না। আমাদের চেষ্টা করতে হবে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করার। যখন শুমারি হয় তখনও বলেছিলাম স্বাধীনভাবে কাজটা করার জন্য। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে কাজ করা প্রয়োজন। অনেক সময় আমাদের মতো দেশে প্রশ্ন উঠে, সরকার এখানে কোনো প্রভাব বিস্তার করল নাকি করল না। উপাত্ত তৈরির কাজ সরকার করতে পারে কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের উচিত হবে প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা দেওয়া। যাতে তারা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে তাদের দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। ধরা যাক বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো শুমারির মূল ব্যাপারটি দেখছে, সেক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা বাড়ানোর দরকার আছে। এরপরও বিআইডিএস পোস্ট ইনুমারেশনের কাজ করেছে। তারা পোস্ট ইনুমারেশন চেক করে একটা ধারণা দিয়েছে, কী পরিমাণ ভ্রান্তি ঘটেছে বা কী পরিমাণ মানুষ আন্ডারকাউন্ট বা ওভারকাউন্ট হয়েছে। কিন্তু প্রক্রিয়াটাকে যদি আরও বেশি স্বচ্ছ করতে চান তাহলে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এসব কাজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সংযুক্ত করা যেতে পারে। পপুলেশন রেজিস্টারের মাধ্যমে জনগণনা করা যেতে পারে। যাদের দিয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে তারা যদি রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত না হয় তাহলে এক ধরনের সমস্যা হবে। রেজিস্টার করতে গিয়ে আপনাকে সব মানুষকে গণনা করতে হবে, কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। তাই এই জায়গাটায় আগে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। রেজিস্টার করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। এটির উপাত্ত নিয়মিত আপডেট করতে হবে। এই জায়গাটায় সরকার নতুন করে ভূমিকা রাখতে পারে।
কালবেলা: ২০২৬ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। উন্নয়নশীল দেশের জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া উচিত? মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম : মধ্যম আয়ের, উচ্চ আয়ের, নিম্ন আয়ের দেশ বলেন না কেন, মানুষ তো মানুষ। মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির অর্থ তার জীবনের মানের উন্নয়ন নয়। আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়ে গেছে। পত্রিকায় দেখতে পারি মুষ্টিমেয় জনগোষ্ঠীর হাতে অধিকাংশ সম্পদ রয়েছে। তার মানে সব মানুষের কাছে সম্পদ পৌঁছতে পারছে না। মধ্যম আয়ের দেশে গেলেও সম্পদ পেশাভিত্তিক, ব্যবসাভিত্তিক দিক থেকে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত। দেশের প্রায় ৯ দশমিক দুই আট শতাংশ মানুষ ষাটের ঊর্ধ্বে। ৬৫ ঊর্ধ্বে প্রায় ছয় শতাংশ। মধ্যম আয়ে দেশ হওয়ার পরে প্রত্যেক উপগোষ্ঠীর সাব গ্রুপ অফ পিপলের চাহিদা পূরণ হচ্ছে কিনা সেটি গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেলাম কিন্তু অধিকার ও পছন্দের জায়গাটি সংরক্ষিত হলো না, সেটি কাম্য নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পে। প্রতি দশ বছর পর তিন লাখ নতুন মানুষ যুক্ত হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে আরও এক লাখের ওপরে অতি দরিদ্র রোহিঙ্গা জনসংখ্যা যুক্ত হয়ে গেছে। আমাদের দেশের ভেতরের স্থানান্তরের ঘটনা বাড়ছে, কর্মের আশায় মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। সেখানে তারা মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে কিনা সেটা বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারে তাদের নিয়ে আসতে হবে। জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা রোধে করণীয়র ব্যাপারে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। জনবান্ধব কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। এখন ৫০০-৬০০ টাকার মতো বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়। এটি পরিমাণে অনেক কম। কিন্তু তারপরও এটা সম্মানের বিষয় এবং এটি বাড়ানো উচিত। সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষের তালিকায় আরও অনেককে যুক্ত করতে হবে। যে সমস্ত অনু-পরিবার এবং সন্তানহীন বয়স্ক মানুষ রয়েছে তাদের কেয়ার কে করবে সেটা ভাবতে হবে। নারীদের আয়ুষ্কাল সাড়ে তিন বছর বেড়ে গেছে। যারা বিপত্নীক নারী রয়েছেন তাদের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা সামাজিকবান্ধব সমাজ তৈরি করতে চাই। যেই সমাজের সামাজিক সুরক্ষা হবে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। জনসংখ্যাকে শুধু সংখ্যার হিসাবে দেখলে চলবে না। আমাদের সংখ্যার বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে।
মন্তব্য করুন