মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৪৩ এএম
আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:৫৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বিশেষ সাক্ষাৎকারে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

সততা এবং দেশপ্রেমের সঙ্গে সংকট মোকাবেলার চেষ্টা করতে হবে

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। সৌজন্য ছবি
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। সৌজন্য ছবি

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া; সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আগে তিনি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সিনিয়র সচিব, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট, সমাধান, রপ্তানি, ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসিসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

কালবেলা: ২০১৫ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা এই সারিতে যুক্ত হব। সেই টার্গেটের দিকে আমরা কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: একটি স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল (মধ্যম আয়ের) দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার যে তিনটি শর্ত রয়েছে, সেই শর্তগুলো আমরা পূরণ করেছিলাম ২০১৫-১৭ সালের দিকে। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী ২০২৪ সালে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা সংকটের কারণে বাংলাদেশের অনুরোধেই বাংলাদেশকে আরও দুই বছর সময় দেওয়া হয়। কারণ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরও কিছু দেশে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাই, সেটি ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে এ সুবিধাগুলো বাতিল হয়ে যায়। ফলে এখন আমরা ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হব।

ইতোমধ্যে আমরা সব শর্ত এবং বিষয় বিবেচনায় মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। অনেকেই এটাকে বলেন নিম্নমধ্যম আয়। আমাদের সরকারের ভিশন ২০৩১ অনুযায়ী আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হব এবং ভিশন ২০৪১ অনুযায়ী আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে যেতে পারব।

তবে এখানে জাতিসংঘের এসডিজি গোল ফুলফিল করার বিষয় রয়েছে। এসডিজিতে আমাদের পারফরম্যান্স ভালো। গত বছরের তুলনায় পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে আমরা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের দিক দিয়ে ১৯ ধাপ ওপরে উঠেছি। আশা করি, এসডিজির দেওয়া সর্বশেষ সীমা ২০৩০ সাল নাগাদ আমরা আমাদের টার্গেটের অধিকাংশই পূরণ করতে পারব। ঠিক যেমনটা এমডিজিতে আমাদের পারফরম্যান্স অনেক ভালো ছিল।

কালবেলা: আমাদের অর্থনীতিতে এখন এক ধরনের সংকট দেখা যাচ্ছে। এর আগে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল এবং আমরা ভালো করছিলাম। হঠাৎ অর্থনীতিতে এই সংকট দেখা গেল কেন?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: আমাদের অর্থনীতিতে এখন যে সংকট তৈরি হয়েছে তার জন্য মূলত দুটি কারণ দায়ী। করোনা মহামারির কারণে আমাদের মতো বিশ্বের অন্যান্য সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি অনেকে। অনেক দেশে অর্থনৈতিক মন্দার ভাব তৈরি হয়েছিল। গ্লোবালাইজড বিশ্বে এক দেশের ওপর আরেক দেশের নির্ভরশীলতা রয়েছে। সুতরাং বিশ্বব্যাপী প্রত্যেকটা দেশ কমবেশি সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশ এত জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও সব সংশয় অতিক্রম করে ভালোভাবেই করোনা মহামারি থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে। এর পেছনে আমাদের সরকার এবং জনগণেরও একটি ঐকান্তিক চেষ্টা ও সতর্কতা ছিল। তবে করোনার কারণে অর্থনীতির ওপর যে চাপ পড়েছে, সেটা এখনো আমরা অতিক্রম করতে পারিনি।

এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আমাদের অর্থনীতিতে নতুন করে চাপ সৃষ্টি করে। যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্বের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। ব্যাপকভাবে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়। সব আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আর এর একটি বড় প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের ওপর। বাংলাদেশ আমদানি ও রপ্তানি উভয় দিক দিয়ে বাকি বিশ্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে সেটা আমাদের জন্য অনেক ক্ষতিকর হয়। বিশ্বব্যাপী ডলারের দাম বেড়ে যায় এবং বাংলাদেশও এর ভুক্তভোগী।

আমাদের রপ্তানির থেকে আমদানি বেশি ছিল প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এই আমদানির পরিমাণকে অনেকে কিছুটা লাগাম ছাড়া বলেছেন। অর্থনীতিবিদ সহ বিভিন্নজন সন্দেহ করেন এই বড় পরিমাণ আমদানির মধ্য থেকে অনেক টাকা পাচারও হয়ে গেছে। বেশিরভাগ অর্থ পাচার হয় আমদানি রপ্তানির ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে। অর্থ পাচারের ফলে আমাদের ব্যালেন্স অফ ট্রেড এবং ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট দুইটাতেই ঘাটতি দেখা গিয়েছিল। সেই ঘাটতি এখনও পূরণ হয়নি।

কালবেলা: বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আমাদের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ থাকছে?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে আমদানি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করেছে সরকার। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে যাওয়ার পরিমাণ কিছুটা কমেছে এবং এটার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই আমদানি নিয়ন্ত্রণের এক ধরনের নেগেটিভ ইফেক্টও তৈরি হয়েছে। র মেটেরিয়ালস আমদানি কমে যাওয়ার ফলে অনেক শিল্প-কারখানা পরিপূর্ণ ক্যাপাসিটিতে প্রোডাকশন করতে পারছে না। এর ফলে দেশের ভেতরে যে পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ হয় এবং দেশের বাইরে আমরা যে রপ্তানি করি সেখানে এক ধরনের টানাটানি লক্ষ করা যাচ্ছে। যে হারে আমাদের এক্সপোর্ট বাড়ার কথা ছিল সেভাবে বাড়ছে না। অনেকে বলেন, আমাদের এক্সপোর্ট কমে গেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের এক্সপোর্ট ততটা কমেনি, বরং গ্রোথ কমেছে। প্রতিমাসে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টে দেখা গেছে আমাদের এক্সপোর্টে পজিটিভ গ্রোথ রয়েছে তবে সেটা সামান্য। এই পজিটিভ গ্রোথটা শুধুমাত্র গার্মেন্টস প্রোডাক্টের কারণে। অন্যান্য প্রোডাক্ট এর ক্ষেত্রে এক্সপোর্ট কমে গেছে।

অনেক ব্যবসায়ী কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছেন, কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে পারছেন না, প্রোডাকশন কম হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যথাযথ উৎপাদনের উপকরণ আমদানি করতে পারছেন না। দেশের বাইরে আমদানি দ্রব্যের দামও বেড়ে গেছে। দেশে জ্বালানির সমস্যা রয়েছে। এসব কারণে প্রোডাকশন কমে গেছে। ঠিক যে সময় আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছি, সে সময় আমাদের উৎপাদন ও রপ্তানিতে এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি।

আমরা আরেকটি সমস্যার মুখোমুখি হতে পারি বলে মনে হচ্ছে। আমরা সামনে যখন আর কর/শুল্কমুক্ত সুবিধা পাব না তখন এক ধরনের আনফেয়ার কম্পিটিশনের মধ্যে পড়ে যাব। বিশেষ করে রেডিমেড গার্মেন্টস প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে ভিয়েতনামের ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট রয়েছে। এই ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট ভুটান ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে নেই বাংলাদেশের। আমাদের বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতি বিশ্লেষকদের এ বিষয়ে একটি পরামর্শ ছিল যে, আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যত দ্রুততার সঙ্গে সম্ভব কিছু কিছু দেশের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট হোক। আমি জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। আমি নিজেও জার্মানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কিছু আলাপ-আলোচনা করেছি যাতে জার্মানির, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট হয়। এটা সত্যি যে, এ প্রক্রিয়াটা বেশ লম্বা। আমাদের সরকারের তরফ থেকে যে শর্তগুলো মেনে সেখানে দরখাস্ত করতে হবে এবং নেগোশিয়েট করতে হবে সেগুলোর সবকিছু এখনো ফুলফিল হয়নি।

কালবেলা: অর্থনীতির বর্তমান সংকট মোকাবিলায় এবং রপ্তানি বাড়াতে আমরা কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি বলে মনে করেন?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: আমরা যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করতে পারি তাহলে পরে আমাদের আর ডিউটি ট্যাক্স দিয়ে ঢুকতে হবে না। আমার ধারণা আমরা যতটা ভয় পাচ্ছিলাম সেই ভয় অনেকটা কেটে গেছে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের যে মিনিস্টেরিয়াল কনফারেন্স হয়েছে, সেখানে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে আরও কয়েক বছর ডিউটি ফ্রি অ্যাকসেস দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বলা হচ্ছে, যারা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়ে যাবে তাদেরও এ সুবিধাটি দেওয়া হবে। সেটি কার্যকর হলে আমরা হয়তো সুবিধাটি পাব।

ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টগুলো করতে না পারলেও কিছু সেফগার্ড তৈরি করতে হবে আমাদের। আমাদের প্রোডাক্টের কোয়ালিটি ইম্প্রুভমেন্ট করতে হবে, আমরা যাতে আরও বাড়তি মূল্য পেতে পারি সে ব্যাপারে নেগোশিয়েট করতে হবে। গার্মেন্টস খাতের উৎপাদকদের এটা এনসিওর করতে হবে যে, একজন একটি মূল্যে একটি প্রোডাক্টের চালান এক্সপোর্ট করার চুক্তি করেছে, আরেকজন গিয়ে যাতে সেই বায়ারের কাছে একই প্রোডাক্ট কম মূল্য অফার না করে। প্রাইসকাটের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং এখানে গার্মেন্ট শিল্প-প্রতিষ্ঠান সংগঠন আমাদের সাহায্য করতে পারে। সরকার নিজেও এখানে ভূমিকা রাখতে পারে।

কালবেলা: আপনি অর্থ পাচারের কথা বললেন। আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের কথা বললেন। এই অর্থ পাচার বন্ধ করার কি কোনো পথ নেই?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং একেবারে বন্ধ না হলেও কমিয়ে আনা অবশ্যই সম্ভব। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে ৮০ শতাংশ অর্থ পাচার হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে। ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেষ্টা করতে পারে। আমি যখন এনবিআরের চেয়ারম্যান ছিলাম তখন দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ প্রচেষ্টা শুরু করেছিলাম। কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স এবং কাস্টম হাউস চট্টগ্রাম, এ দুটি একত্রে মিলে আমরা একটি কার্যক্রম শুরু করেছিলাম।

একটি পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারদর এবং আমাদের ব্যবসায়ীরা কী দরে নিয়ে আসছেন অথবা রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি পণ্য বিদেশি বায়ারের কাছে কী দরে বিক্রি করছেন এবং আমাদের কাছে এলসি করার সময় কী দর বলছেন—সেই বিষয়গুলো মনিটরিং করা হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এখানে অন্য ব্যাংকগুলোর ওপর সুপারভাইজিংয়ের দায়িত্ব পালন করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআর যখনই একত্রিত হয়ে একটু শক্তভাবে এগিয়ে যায়, তখন অর্থ পাচার কিছুটা কমে যায়। কিছুদিন পর মনিটরিংয়ে কিছুটা শিথিলতা এসে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অর্থ পাচার আবার বেড়ে যায়। মনিটরিংয়ের এই শৈথিল্যের মূল কারণ হলো জনবলের স্বল্পতা এবং অনেক সময় কর্মকর্তাদের মধ্যে নিষ্ঠার অভাব।

এ ছাড়া একটি প্রেশার গ্রুপও এখানে কাজ করে। যে কোনো লেভেল থেকেই এ প্রেশারটা আসতে পারে। বিত্তশালীদের প্রেশার হতে পারে আবার রাজনৈতিক মহলের প্রেশার হতে পারে। এর ফলে মনিটরিং কখনো কখনো থেমে যায় অথবা শিথিল হয়ে যায়। ব্যাংকে কিংবা সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে যারা দায়িত্ব পালন করেন, তাদের দেশপ্রেমটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশপ্রেমিক হলে কম্প্রোমাইজের কোনো সুযোগ থাকে না।

আমদানি ও রপ্তানির সব তথ্য অনলাইনে উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন। সেটি হলে কেউ গরমিল করলে সেটি আমরা পরবর্তীকালে ধরতে পারব। সুতরাং আমাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে এবং ফাঁকি দেওয়ার জন্য যে ফাঁকফোকর রয়েছে সেগুলো বন্ধ করতে হবে।

মুদ্রা পাচারের আরেকটি মাধ্যম হলো হুন্ডি। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন বৈদেশিক মুদ্রার ৫০ শতাংশ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসে। হুনডির মাধ্যমে আসলে বৈদেশিক মুদ্রা আর বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে দেশে আসেনা। বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশেই থেকে যায়। বিনিময়ে প্রাপককে সমমূল্যের টাকা প্রদান করা হয়। যে ৫০ শতাংশ রেমিটেন্স ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে আসে সেটাই কেবলমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়। দেশে এবং বিদেশে নানা উপায়ে এই হুন্ডি বন্ধ করার পদক্ষেপ সরকার নিতে পারে। বিদেশে বসে যারা হুন্ডির ব্যবসা করছে তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। এজন্য ওই সকল দেশে আমাদের দূতাবাসগুলোতে জনবল বৃদ্ধি করে শুধুমাত্র এই কাজে তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া যায়। বিদেশে যেসব দেশ থেকে বেশি রেমিটেন্স পাঠানো হয় সেসব দেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বুথ বৃদ্ধি করতে হবে।

রেমিট্যান্সের জন্য বাংলাদেশে যে পদ্ধতিতে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ ধরনের সিস্টেম খুব কমই রয়েছে। বাংলাদেশে এটা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ফরেন কারেন্সি ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের কাছে এটা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এটা বাংলাদেশ ব্যাংক এর কাজ।

সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি কনফারেন্সে শ্রীলংকার একজন অর্থনীতিবিদ এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মাসে মাসে যে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে বিক্রি করা বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতার জন্য এটা ঠিক নয়। বৈদেশিক মুদ্রার ক্রাইসিসে এটা কোন সলিউশন হতে পারে না। আমাদের মত দেশে যেখানে মানুষ দেশপ্রেমের চেয়ে নিজ স্বার্থটাকে বেশি দেখে সেখানে তারা এগুলো নিয়ে ব্যবসা করছে। ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেকে বৈদেশিক মুদ্রা জমা করে এবং মূল্য বাড়িয়ে তারপর বাজারে ছেড়ে দেয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ডলারের অফিসিয়াল রেট ১১০ থেকে ১১৪ টাকার মধ্যে। অন্যদিকে খোলা বাজারে এটা ১২৩ থেকে ১২৫ টাকার মধ্যে। সরকার যদি নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা সম্পূর্ণভাবে খোলা বাজারে ছেড়ে দেয় তখন যদি ১২৫ টাকা হিসেবে চলতে থাকে তবুও সেটা ভালো। ডলারের দরে একটি স্থিতিশীলতা দরকার।

শ্রীলংকা যখন অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল তখন অনেক অর্থনীতিবিদ বহু সমালোচনা করে বলেছিলেন শ্রীলংকা এই করেছে ওই করেছে। তারা অলাভজনক অবকাঠামো তৈরি করেছে, দেশের ট্যাক্স কমিয়ে দিয়েছে, অনেক ঋণ নিয়েছে এসব নানা কিছু। কিন্তু পরবর্তীতে শ্রীলংকার সঠিক অর্থনৈতিক নীতি পদ্ধতি অবলম্বন করে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৬৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এতটাই কমে গিয়েছিল যে বাংলাদেশের কাছ থেকেও ২০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছিল। শ্রীলংকা ইতিমধ্যেই সুদসহ সেই অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছে।

কালবেলা: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন দেখছেন? আমাদের সামনে কোনো ভয়ের কারণ রয়েছে কি?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট এখনো ভীতিকর পর্যায়ে আসেনি। কয়েক দিন আগে রিপোর্টার্স ইউনিয়নের সাংবাদিকদের একটি মিটিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, তিনি তার ৩৫ বছরের কর্মজীবনে অর্থনীতির এরকম খারাপ অবস্থা আগে দেখেননি। কিন্তু আমি সেরকমটা বলব না। আমি মনে করি বাংলাদেশের অর্থনীতির যে বেজ এবং বাংলাদেশের ইকোনমির যে আকার, সেই অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যদি ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায় তখন সেটা সংকটের। তবে এখনকার পরিস্থিতিকে আমরা একটি সতর্কবার্তা হিসেবে নিতে পারি। আমরা বলতে পারি এখন একটি অ্যালার্ম বাজছে।

অনেকে বলছেন বৈদেশিক মুদ্রার এক্সচেঞ্জ রেট বেড়ে গেলে অর্থাৎ টাকার মান কমে গেলে সেটা মুদ্রাস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে আমার মনে হয় সেই মুদ্রাস্ফীতি স্থায়ী হবে না। আমরা যদি এক্সপোর্ট বাড়াতে পারি, যদি প্রোডাকশন বাড়াতে পারি এবং বাজারে পূর্ণ প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে পারি, তাহলে সেই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

কালবেলা: বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য কি শুধুমাত্র করোনা মহামারী এবং ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধই দায়ী?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: যদিও আমরা বহিঃস্থ শক্তিগুলোকে আমাদের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য দায়ী করি, তথাপি এখানে আমাদের অভ্যন্তরীণ কিছু দুর্বলতাও এই সংকটের জন্য দায়ী। চলতি মাসেও মূল্যস্ফীতি ৯.৯৩ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২% এর বেশি। কিছুদিন আগে সানেম এর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ২৪-২৫ শতাংশ। খাদ্যে এই মূল্যস্ফীতি একটি এলার্মিং বিষয়। এখন প্রশ্ন হল মূল্যস্ফীতি কেন কমছে না? এটা স্বীকার করতেই হবে যে এখানে এক ধরনের আনহোলি অ্যালায়েন্স রয়েছে। আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসততা এবং সিন্ডিকেট করে মুনাফা কামিয়ে নেয়ার এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে। এটাকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না।

শুধুমাত্র বাজারে পূর্ণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই এটাকে কন্ট্রোল করা সম্ভব। বড় বড় ব্যবসায়ীরা যারা সিন্ডিকেট করেছে তাদের বিপরীতে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা যদি একত্র হয়ে ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারে তাহলে এই প্রতিযোগিতা তৈরি করা সম্ভব। এখানে প্রয়োজন হলে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের কে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা এবং ডিউটি ট্যাক্স মওকুফ করতে হবে। যে সকল পণ্যে বেশি ক্রাইসিস হয় যেমন ভোজ্য তেল, চিনিসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে দিতে হবে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের কেও। এছাড়াও আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ চাঁদাবাজি একটি বড় সমস্যা। রাস্তাঘাট, ফুটপাত, পাইকারি বাজার এমনকি মহল্লায় মহল্লায় চাঁদাবাজি। কখনো কখনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও এসব চাঁদাবাজিতে যুক্ত হন। এগুলো আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে। এগুলোর বিরুদ্ধে আমাদেরকে মুখ খুলতে হবে, সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এটি যেভাবেই হোক কমাতে হবে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের অঙ্গীকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন করাপশনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। আমাদের দুর্বলতা যে আমরা সেটা করতে পারিনি। তবে আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সরকারি কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং জনগণ সবাই মিলে চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই দেশটা আমাদের। ফলে এই দেশের যে সমস্যাগুলো রয়েছে, যে সমস্যাগুলোর ফলে আমরা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছি সেটা আমাদেরকে সমাধান করতে হবে।

কালবেলা: আমাদের ইকোনমির আকার বড় হয়েছে কিন্তু ট্যাক্স জিডিপির রেশিও বাড়ছে না। এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: আমি ২০১৯ সালে ট্যাক্স নেট বাড়ানোর জন্য একটি প্রচেষ্টা শুরু করেছিলাম। যেসব দেশ উন্নত হচ্ছে কিংবা যেসব দেশের ট্যাক্স জিডিপির রেশিও ভালো সেসব দেশের ইনকাম ট্যাক্স এর কন্ট্রিবিউশন টা বেশি থাকে। এটা থাকে প্রায় ৪০ শতাংশ। যারা ট্যাক্স এর আওতার বাইরে তাদেরকে ট্যাক্সের আওতায় নিয়ে আসা জরুরী। ব্যবসায়ী এবং উচ্চবিত্ত যারা রয়েছেন তারা যাতে ফাঁকি দিতে না পারেন, যাতে সঠিকভাবে ট্যাক্স দেন এবং যারা ট্যাক্স আদায় করছে তাদের মধ্যে যেন দুর্নীতি না থাকে সেই বিষয়গুলিতে লক্ষ্য রাখতে হবে।

আমি এই বিষয়টার দিকে নজর দিয়েছিলাম। ট্যাক্স নেট বাড়ানোর জন্য আমি ট্যাক্স অফিসারদের সঙ্গে স্টুডেন্টদেরকে বাড়ি বাড়ি পাঠানোর একটি প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে সেটা আর বেশি দিন চালু থাকে নি। ট্যাক্স, কাস্টমস এবং ভ্যাট এই প্রত্যেকটা জায়গায় আমি জনবল বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কতটুকু জনবল বৃদ্ধি করলে আমরা ট্যাক্স আদায়ে পারদর্শী হবো সে বিষয়ে একটি পরিকল্পনা আমি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে আভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে পাঠিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল এটা হয়তো জনপ্রশাসনে চলে গেছে। কিন্তু আমি পরে জানতে পারি জনপ্রশাসনে সেই ফাইলটি যায়নি। সেসময় আমি আমার চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে অবসরে চলে যাই।

আমি জেনেছি সেই ফাইলটি নতুন করে পর্যালোচনা করে কাটছাঁট করে প্রায় দুই বছর পর জনপ্রশাসনে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এরপরেও সেই প্রস্তাবটি পাশ করে জনবল নিয়োগ দিয়ে যত দ্রুততার সাথে সম্ভব ট্যাক্স বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু করার যে প্রত্যাশা ছিল তা হয়নি। আমি আমার লেখালেখি এবং টকশোগুলোতে বারবার বলেছি, এখন এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ কোন সমস্যা সমাধান করতে পারবে না।

কাস্টমস, ট্যাক্স এবং ভ্যাট অফিস যদি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত না পৌঁছে তাহলে ট্যাক্স বাড়বে না। এর আগেও যে সব বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে এডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্ম হয়েছে (১৯৯১ এবং ২০১১ সালে) তখন রেভিনিউ জাম্প করে উপরে উঠেছিল। আবার যদি রিফর্ম হয় তাহলে ট্যাক্স জিডিপির রেশিও বেড়ে যাবে। আমি বারবার বলেছি জনবল বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। এছাড়া আরেকটি বিষয় হলো অটোমেশন। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দুইটি খাতা ব্যবহার করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। অটোমেশন হলে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কি পরিমান ‘র’ মেটেরিয়াল ব্যবহার করল এবং কি পরিমান বিক্রি করল তার রেকর্ড থাকবে। কি মূল্যে বিক্রি করছে সেটাও থাকবে পরিষ্কার। এই সকল বিষয় যখন রেকর্ডেড থাকবে এবং এই রেকর্ড যখন অটোমেটিক্যালি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আসবে তখন ট্যাক্স নির্ধারণে আর কোন অসুবিধা হবে না।

কালবেলা: আমরা ঋণখেলাপি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। এটা কি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা নাকি ইচ্ছে করে তৈরি করা?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: বাংলাদেশে অফিশিয়াল হিসেবে দেখা যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১.৫ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক ঋণ নিয়ে অনেকে কিস্তি পরিশোধ না করে রি-শিডিউলিং করে। কয়েক বছর পর আবার রি-শিডিউলিং করে। অনেকে এগুলোও করে না। অনেকে সুদ মওকুফ করিয়ে নিয়েছে। আরেক ধরনের ঋণ রয়েছে, যা একেবারেই ব্যাড ডেট (মন্দ ঋণ) হয়ে গেছে। অনেকে বলেন, এসব কিছু মিলিয়ে দেখলে আমাদের ঋণখেলাপির পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা হয়ে যায়। আইএমএফের হিসাবেও আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকা বলা হয়েছিল। এ পরিস্থিতি একটি দেশের জন্য খুবই অ্যালার্মিং সিচুয়েশন। এদিকে আমি ইচ্ছাকৃত বলব না, তবে অবশ্যই আমাদের গাফিলতি রয়েছে।

কয়েকশত কিংবা হাজার কোটি টাকা করে নিয়েছেন একেক জন ব্যবসায়ী। ২ শতাংশ অর্থাৎ একটি নেগলেক্টিং অ্যামাউন্ট জমা দিয়ে সেই ঋণ তারা রিশিডিউল করে নিচ্ছেন। এটা তো কোন সিস্টেম হতে পারেনা। ব্যাংকগুলো টাকার অভাবে এখন যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্প সুদে টাকা দিয়ে তাদেরকে কোনরকমে বাঁচিয়ে রাখে।

আমাদের খেলাপি ঋণ, মুদ্রা পাচার, চুরি এগুলো কমেনি। দেশের বাইরে প্রকাশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা, প্রকাশ্যে দুবাইয়ে বাড়ি করা এগুলো হয়েছে। এগুলো ধরা সরকারের জন্য কোন কঠিন কাজ ছিল না। ইউরোপ-মালয়েশিয়ায় কারা যাচ্ছে, সিঙ্গাপুর-কানাডায় গিয়ে কারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলছে এগুলো চাইলেই সরকার বের করে ফেলতে পারে। সরকার তাদেরকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে কিন্তু সেটা করা হয়নি। সরকারের অনুমতি নিয়ে যারা বিদেশে ব্যবসা করছে তাদের শর্ত হলো তারা প্রফিট দেশে পাঠাবে। কিন্তু তারা সেটাও করেনি। অর্থাৎ এই সব কিছুই হয়েছে অর্থ পাচার। এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া আমাদের দুর্বলতা এবং চাপের কাছে নতি স্বীকার করা। দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে এই অবস্থা থেকে বের হতে হবে।

কালবেলা: বিদেশে অর্থপাচার রোধে দূতাবাসগুলো কোন ভূমিকা রাখতে পারে কি?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: কেউ বিদেশে টাকা নিয়ে গেলে তাদেরকে ধরার জন্য এম্বাসি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সেটা আইনের মধ্যে পড়ে না। দূতাবাসগুলোকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তবে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইলে দূতাবাসগুলো তালিকা প্রণয়ন করে বা তদন্ত করে সহায়তা করতে পারে। দূতাবাসগুলোতে যদি জনবল দেওয়া হয় তাহলে কে কিভাবে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে সেটাও মনিটরিং করা সম্ভব। দেশের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সকলে মিলে কমিটি করে দেশের ইনফরমেশনের সঙ্গে বিদেশি ইনফরমেশন সংগ্রহ করে একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। এ ধরনের কমিটির জন্য পরামর্শ দিয়েছেন বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ। কারা অর্থ পাচার করছে তা খুঁজে বের করা কঠিন কিছু নয়।

আমি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন কোন একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পাচার করা অর্থ ধরার জন্য শুল্ক গোয়েন্দাদের মাধ্যমে কয়েকজন ডাকসাইটে ব্যবসায়ীকে আমি গ্রেফতার করে ফেলেছিলাম। তাদের কাছ থেকে পাচারকৃত অর্থ আদায়েরও একটি প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে কি হয়েছে সেটা আমি আর ফলো করতে পারিনি।

দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মত প্রতিষ্ঠানগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে অনেকটা আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়। তবে আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে এই প্রত্যেকটা অফিসের জনবল স্বল্পতা রয়েছে। রয়েছে দক্ষ কর্মীর স্বল্পতা এবং সৎ ব্যাক্তির স্বল্পতা। এই সমস্যাগুলোকে স্বীকার করেই আমার প্রত্যাশা আগামী সরকার এই বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দিবে। সরকার যদি শক্ত না হয় তাহলে অনিয়ম বিশেষ করে দেশের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা গুলো রোধ করা সম্ভব নয়।

কালবেলা: আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসির কথা বলেছিলেন? এখানে কোনো ফলাফল আছে কি?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে যে ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি করার কথা বলা হয়েছিল সেটা হলো, রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় বা ডিরেকশনে দূতাবাসগুলোর ইকোনমিক বা কমার্শিয়াল উইং বিদেশি বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী এবং ক্রেতাদের সঙ্গে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের কানেক্ট করে দেবে। এর ফলে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, আমদানিতে সুবিধা হবে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। এ পদক্ষেপটি অনেক দূতাবাসই গ্রহণ করেছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদেরও এক ধরনের দায়িত্ব রয়েছে। বিদেশি ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় কোয়ালিটির প্রোডাক্ট দেখাতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেন কোনোভাবে দেশে এসে প্রতারিত না হোন কিংবা সেবাগ্রহণের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা বা দুর্নীতিতে না পড়েন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

জার্মানির দুজন ব্যবসায়ীকে বেশ কিছু সহযোগিতা করতে হয়েছিল আমার। তারা বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট জায়গায় শিল্পকারখানা করতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। এরপর আমি তাদের আদমজী ইকোনমিক জোনে জায়গা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। পরে তারা সেখানে ব্যবসা শুরু করেন। তবে এর পরও তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বন্ড অফিসসহ নানা জায়গায় হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন। আমরা একটি দেশ হিসেবে যদি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ-সুবিধাগুলো অবারিত করতে না পারি, তাহলে আমাদের জন্য এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।

অনেক সময় দেখা যায় যারা রপ্তানি করেন তারা কোয়ালিটি মেইনটেইন করেন না। এর ফলে পরবর্তী সময়ে অসুবিধা হয়। আমাদের সবার উচিত সততা ও দেশপ্রেমের সঙ্গে সংকটগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য চেষ্টা করা।

কালবেলা: শ্রীলঙ্কায় আমরা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে দেখেছিলাম। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এক ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখে রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক ক্রাইসিস। এই পরিস্থিতিতে আমরা সামনে কি দেখব বলে মনে করেন?

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: দীর্ঘদিন বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে। এর ফলে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা ছিল। কিন্তু এখন হরতাল অবরোধ সহ রাজনীতিতে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। সকল পক্ষেরই একটু সচেতন হওয়া উচিত যেন ভবিষ্যতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেভাবে কর্মসূচি পালন করা। আমার কাছে কিছু কিছু ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ব্যবসা ভালো না থাকলে তার অধীনে যে সকল কর্মচারী এবং অফিসার রয়েছেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কোন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে অনেক কর্মসংস্থান নষ্ট হবে। ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের উপরে রয়েছে। এটা ধরে রাখার জন্য আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে।

শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কওমি সনদকে কার্যকরী করতে ছাত্রদল ভূমিকা রাখবে : নাছির উদ্দীন 

তিনবারের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদ গ্রেপ্তার

শিল্পকলায় প্রদর্শিত হলো সার্কাস

৮ দফা অবিলম্বে বাস্তবায়ন দাবি ঐক্য পরিষদের

পুলিশ পরিচয়ে দখলবাণিজ্য এসপি শামীমা ইয়াসমিনের

ওয়ানডে সিরিজেও মুশফিককে নিয়ে শঙ্কা

বিধানসভা উপনির্বাচন / পশ্চিমবঙ্গে ৬ আসনেই তৃণমূলের জয়

জোর করে পদত্যাগ করানো সেই উপাধ্যক্ষের হৃদরোগে মৃত্যু!

বিচ্ছেদের যন্ত্রণা নিয়ে পরীমণির স্ট্যাটাস

টেস্টে হাসানের দারুণ রেকর্ড

১০

নির্দোষ ব্যক্তিদের নামে হওয়া মামলা আইন মেনে প্রত্যাহারের নির্দেশ

১১

ব্র্যাকের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা হটলাইন ‘মনের যত্ন’ চালু

১২

৮ মাসে হাফেজ হলেন ৮ বছরের ওমর

১৩

নৌবাহিনীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন সেনাবাহিনী

১৪

বিধানসভা নির্বাচন / ঝাড়খণ্ড জনমুক্তি-কংগ্রেসের, মহারাষ্ট্রে বিজেপি জোটের জয়

১৫

বেসিস ডিজিটাল মার্কেটিং স্ট্যান্ডিং কমিটির দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত

১৬

নেতাদের বাঁচার উপায় বাতলে দিলেন তারেক রহমান

১৭

গল্পে গল্পে পাপনকে খোঁচা ফারুকের

১৮

পাকিস্তানে কাল আরেক অভ্যুত্থান হবে?

১৯

ছাত্র আন্দোলনে ‘২৮ রাউন্ড গুলি’ করা সেই তৌহিদ গ্রেপ্তার  

২০
X