ড. কবিরুল বাশার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। মশা বিষয়ে জাপানের কানাজোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।
কালবেলা : দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। পরিস্থিতি কতটা আশঙ্কাজনক?
কবিরুল বাশার : ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর সর্বোচ্চ মাত্রায় ডেঙ্গুর আক্রমণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও ২০১৯ সালে বাংলাদেশে সর্বাধিক ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বছরের এই সময় পর্যন্ত তখন আক্রান্তের সংখ্যা এতটা ছিল না। ২০১৯ সালের প্রথম ৫ মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৩২৪ এবং মারা গেছেন ২ জন। ২০২০ সালের প্রথম ৫ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩০৬ এবং ওই বছরও এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত কেউ মারা যাননি। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত প্রথম ৫ মাসে ১০০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এই সময়ে কেউ ডেঙ্গুতে মারা যাননি। ২০২২ সালের প্রথম ৫ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৩৫২ জন এবং তাদের মধ্যে কেউ মারা যাননি। ২০২৩ সালে এই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৬২০ জন এবং মারা গেছেন ১৩ জন।
কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ। ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। কোনোভাবেই যেন ঠেকানো যাচ্ছে না এডিস মশা এবং তার ডেঙ্গু সংক্রমণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার মানুষ ডেঙ্গু রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। যদিও এই পরিসংখ্যানটি সম্পূর্ণ নয়। কারণ এটি শুধু যেসব হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে রিপোর্টিং করে তাদের তথ্য। এ ছাড়া অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে যার তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে পৌঁছায় না। এর মধ্যে অনেক রোগী বাসায় থেকেও চিকিৎসা নিচ্ছেন।
২০২৩ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। আগামী দিনগুলোয় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে। শুধু ঢাকায় নয়, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়বে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে।
কালবেলা : এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির কারণ কী?
কবিরুল বাশার : এখানে অনেক কারণ রয়েছে। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তন তার একটি কারণ। ডেঙ্গু সংক্রমণ শুধু বাংলাদেশে হচ্ছে ব্যাপারটি এমন নয়। এ বছর এরই মধ্যে লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু এবং আর্জেন্টিনায়। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে মালয়েশিয়া, ফিলিপিন, শ্রীলঙ্কায়ও আক্রান্তের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। সাম্প্রতিক দশকে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু রোগীর বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ গুণ। ফিলিপিনে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩১ শতাংশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষণবিহীন বা হালকা জ্বর ও বাসায় চিকিৎসা নেওয়ার কারণে রিপোর্টিং হচ্ছে কম। একটি গবেষণা অনুমান করে যে, বিশ্বব্যাপী ৩৯০ মিলিয়ন ডেঙ্গু সংক্রমণ ঝুঁকিতে আছে। সব মিলে এখানে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক প্রভাব রয়েছে।
আফ্রিকা, আমেরিকা, পূর্ব ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০০টিরও বেশি দেশে এই রোগটি এখন স্থানীয়। আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোয় ডেঙ্গুর সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর মোট ডেঙ্গুর ৭০ শতাংশ এশিয়ায়।
অপরিকল্পিত নগরায়ন, বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত কারণ ডেঙ্গু সংক্রমণের সাথে সংশ্লিষ্ট। জনসংখ্যার ঘনত্ব, মানুষের যাতায়াত, ব্যবহারযোগ্য পানির স্বল্পতা, বিভিন্ন পাত্রে পানি সংরক্ষণ এডিস মশার ঘনত্ব ও ডেঙ্গু বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণ। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত খাবার ও বোতল জাত পানীয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এসব বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থা করতে না পারার কারণে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
কালবেলা : মশার ধরন বা শক্তিতে কোনো পার্থক্য কি এ সময় এসেছে?
কবিরুল বাশার : বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে ডেঙ্গু ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা পরিবর্তিত পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাসের সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা না থাকলেও এটি অনুমান করা যায় যে, করোনাভাইরাসের মতো এটিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে পরিবর্তন করে নিতে সক্ষম।
কালবেলা : মশার ধরন বা ভেরিয়েন্টে কোনো পার্থক্য আসছে কি? মিউটেশন করে নতুন কোনো প্রজাতি তৈরি হয়েছে কী?
কবিরুল বাশার : মিউটেশন করে নতুন কোনো প্রজাতির সৃষ্টি হয়নি। তবে এক একটা দেশে সে দেশের পরিবেশ এবং জলবায়ুর ওপর ভিত্তি করে এই মশা নিজেদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটায় যাতে তারা সেখানে খাপ খেয়ে নিতে পারে। এটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। তবে সেই পরিবর্তনটা জেনেটিক লেভেলে কতটা ঘটেছে সে ধরনের কোনো গবেষণা এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। এ ধরনের গবেষণা হওয়া দরকার।
কালবেলা : সচেতনতা কি হ্রাস পেয়েছে?
কবিরুল বাশার : আমরা যদি বছরব্যাপী মশা নিধন কার্যক্রমটা চালিয়ে যেতে পারতাম তাহলে হয়তো পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। আমরা জানি, এডিস মশার জন্ম হয় বিভিন্ন পাত্রে বা বাড়ির কোণে জমে থাকা পানিতে। নাগরিকরা যদি সচেতন হতেন, নাগরিকরা যদি সম্পৃক্ত হতেন, তারা যদি নিশ্চিত করতেন যে, তাদের বাড়ির আঙিনায় কোনো পাত্রেই পানি জমে থাকবে না যেখানে এডিস মশা জন্মাতে পারে তাহলে হয়তো এই প্রকোপ কম থাকত। এজন্য আমি বলব, নগরবাসীর সচেতনতা এবং সিটি করপোরেশনের বছরব্যাপী মশা নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া জরুরি। তাহলে হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।
কালবেলা : এডিস মশা নিধনে নেওয়া পদক্ষেপগুলো কতটা কার্যকর?
কবিরুল বাসার: উড়ন্ত মশা নিধনে যে ওষুধটি ব্যবহার করা হয় সেটা আমরা গবেষণা করে দেখেছি আবদ্ধ জায়গার জন্য কার্যকর। কিন্তু উড়ন্ত মশা মারার জন্য যে ফগিংটি করা হয় সেটা মাঠ পর্যায়ে তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখে না। মাঠপর্যায়ে যে ফগিং মেশিন দিয়ে স্প্রে করা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সেখানে বাতাসের একটা গতিবেগ থাকে। বাতাসের গতিবেগের কারণে ৪-৫ সেকেন্ডের মধ্যে সেটা হয়তো উপরে উঠে যায় বা বাতাসে মিশে যায়। এজন্য আমরা সব সময় বলে এসেছি, উড়ন্ত মশা নিধনে যে স্প্রেটি করা হয় সেটির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে এনে লার্ভা নাশক কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। তবে কোনো একটি এলাকায় যখন ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে তখন সেই এলাকায় প্রতিরোধী ব্যবস্থা হিসেবে ফগিং করাটা জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ ওই এলাকার উড়ন্ত মশা মেরে ফেলাটা তখন প্রায়োরিটি হয়ে পড়ে। সেজন্য ফগিং একেবারে বন্ধ করে দিলে হবে না বরং হটস্পট ধরে ধরে ফগিং করতে হবে। যেখানে সেখানে ফগিং আসলে খুব বেশি ফল পাওয়া যাবে না।
কালবেলা : মশা নিধনে করণীয় কী?
কবিরুল বাশার : এডিস মশা নিধনের কার্যক্রমকে যদি আমরা ব্লকে ব্লকে ভাগ করে বছরব্যাপী সেটাকে চালিয়ে যেতে পারতাম তাহলে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যেত। কিন্তু সেটা কেন হচ্ছে না তা আমার অজানা।
কালবেলা : ডেঙ্গুর কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কত?
কবিরুল বাশার : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ডেঙ্গুর আর্থিক ক্ষতি নিয়ে একটি গবেষণা করেন। তাদের গবেষণা মতে, প্রতিজন ডেঙ্গু রোগী তার চিকিৎসার জন্য গড়ে ৩৯,৮৯৩ টাকা খরচ করেছেন। সরকারি হিসাব মতে, ২০১৯ সালে ১০১,৩৫৪ জন রোগী হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছেন। তাহলে তাদের মোট ব্যয় হয়েছে ৪০৪ কোটি টাকা। এটা শুধু চিকিৎসা ব্যয়। এ ছাড়া হাসপাতাল পরিচালনা, পরিবহন, রোগী এবং তার পরিবারের লোকদের শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার ব্যয় আরও অনেক বেশি। ২০২২ সালেও ৬২ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ২০১৯ সালের গবেষণা অনুযায়ী, ব্যক্তি পর্যায়ে ডেঙ্গু চিকিৎসার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৫৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তবে যারা হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন তাদের খরচ এবং ডেঙ্গু থেকে নিরাপদে থাকতে মশা প্রতিরোধী কয়েল, স্প্রেসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার খরচ এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এই হিসাবটি আরও অনেক বেশি। এখানে অনেক ধরনের ক্ষতি রয়েছে। যেমন- হাসপাতালগুলোর খরচ, একটা রোগী যখন আক্রান্ত হন তখন তার শ্রমঘণ্টা, তার একটি মূল্য রয়েছে। সিটি করপোরেশন এবং বিভিন্ন পৌরসভা মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সেখানে ব্যবহৃত কীটনাশক, যন্ত্রপাতি, জনবল এমনকি আমরা এ বিষয়ে কথা বলার যে সময় এখানে ব্যয় করছি সবকিছুর একটা মূল্য আছে। সব মিলিয়ে এই ক্ষতি হাজার কোটি টাকারও বেশি বলে আমার ধারণা।
কালবেলা : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আপনার পরামর্শ কি?
কবিরুল বাশার : আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আগামী মাসে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়বে। শুধু ঢাকায় নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এবং পৌরসভায় সবারই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। নগরবাসীকে সিরিয়াস হতে হবে। সিরিয়াসলি এখানে ইনভলভ হতে হবে। নগরবাসী বা জনসাধারণ যারা রয়েছেন তাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে তাদের বাড়ির আঙিনায় কোথাও পানি জমে না থাকে যেখানে এডিস মশার জন্ম হতে পারে। জনগণ, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও গণমাধ্যম সবাই মিলে একসাথে কাজ করতে হবে। তাহলে হয়তো আমরা এ সমস্যাটাকে মোকাবিলা করতে পারব।
মন্তব্য করুন