শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
এম এ মান্নান
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:১৬ পিএম
আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৩৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সাক্ষাৎকার

বিএনপির সেই নেতারাই জেলে রয়েছেন যারা অপরাধ করেছেন

এম এ মান্নান। ছবি : কালবেলা
এম এ মান্নান। ছবি : কালবেলা

এম এ মান্নান বাংলাদেশ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য। তিনি ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সিএসপি ক্যাডারে যোগদান করেন। পর্যায়ক্রমে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে পদোন্নতি পেয়ে সরকারের বিভিন্ন পদে নিয়োজিত ছিলেন। ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক এবং এনজিও ব্যুরোতে মহাপরিচালক। ২০০৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সুনামগঞ্জ-৩ আসনে জয়ী হয়ে কয়েকটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ফের একই আসন থেকে বিজয়ী হয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক সংকট ও আগামী নির্বাচন বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

কালবেলা : গত ১৫ বছর টানা ক্ষমতায় থেকেছে আপনার দল। আপনারা অনেক উন্নয়ন করেছেন। আগামী নির্বাচনে আপনারা জনগণের সামনে কী বার্তা নিয়ে যেতে চান?

এম এ মান্নান : আমরা অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে আগামী নির্বাচনে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর পর প্রায় ৩০ বছরের একটি অন্ধকার সময়ের পর আমরা টানা ১৫ বছর রেকর্ড সময় ক্ষমতায় থেকেছি। আমরা দৃশ্যমান এবং পরিমাপ যোগ্য পরিবর্তন এনেছি মানুষের জীবনে। এই পরিবর্তন নিয়ে এসেছে শেখ হাসিনা সরকার। সুতরাং আমরা অত্যন্ত আনন্দ এবং গর্বের সঙ্গে আগামী নির্বাচনে যাচ্ছি।

কালবেলা : ২০১৮ সালের নির্বাচনের থেকে এবারের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভসহ বিভিন্ন জায়গায় এক ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে আপনাদের সামনে। এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করবেন?

এম এ মান্নান : ব্যাপকভাবে দেখলে আমাদের সামনে মূলত দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি বহিরাগত এবং অন্যটি অভ্যন্তরীণ। রাশিয়া ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ হবে এটা আমরা ভাবিনি। এর আগে বিশ্বব্যাপী করোনার মতো মহামারি ছড়িয়ে পড়বে সেটাও আমাদের জানা ছিল না। ফলে এসব কারণ যখন বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির চাকা কে স্থবির করে ফেলল আমরা সেখানে ছিলাম ভুক্তভোগী। মূলত এই দুটি বহিরাগত চ্যালেঞ্জ আমাদের অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছে।

এর বাইরে আমরা কিছু অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। রাজনীতিতে একটি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে আমরা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং যতটুকু সম্ভব সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। একটি শিক্ষিত এবং বিজ্ঞানসম্মত জাতি তৈরি করা। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার এই উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির প্রচণ্ড রকমের ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের ভিত্তি জাতীয়তাবাদ এবং আমাদের রক্তে বাঙালি। অপরদিকে তাদের মধ্যে বাঙালিত্ব নেই। তারা প্রথম সুযোগেই বাঙালিত্বকে হত্যা করেছে। তারা দেশের মধ্যে এক ধরনের বিভাজন সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে। তারা ধর্মকে রাজনীতির তুরূপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। তাদেরকে মোকাবেলা করা আওয়ামী লীগের জন্য একটি অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ।

আমরা উন্নয়নের জন্য শহরের পাশাপাশি গ্রামের দিকে ফোকাস করেছি। আমরা শতভাগ বিদ্যুতায়ন করেছি। গ্রামে প্রত্যেকটি মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। এটাই শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় চমক। আমরা মানুষের কল্যাণ, উন্নয়ন এবং জাতীয়তাবাদ দিয়ে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চাই।

কালবেলা : পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও মূল্যস্ফীতি ঘটেছিল কিন্তু তারা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। ভারতসহ আরও অনেক দেশে রিজার্ভ সংকট তৈরি হয়েছিল কিন্তু তারা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসব সংকট থেকে উত্তরণ ঘটছে না কেন? আগামী নির্বাচনে কি এর কোনো প্রভাব পড়বে?

এম এ মান্নান : আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি কিন্তু অন্যরা পেরেছে এটা এতটা সহজে বলা যাবে না। শ্রীলঙ্কাকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি আমাদের চেয়েও বেশি। পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি আমাদের থেকেও কয়েকগুণ বেশি। ভারতের মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের কাছাকাছি এবং সেটা আরও বাড়ছে। ইংল্যান্ডের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার অর্থনীতিও মূল্যস্ফীতির কবলে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো ৪-৫ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতি ছিল।

তুরস্ক বাংলাদেশের তুলনায় আরও অনেক বড় অর্থনীতির একটি দেশ। সেখানেও আমার ধারণা মূল্যস্ফীতির হার ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। আমরা স্বীকার করি মূল্যস্ফীতি ঘটলে মানুষের কষ্ট হয়। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে মূল্যস্ফীতি কিসের উদাহরণ? মূল্যস্ফীতি প্রবৃদ্ধির উদাহরণ। মূল্যস্ফীতি বেশি আছে তার মানে হল আমাদের অর্থনীতি বাড়ছে। আমাদের অর্থনীতি স্ফীত হচ্ছে, বড় হচ্ছে। অর্থনীতি বড় হওয়ার ফলে ব্যক্তির আয় বাড়ছে এবং নতুন নতুন ভোক্তা তৈরি হচ্ছে। আগে যারা টেংরা-পুঁটি খাইত এখন তারা খায় পাঙ্গাস মাছ, আগে যারা পাঙ্গাস মাছ খাইত এখন তারা খায় ব্রয়লার মুরগি। আগে খাইত ব্রয়লার মুরগি এখন খায় দেশি মুরগি, গরু। এভাবেই মানুষ বেশি ব্যয় করছে।

সুতরাং আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ার কারণে এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কারণে মানুষের ভোগের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কিন্তু সব মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না। মানুষের ভোগ দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও সরবরাহ এবং উৎপাদন সেভাবে দ্রুত বাড়ে না। বেশি জমিতে ধান লাগালেও সেটা চার মাসের আগে ঘরে তোলা যায় না। সবজি চাষ করা হোক বা মাছের চাষ করা হোক তার জন্য কয়েক মাস সময় দিতে হবে। উৎপাদন ও বাজার সরবরাহ এর সঙ্গে মানুষের ভোগ বৃদ্ধির চাপের পার্থক্য এই দুইটার ফলেই মূল্যস্ফীতি ঘটছে বলে অনেকে মনে করেন।

মূল্যস্ফীতির পেছনে আরও দুইটি ভয়ংকর বিষয় রয়েছে। একটি হলো ডলারের বিপরীতে টাকার মানের অবমূল্যায়ন। প্রতিনিয়ত আমাদের বেশি টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ে জিনিসপত্রের দামের ওপর। দ্বিতীয়ত দায়ী আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। গত কয়েক মাস যাবত প্রথমে মোটামুটি ভাবে তারপর মাঝামাঝিভাবে এবং এখন রাস্তাঘাটে যেভাবে চরমভাবে কর্মসূচি ও যানবাহন পোড়াও, আটকাও, অবরোধ চলছে, এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাজার। বাজার হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এই হৃৎপিণ্ডে আঘাত পড়ছে। ফলে আমরা এমনিতেই যে মূল্যস্ফীতির চাপে ছিলাম সেটা আরও বেড়েছে।

হয়ত বগুড়াতে সবজি রয়েছে, হয়তো ময়মনসিংহে চাল রয়েছে কিন্তু সেগুলোর সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে। বাস ট্রাক পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে যানবাহন মালিকরা পণ্য পরিবহন করতে চাচ্ছেন না। এই সব কিছু মিলিয়ে আমরা মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে রয়েছি।

অন্যান্য অনেক দেশে যেভাবে ভয়ংকর এবং লাগামহীন মূল্যস্ফীতি হয় বাংলাদেশে সেরকম নয়। এক মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশ, পরের মাসে ১৫ শতাংশ এবং এর পরের মাসে ৩০ শতাংশ। পরিস্থিতি এরকম হলে সেটা হয় অসহনীয়। আমাদের মূল্যস্ফীতি ঘটেছে খুবই ধীর গতিতে। কিন্তু এই মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মজুরিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মজুরি বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে কিন্তু সেটা খুব বেশি নয়। অনেকের কষ্ট হচ্ছে তবে আমি মনে করি আমাদের মূল্যস্ফীতি মোটামুটি ভাবে সহনীয় রয়েছে।

যাদের আয় কম মূল্যস্ফীতি তাদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। সরকার তাদের জন্য ১ কোটি কার্ডের ব্যবস্থা করেছে। অর্থাৎ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ ন্যায্যমূল্যে চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছে। এই ব্যবস্থার ফলে মূল্যস্ফীতির আগুনের ওপর এক ধরনের পানির ছিটা পড়েছে। এই কার্ড সিস্টেম ছাড়াও আরো অনেক কর্মসূচি রয়েছে সরকারের। যেগুলোর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষকে কম মূল্যে চাল সরবরাহ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির সময় সরকার ভ্যাট ও শুল্ক কমিয়ে দিচ্ছে। ট্রাক দিয়ে সরাসরি রাস্তাঘাটে মালামাল বিক্রি করা হচ্ছে। মানুষ সেখান থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে মালামাল কিনতে পারে। অর্থাৎ আমরা চারদিক থেকে মূল্যস্ফীতির ওপর আক্রমণ করছি। আর এর ফলে বেনিফিট পাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ।

উচ্চ আয়ের মানুষ মূল্যস্ফীতি নিয়ে খুব বেশি চিন্তা ভাবনা করেন না। প্রতিবাদ করেন মধ্যম আয়ের মানুষেরা এবং নিম্ন আয়ের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি সহ্য করেন। নিম্ন আয়ের মানুষরা কথা বলেন না শুধু সহ্য করে যান। আমরা তাদেরই সুবিধ দেওয়ার চেষ্টা করছি।

কালবেলা : মাঠের বড় বিরোধীদল বিএনপি। বিএনপির বড় বড় নেতারা এখন জেলে রয়েছেন। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেননা অথবা করতে পারছেন না। বিরোধীদলের এতগুলো নেতাকে জেলে রেখে আপনারা নির্বাচনে যাচ্ছেন। এই বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?

এম এ মান্নান : তারা আগেই জানিয়ে দিয়েছে তারা নির্বাচনে আসবেনা। তারা দুই বছর আগেই চূড়ান্তভাবে বলে দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে যাব না। তাদের এই কথাটি অবৈধ, অশংবিধানিক এবং অন্যায় কথা। সাংবিধানিক আইনকানুন এবং কোনো নিয়ম তান্ত্রিকতার মধ্যে থেকে এই ধরনের কথা বলা যায় না। তারা চলতি বছরের শুরুতেও জাতীয় সংসদে ছিলেন। সংসদে বসে তারা তর্ক করেছেন এবং বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারকে মেনে নিয়েই তারা সংসদে গিয়েছিলেন। সুতরাং এখন তারা যা বলছেন সেটা কোনোভাবে ঠিক নয় বলে আমি মনে করি।

বিএনপির সেই নেতারাই জেলে রয়েছেন যারা অপরাধ করেছেন। যারা গাড়ি পুরিয়েছে তাদের কি পুলিশে ধরবে না? যারা পুলিশ মেরেছে তাদের বিরুদ্ধে কি আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? তারা বলেছে তারা নির্বাচন হতে দেবে না। তারা একটি বৈধ সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এভাবে তো গণতন্ত্র টিকে থাকে না। তাদের বিরুদ্ধে আইনগতভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর আইনগতভাবে কাউকে এরেস্ট করলে তার গন্তব্য কারাগার হবে সেটাই তো নিয়ম। এরপর রয়েছে আইনের প্রক্রিয়া। আদালত যদি জামিন মঞ্জুর করেন তাহলে তারা ছাড়া পাবেন। এটা এখন সম্পূর্ণই আদালতের ব্যাপার।

এখানে সরকারকে কেন দোষারোপ করা হবে! সরকার তো কাউকে এরেস্ট করে না। সরকার প্রয়োজনে অভিযোগ করে। অ্যারেস্ট করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এবং অবশ্যই এরেস্ট করা হয় আইনের আওতায়। পুলিশ আগে খোঁজখবর নেবে তারপরেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এটাই পুলিশের প্রাথমিক দায়িত্ব। তারা গণতন্ত্র চায়, আইনের শাসন চায় আবার আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখাতে চায় এটা তো হবে না। দুইটি তো একসঙ্গে চলে না।

কালবেলা : ২০১৪ সালেও বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল। এবারের নির্বাচনেও তারা বলছে তারা অংশগ্রহণ করবে না। এমনকি তারা নির্বাচন হতে দেবেন না বলেও কথা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কীভাবে প্রস্তুত হতে চাচ্ছে?

এম এ মান্নান : বিএনপির ঝগড়াঝাটি এবং বিবাদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে। বক্তব্য দিয়ে এবং ভাষা দিয়ে সেটা তারা করতে পারে। অন্যদিকে আওয়ামীলীগের দুইটি ভূমিকা। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ একটি পক্ষ এবং সরকার হিসেবে স্বতন্ত্র একটি পক্ষ। সরকার হিসেবে আমার দায়িত্ব হচ্ছে যারা আইন ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আওয়ামী লীগ কি ব্রিটিশ শাসক যে সরকারকে পদত্যাগ করতে বলা হবে। একটি বৈধ সরকারকে পদত্যাগ করতে বলাটা অন্যায়। স্বাভাবিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারের দায়িত্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। এগুলো কোনোভাবেই দলের কাজ নয় বরং এগুলো সরকারের কাজ।

সরকার আইনানুগ ভাবে তার কাজ করবে। সরকার তার কাজ করতে গিয়ে যদি কারো বাধার সম্মুখীন হয় তার মানে তারা জেনেশুনেই সেটা করছেন। ফলে সরকার আইনগতভাবে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য।

কালবেলা : নির্বাচনে কোনো সহিংসতার আশঙ্কা করছেন কি?

এম এ মান্নান : আমি কোন মন্ত্রী বা এমপি হিসেবে কথা বলছি না। বাংলাদেশের একজন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে বলতে চাই- আমি পাকিস্তানের শাসন দেখেছি, আমি স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখেছি। পাকিস্তান শাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর লড়াই পুরোটা সময় জুড়ে আমি স্বচক্ষে এবং সচেতন ভাবেই দেখেছি। বাঙালিকে শৃঙ্খলমুক্ত করা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক অর্জন। এটা অনেকের সহ্য হচ্ছে না। তারা প্রথমে স্বাধীনতার ইতিহাসকে পাল্টে দিতে চেয়েছিল। তারা নায়কের জায়গায় খলনায়ক তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা টেকে নাই। এখন তারা অন্যভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বা বর্তমান সরকারকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোন সরকারকে প্রতিহত করার আইনগত কোনো সুযোগ নেই।

তারা নিজেদের একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখে তারপর কীভাবে বলে নির্বাচন প্রতিহত করব! তারা কীভাবে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়! অর্থাৎ তারা তো সরাসরি আইনের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে। ফলে আইনের বিধান মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যে কোনো সরকারের গ্রহণযোগ্যতা এবং তার বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করবে মানুষের ব্যবহারের ওপর। ডাকাতি করে, আগুন দিয়ে, সম্পদ ধ্বংস করে তারা পার পেয়ে যাবে সেটা তো হতে পারে না। সরকার তো বসে থাকতে পারে না। সরকার তার যেটুকু শক্তি আছে তা আইনানুগভাবে প্রয়োগ করবে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও নির্বাচন নিয়ে বিবাদ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নির্বাচন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেখানেও নির্বাচন নিয়ে আদলাতে মামলা চলছে। কিন্তু তারা তো কখনো নির্বাচন প্রতিহত করার কথা বলে না। গণতন্ত্রে নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকার সুযোগ নেই। সরকার যদি কোনো ভুল করে তবে সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সেসব না করে হরতাল দেওয়া, অবরোধ দেওয়া, ভাঙচুর করা কিংবা জ্বালাও-পোড়াও করা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সবকিছুতে একটি সিস্টেম অনুসরণ করতে হবে।

কালবেলা : সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পরিবেশ আছে কি?

এম এ মান্নান : পরিবেশ এর মাপজোক কে করবে? একজন বলবেন পরিবেশ খারাপ, আমি বলব পরিবেশ ভালো। হ্যাঁ, পরিবেশ খারাপ করার প্রচেষ্টা তারা চালাচ্ছে। অবরোধ দিয়ে, আগুন দিয়ে, মানুষকে হত্যা করে, পুলিশকে হত্যা করে তারা একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করছে। মানুষ অনেক সহিষ্ণু এ কারণে এখনো সেরকম কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি।

’৬০-এর দশকে আমরা বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া দেখেছি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন কাল কেউ ঘর থেকে বের হবে না। একটা মানুষও ঘর থেকে বের হয়নি। তখন বাসে আগুন দেওয়া লাগেনি, পিকেটার লাগেনি। আমি নিজে দেখেছি মানুষের এরকম স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। সুতরাং এখন তারা যেটা করছে জনগণই সেটা প্রতিহত করবে।

কালবেলা : আগামী নির্বাচনে আপনি আপনার এলাকায় কি বার্তা নিয়ে যাবেন?

এম এ মান্নান : চলতি সংসদকে ধরে আমি তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। যা ২০০৯ সাল থেকে একটানা চলমান রয়েছে। প্রথম সংসদে আমি পাবলিক একাউন্টস কমিটির সদস্য ছিলাম। দ্বিতীয় সংসদে আমি দুইটা মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। আর তৃতীয় টার্মে আমি পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। বাংলাদেশের পরিবর্তনের সময়ে এবং অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রেল, খাদ্য, কৃষি সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির এই সময়ে আমি সংসদ সদস্য, প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি এতে আমি গর্বিত। আমি এই পরিবর্তনের যুগের একজন দর্শক। আমি কাজ করার চেষ্টা করেছি। সারাদেশে যেমন বড় বড় প্রকল্পে আমি অংশগ্রহণ করেছি তেমনি আমার এলাকাতেও আমি কাজ করেছি।

সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় একনেকের এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আমি যুগান্তকারী কিছু কাজ করেছি। বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করেছি, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট করেছি, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ বেড হসপিটাল করেছি, রানীগঞ্জের সেতু করেছি, উড়াল সেতু করেছি, সড়কসহ আরো অসংখ্য কাজ করেছি। মানুষ এ সকল কাজ চোখে দেখছে। সুতরাং এই কাজগুলোই জনগণের কাছে আমার বার্তা। আমি নিজে গ্রামের ছেলে, আমি গ্রামের প্রতিনিধিত্ব করি এবং আমার বিশ্বাস গ্রামের মানুষেরা উন্নয়ন চায়। গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের জীবনে এক নম্বর চাওয়া হলো তার পরিবার, তার সন্তান, এক নম্বর চাওয়া তার খাবার, তার রুজি। তারা প্রাধান্য দেয় তাদের যাতায়াত ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা, খাল পার হওয়ার সেতুটি আছে কি না, বিনামূল্যে ওষুধ পাচ্ছে কি না।

গ্রামের দরিদ্র মানুষের প্রথম চাওয়া সে একটি সরকারি সহায়তা কার্ড পাবে কি না, সে একজন ভূমিহীন-সহায় সম্বলহীন ভাসমান মানুষ তার প্রথম চাওয়া সে কোনো আশ্রয়ন প্রকল্পে সুন্দর একটি থাকার ঘর পাবে কি না যে প্রকল্প মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুরু করেছেন। সুতরাং আমরা মানুষের চাওয়া গুলো নিয়ে কাজ করছি। মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে এবং আমরা বিশ্বাস করি আগামী নির্বাচনে আমরা আবার সরকার গঠন করতে পারব।

কালবেলা : নির্বাচনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশ্যে আপনার কোনো বার্তা আছে কি না?

এম এ মান্নান : আমার দলের চেয়ারপারসন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দলের পক্ষ থেকে বার্তা দিয়েছেন। আমি সেই বার্তার সঙ্গে একমত পোষণ করি। আমার একটিই বার্তা আর তা গ্রামের মানুষের প্রতি। বাংলাদেশের প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। তাদের প্রতি আমার আবেদন- বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারই প্রথম সরকার যে সরকার গ্রামের দিকে নজর দিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার গ্রামে বিনিয়োগ করেছে আগের থেকে অনেক বেশি। শেখ হাসিনা গ্রামে বিদ্যুৎ দিয়ে জীয়নকাঠির মতো কাজ করেছেন। গ্রামকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন। সেই গ্রামের ভোটারদের প্রতি আমার আবেদন থাকবে- তারা যেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অবদানকে মনে রাখেন। গ্রামের মানুষের প্রকৃত বন্ধু কে, গ্রামের মানুষের জীবনে দৃশ্যমান পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন কে সেটা যেন তারা মনে রাখেন। আমার বিশ্বাস আমার এলাকার লোকজন, আমার প্রতিবেশীরা এবং যাদের সঙ্গে আমি কাজ করি তারা আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার এই অবদানকে মনে রাখবেন।

শ্রুতিলিখন : মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১০

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১১

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১২

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৩

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৪

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৫

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

১৬

জুলাই বিপ্লবে আহত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বাবুকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড

১৭

মাদকাসক্ত ছেলেকে কারাগারে দিলেন মা

১৮

কপ২৯-এর এনসিকিউজি টেক্সট হতাশাজনক : পরিবেশ উপদেষ্টা

১৯

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপদ থাকবে যেসব দেশ

২০
X