ড. শামসুল আলম, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী। ২০০৯ সালের ১ জুলাই পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। সিনিয়র সচিব পদে দীর্ঘ এক যুগ চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব পালন করে ২০২১ সালের ১৮ জুলাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ড. শামসুল আলম ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে ব্যাংককের থাম্মাসাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ও ১৯৯১ সালে ইংল্যান্ডের নিউক্যাসল আপন টাইন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।
কালবেলা : বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট মূল্যস্ফীতি। হঠাৎ এই ব্যাপক মূল্যস্ফীতি কেন হলো এবং এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন? মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার?
ড. শামসুল আলম : বাংলাদেশে মূলত মূল্যস্ফীতি শুরু হয়েছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে। সে সময় বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। স্থবির হয়ে পড়েছিল আমদানি এবং রপ্তানি বাণিজ্য। যুদ্ধের কারণে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসে এবং নৌ-চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য অনেক বেড়ে যায়। শুধু জ্বালানি তেল নয় বরং অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দামও অনেক বেড়ে যায়। ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ অনেক কৃষিপণ্য আমরা আমদানি করে থাকি। এমনকি এ বছর আমাদের আলুও আমদানি করতে হয়েছে। অর্থাৎ আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্যসামগ্রী আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
চলতি বছর আমাদের ডিম আমদানি করতে হয়েছে যা একটি নতুন চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিতবাহী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগের সময়টিতে অর্থাৎ কোভিডপরবর্তী বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির পুনরুত্থান ঘটছিল। ফলে সে সময় বিশ্বব্যাপী পণ্য উপকরণ চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সরবরাহব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হঠাৎ করে সবকিছুর দাম অনেক বেড়ে যায়। বিশ্বব্যাপী ডলারের চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমেরিকান ফেডারেল ব্যাংক সুদের হার অনেক বাড়িয়ে দেয়। ফলে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ডলার সংকট বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে যায় এবং টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে। যেখানে আমরা ৮৫-৮৬ টাকায় এক ডলার পেতাম সেটা ১১০-১১২, আবার কার্ব মার্কেটে ১২৫ পর্যন্তও উঠে যায়। এই সংকটের বেশিরভাগই ঘটে গত দেড় বছরের মধ্যে।
এমনিতেই বাংলাদেশ কিছুটা মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল। তার ওপর টাকার মূল্য কমে গিয়ে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দ্বিমুখী চাপে পড়ি আমরা। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, তার ওপর আমাদের টাকার অবমূল্যায়ন অর্থাৎ আমাদের আমদানির খরচ অনেক বেড়ে গেল। এই প্রথম আমাদের দেশে ডলারের এবং একই সঙ্গে উচ্চমূল্যে পণ্য আমদানির কারণে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখার জন্য সরকার তাৎক্ষণিকভাবে অনেক ব্যবস্থাও নিয়েছে। সর্বপ্রথম ডলার রিজার্ভ বাড়াতে সরকার আমদানিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। বিলাসজাত দ্রব্য অর্থাৎ যেগুলো একেবারেই অতি প্রয়োজনীয় নয় সেগুলোর আমদানি প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হলো। আমদানি কর কমানো হলো। সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অপসৃত হলো। খাদ্যপণ্য এবং অন্যান্য কাঁচামাল যেগুলো আমাদের উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন সেগুলোর আমদানি চলতে থাকে।
আমরা যখন বেশি দামে পণ্য ও উৎপাদন উপকরণ আমদানি করা শুরু করলাম তখন দেশে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেল। আমাদের দেশের বিভিন্ন পণ্য বা দ্রব্যের কাঁচামাল আসে দেশের বাইরে থেকে। কাঁচামালের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিক্রয়ের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। ফলে আমদানিকৃত ও অধিক চাহিদা সম্পন্ন যে মূল্যস্ফীতি তার পাশাপাশি খরচ তাড়িত মূল্যস্ফীতি আমাদের সামনে আসল। অর্থাৎ আমাদের আগের মূল্যস্ফীতি ছিল চাহিদা বৃদ্ধিজনিত কারণে। আর পরে মূল্যস্ফীতি ঘটল আমদানি খরচ বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির দ্বিমুখী শক্তির কবলে পড়লাম আমরা। বিশ্ববাজারে দাম কমে আসলেও আমাদের দেশে এখনো সেটার প্রভাব পড়েনি। কারণ একবার দাম বেড়ে গেলে বা উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলে সেটা কমতে সময় নেয়।
কালবেলা : প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতি অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। আপনি বলছেন আমাদের দেশেও মূল্যস্ফীতি কমা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের দেশে এটা নিয়ন্ত্রণে আসছে না কেন?
ড. শামসুল আলম : অন্যান্য দেশ যেমন- ভারতের উদাহরণ দেওয়া যায়, তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাল, গম, পোল্ট্রি খাদ্য, গো-খাদ্য, ফিশারিজ ফিড এগুলো তাদের আমদানি করতে হয় না। ফলে ডিম উৎপাদন কিংবা মাছ ও মাংস উৎপাদনে তাদের খরচ বাড়েনি। অন্যদিকে আমরা এসব দ্রব্যের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আমাদের আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় ডিম ও মাছ-মাংস উৎপাদনে খরচ বেড়ে গেছে। ফলে এই ব্যয় তাড়িত মূল্যস্ফীতি সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
আমাদের চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতিটা হয়ে গেল উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি। আর ডিমের বাজারের মূল সমস্যাটা উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কিছু খামারি উৎপাদন থেকে বেরিয়ে যাওয়া। এ ছাড়াও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যায়, অনেক উৎপাদন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত প্রযুক্তিগতভাবে অনেক এগিয়ে। প্রতি ইউনিটে আমাদের চেয়ে উৎপাদন বেশি।
ভারতে প্রতি একর জমিতে যে উৎপাদন হয় আমরা সেই তুলনায় পিছিয়ে। ফলে ভারতের ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ কমে যায়। আমাদের মূল্যস্ফীতিটা যেহেতু উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি সুতরাং এটা কমতে সময় লাগে।
কালবেলা : যেহেতু আমাদের দেশে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি সুতরাং আমরা কি আমদানিনির্ভর এসব পণ্য দেশীয় উৎপাদনের জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছি?
ড. শামসুল আলম : কৃষিপণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারলে অবশ্যই সেটা আমাদের জন্য ভালো হতো। কিন্তু আমরা সেটা পারছি না। আমরা চাল উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলি কিন্তু সেটাও প্রতিবছর নিশ্চিত নয়। কারণ কোনো কোনো বছর আমাদের চালের ঘাটতি পরে। আমাদের দেশে উৎপাদিত কোনো চাল দেশের বাইরে রপ্তানি হয় না। অর্থাৎ আমাদের দেশে উৎপাদিত চাল আমাদের দেশেই থাকে। কিন্তু দেখা যায় কোনো কোনো বছর আমরা মোটা চাল আমদানি করছি। আমাদের উৎপাদন ঘাটতি না থাকলে আমরা আমদানি করব কেন?
চাহিদার সমপরিমাণ সরবরাহ থাকলে মূল্য বাড়ার কথা নয়। আমাদের দেশে মূল্য বাড়ছে কেন? মূল্য বাড়ছে কারণ চাহিদার সমপরিমাণ সরবরাহ নেই। অর্থাৎ জোগানের ঘাটতি রয়েছে। যে বছর আমাদের উৎপাদন আমাদের চাহিদার প্রায় সমপরিমাণ থাকে সে বছর মূল্য বাড়ে না।
কালবেলা : আমি কিছুদিন আগে ফরিদপুরের একটি জায়গায় দেখেছি কৃষক ২০ টাকা কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। সেই পেঁয়াজের দাম ঢাকায় ১৫০ টাকা কেন?
ড. শামসুল আলম : ঢাকায় যে পেঁয়াজ আসে এবং কৃষক স্থানীয় বাজারে যে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন তা এক নয়। ঢাকায় আমরা যেটা পাই সেটা হয়তোবা ভারত থেকে আসা অথবা এটা দীর্ঘদিন সংরক্ষিত রাখার ফলে শুকিয়ে পরিমাণ অনেক কমে যায় এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবহন ব্যয়। পেঁয়াজ একটি ভারী পণ্য হওয়ায় এর পরিবহন ব্যয় অনেক বেশি। ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় গ্রামে উৎপাদিত একটি পণ্যের মূল্য ৫০ টাকা হলে ঢাকায় সেটা ১০০ টাকা হবে।
এ ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির আরেকটি কারণ উৎপাদন ঘাটতি। পণ্যের অমৌসুমে দাম বাড়ে। তবে কর্তন মৌসুমে দাম বাড়ে না। কারণ সে সময় পর্যাপ্ত জোগান থাকে। দাম বাড়ে অমৌসুমে- যখন বাজারে সরবরাহ কমে যায়। অমৌসুমে দাম বাড়ে কারণ- যারা পণ্য স্টোরেজে রেখেছে সেই পণ্য শুকিয়েছে, ওজন কমে গেছে, অনেক পণ্য পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া কোল্ড স্টোরে রাখার একটি ব্যয় রয়েছে এবং পরিবহন ব্যয় রয়েছে। ফলে দাম এমনিতেই বৃদ্ধি পায়। এ বছর আলুর দাম বেড়েছে কারণ আলুর উৎপাদনে এ বছর কম হয়েছে। গত বছর আলুর দাম কম থাকায় এবার কৃষকরা আলুর চাষ কম করেছেন।
অমৌসুমে হঠাৎ করে দাম অনেকটা বেড়ে যায় কারণ আমরা সময়মতো আমদানি করি না। আমরা আমদানি করতে চাই না কারণ কৃষি বিভাগ এবং কৃষি মন্ত্রণালয় চায় দাম বাড়ুক। দাম কিছুটা বাড়ার অর্থ হচ্ছে কৃষকরা যাতে লাভবান হন। এ কারণে সময়মতো আমদানি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে দাম হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যায়। আমরা শুধু তখনই আমদানির সুযোগ দিই যখন দাম বাড়ার কারণে জন-অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়। যখন আমদানি সুযোগ দেওয়া হয় তারপরেও সেই পণ্য দেশে আসতে এক থেকে দুই মাস সময় লেগে যায়। কাজেই এই সময়টাতে দাম বাড়তেই থাকে।
এখানে সমাধানের জন্য আমাদের প্রথমত উৎপাদনের সঠিক তথ্য পেতে হবে। উৎপাদনের সঠিক তথ্য পেলে কৃষি বিভাগ সময়মতো পদক্ষেপ নিতে পারে যে কখন ঘাটতি হতে পারে এবং কখন আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে। আমরা যদি শুধু বলতেই থাকি, ফলন খুব ভালো হয়েছে, এবার ফলন অনেক বেশি হয়েছে, তখন ব্যবসায়ীরা বিভ্রান্তিতে থাকে। তারা মনে করে, যেহেতু দেশেই পণ্য রয়েছে সুতরাং আমদানি নিয়ে তারা চিন্তা করে না।
অমৌসুমে দাম বৃদ্ধি পেলে সেখানে আপত্তি নেই যদি তা একটি যৌক্তিক সীমার মধ্যে থাকে। যদি দাম অস্বাভাবিক পরিমাণ বেড়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে বাজারে পণ্যের ঘাটতি রয়েছে। রপ্তানি, আমদানি বাজার আরও উন্মুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
কালবেলা : পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বাজারে সিন্ডিকেটের কথা বলেছেন অনেকে। আপনিও কী এ বিষয়ের সঙ্গে একমত?
ড. শামসুল আলম : যখন একটি পণ্যের উৎপাদন ঘাটতি থাকে তখন সিন্ডিকেশনের সুযোগ তৈরি হয়। উৎপাদন যদি চাহিদার কাছাকাছি হয় তাহলে কোনোভাবেই সিন্ডিকেশনের সুযোগ তৈরি হবে না। আবার উৎপাদন যদি ঘাটতি থাকে এবং আমরা যদি সময়মতো আমদানি করি তাহলেও সরবরাহের ঘাটতি হবে না। সরবরাহের ঘাটতি না থাকলে সিন্ডিকেশনের সুযোগ তৈরি হয় না।
পিটিয়ে বা ধমকিয়ে সিন্ডিকেশন থামানো যাবে না। বাজার চলে বাজারের নিয়মে এবং মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চাহিদা এবং জোগানের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারিত হয়। ফলে কোনো জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়া বা কমার ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তেমন কিছু করার নেই। আমাদের বাজার অর্থনীতির নিয়ম মেনে চলতে হবে। অর্থনীতির নিয়মকে অনুসরণ করতে হবে। আগে আমাদের দাম বাড়ার কারণ বুঝতে হবে। ভোক্তা এবং কৃষক দুজনের দিকেই নজর রাখতে হবে সরকারের। কারণ সরকারের কাছে ভোক্তা এবং কৃষক দুজনেই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের দেশে কৃষি বাজার ব্যবস্থাপনাটি যতটা বাজারভিত্তিক হওয়া দরকার ঠিক ততটা নয়। আমাদের কৃষি বাজার ব্যবস্থা অনেকটা হস্তক্ষেপের উপরে চলে। আমাদের উচিত বাজারকে কাজ করতে দেওয়া এবং বাজারের সংকেত কে অনুসরণ করা। সংকেত বলতে বোঝানো হচ্ছে দাম যদি অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে তাহলে বুঝতে হবে উৎপাদনের ঘাটতি রয়েছে। তখন সঙ্গে সঙ্গেই আমদানি করতে হবে। সময়মতো আমদানি করলে দাম আর বাড়তে পারে না এবং সিন্ডিকেশনও হতে পারে না। অর্থনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করেই আমরা সিন্ডিকেশনকে বন্ধ করতে পারি। সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য পেটানো বা গুদামে হানা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
কালবেলা : সরকারের বৈদেশিক ঋণ নিয়ে সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার পার হয়েছে। রিজার্ভ ঘাটতির এই সময়ে অনেকে এই ঋণ পরিশোধের বিষয়ে শঙ্কা বোধ করছেন। আপনি কী মনে করেন?
ড. শামসুল আলম : বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন স্বাভাবিক গতিতে প্রবাহমান ছিল তখন আমাদের বৈদেশিক ঋণ নেওয়াটা সঠিক ছিল। কারণ আমরা তখন অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়াতে যাচ্ছিলাম। বিনিয়োগ হলে উৎপাদন বাড়ে, বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান বাড়ে, মানুষের আয় বাড়ে। যেহেতু আমাদের দেশে এখন দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ব্যবসায়ী প্রজন্ম গড়ে উঠেছে যারা লেখাপড়ায় অগ্রসর এবং করপোরেট নীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য চালায়। ফলে তাদের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করা এবং এর জন্য বৈদেশিক ঋণ নেওয়া সঠিক ছিল। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরে বিনিয়োগেরও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ফিলিপাইনে ওষুধ ফ্যাক্টরি তৈরির জন্য বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমরা সিঙ্গাপুরেও বিনিয়োগ করেছি। বাংলাদেশের প্রাণ কোম্পানি বিভিন্ন দেশে তাদের কারখানা খুলেছে।
সাধারণভাবেই আশা করা যায়, বিদেশে বিনিয়োগ করলে লভ্যাংশ দেশে আসবে। ফলে সে সময় বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। তবে এখন আমরা ডলার সংকটে পড়ার কারণে কিছুটা চাপে পড়েছি। সরকারি ঋণ বেড়েছে, সরকার ঋণ নিয়েছে কারণ সরকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চাচ্ছিল এবং চাঙ্গা রেখেছিল। সরকার ঋণ নিয়েছে কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে সরকার তার সামর্থ্যের বাইরে ঋণ নেয়নি। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফ কর্তৃক স্বীকৃত একটি দেশের যে কমফোর্ট জোন আমাদের ঋণের পরিমাণ তার থেকে অনেক নিচে রয়েছে। আইএমএফের স্বীকৃত বিধান মতে একটি উন্নয়নশীল দেশ তার জিডিপির ৭০ ভাগ পরিমাণ ঋণ নিতে পারে। সেখানে বাংলাদেশের মোট ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৪০-৪৩ শতাংশের মধ্যে। সেই অর্থে বিবেচনা করলে আমাদের ঋণ নেওয়াটা নিরাপদ সীমার মধ্যে ছিল।
এখন আমাদের দেখার বিষয় হলো আমরা যে ঋণ নিয়েছি সেটা কতটা উৎপাদন খাতে ব্যয় করেছি এবং তার থেকে কতটা রিটার্ন আসবে। ঋণ নিয়ে যদি আমরা এমন প্রকল্পে ব্যয় করে থাকি যার থেকে যথেষ্ট পরিমাণ রিটার্ন আসে না, তাহলে সেটা পরিশোধ আমাদের জন্য কঠিন হবে। যেমন আমাদের রেলওয়ে লাভজনক নয়। যদিও রেল আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ তবুও আমরা যদি ঋণ নিয়ে তা অনেক রেলওয়েতে ব্যয় করি তবে সেখান থেকে রিটার্ন আসা অনেক কঠিন। সুতরাং লোকসানি খাতে ঋণের অর্থ বিনিয়োগ না করাই ভালো। এসব জায়গায় প্রয়োজন হলে দেশের টাকা বিনিয়োগ করতে হবে।
কালবেলা : ২০২৪ সাল থেকে আমাদের বৈদেশিক ঋণের কিস্তি শোধ করতে হবে। সেটা কি আমাদের জন্য বড় কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে বলে মনে করেন?
ড. শামসুল আলম : আমি মনে করি, আমাদের এখন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক অনেক সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আগে যদি আমরা ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে একবার ভেবে থাকি তাহলে এখন তিনবার ভাবতে হবে। কোনোভাবেই এমন ঋণ নেওয়া উচিত হবে না যেখান থেকে সম্পূর্ণ টাকাটা রিটার্ন না আসে। অথবা এমন ঋণ নেওয়া উচিত হবে না যেটা আমাদের অর্থনীতিকে সচল এবং সবল করবে না। এমনকি ব্যক্তি খাতকে ও ঋণ দেওয়ার ব্যাপারেও এখন অনেক সতর্ক হওয়া উচিত।
আমাদের দায় শোধের চাপ বাড়ছে। এমন সময় এটা বাড়ছে যখন আমরা আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে পারছি না। আমরা অনেক চেষ্টা করেও আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে পারছি না কারণ ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে এখন অবশ্যই আমাদের সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের আমদানি, রপ্তানি, বিনিময় হার সবকিছু সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য উন্মুক্ত থাকতে হবে।
কালবেলা : অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের রিজার্ভে এই পতন ঘটল কেন এবং আমরা রিজার্ভ বাড়াতে পারছি না কেন?
ড. শামসুল আলম : আমরা রিজার্ভ বাড়াতে পারছি না তার একটি কারণ ডলারের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। অনেক ডলার ব্যক্তি খাতেও দিতে হয়েছে। অধিক চাহিদায় ব্যাংকগুলোকে ডলার দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া প্রত্যেকবার নির্বাচনের আগে বিদেশে পুঁজি যাওয়ার পরিমাণটা অনেক বেড়ে যায়। এর কারণ সম্ভবত মানুষ এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ভোগে। মানুষ হয়তো নিজেকে অনিরাপদ মনে করে। ফলে তারা পুঁজি বিদেশে নিয়ে রাখলে প্রয়োজনে তারা বিদেশে চলে যেতে পারবে। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে- নির্বাচনের বছরে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়।
যেহেতু আমাদের নির্বাচন আসন্ন ফলে অনেকেই নানাভাবে বিদেশের টাকা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। হুন্ডিসহ নানাভাবেই এই টাকা বিদেশে যায়। ফলে এদের ধরা অনেক কঠিন। আমাদের এবারের রিজার্ভ সংকটের একটি বড় কারণ সম্ভবত আমাদের পুঁজি পাচার বেশি হয়েছে। এ ছাড়া এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ইমপোর্টের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং- এই দুইটার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অনেক অর্থ পাচার হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
এ ছাড়া আমার মনে হয়, বাংলাদেশে আমরা অর্থ-পুঁজির নিরাপত্তাটা কম দিতে পারছি। ফলে অনেকেই বাংলাদেশে পুঁজি রাখাটাকে নিরাপদ মনে করে না। তারা মনে করে, যে কোনো সময় তাদের পুঁজির তথ্য প্রকাশিত হয়ে যেতে পারে এবং তারা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে, এ তো অর্থ কোথা থেকে এলো। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আইনকানুন পাল্টানোর প্রয়োজন। অর্থ-পুঁজির কঠোর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার কারণেই সুইজারল্যান্ড, দুবাই, লন্ডন এসব দেশে তৃতীয় বিশ্বের সব পুঁজি সম্পদের সমাবেশ ঘটছে। আমরা যদি সপ্তাহে এক দিনে ১০ লাখ টাকার বেশি ব্যাংক থেকে উঠাই তবে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকে জানাতে হয়। এটা কেন! আমার টাকা আমি ১০ লাখ টাকা, ২০ লাখ টাকা কত টাকা উঠাব সেটা আমার ব্যাপার। আমি সরকারকে নির্ধারিত ট্যাক্স পরিশোধ করি। আমার টাকা আমি প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে উঠাব অথবা ব্যাংকে জমা রাখব। সেখানে তথ্য উন্মুক্ত রাখা সমীচীন নয়। সুনির্দিষ্ট সন্দেহভাজন অ্যাকাউন্টেই কেবল টাকা উত্তোলনের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক চাইতে পারে অন্যথায় নয়।
কালবেলা : বাংলাদেশের ট্যাক্স জিডিপির রেশিও পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
ড. শামসুল আলম : ট্যাক্সের ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমাদের নেওয়া উচিত ছিল আমার মনে হয় আমরা তা নিতে পারিনি। প্রায় সব দেশে ট্যাক্সের প্রধান অংশটি আসে আয়কর থেকে। অন্যদিকে আমাদের ক্ষেত্রে সেটা আসে পরোক্ষ কর থেকে। অর্থাৎ মূল্য সংযোজনী কর, এক্সাইজ ডিউটি এসব থেকে। আমাদের ট্যাক্স আদায়ের পদ্ধতি সনাতনী। এটা ব্যাপক অনলাইন সিস্টেম নয় এবং তাৎক্ষণিক নয়। ফলে অনেকেই মনে করেন এখানে বড় ধরনের ব্যত্যয় রয়েছে। বিভিন্ন বিক্রয়ের ভ্যাটের তথ্য ক্যাশ বইয়ে কেন থাকবে! দোকানে ইলেকট্রনিক্স ফিসক্যাল ডিভাইস ব্যবহার বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন। ট্রানজেকশনের সঙ্গে সরাসরি সরকারি হিসেবে চলে যাওয়া উচিত। সব ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন করা উচিত।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে একটি বিরাট ধনাঢ্য শ্রেণি তৈরি হয়েছে সেখানে আয়কর কেন বাড়বে না? এর অর্থ দাঁড়ায় ব্যক্তিগত আয় থেকে আমরা ঠিকমতো কর নিতে পারছি না। এক্ষেত্রে এনবিআরকে এই বিষয়ে দেখা উচিত এবং তাদের জবাবদিহিতাও নেওয়া উচিত। এ দেশের নাগরিকরা কারা ধনী সেটা আমাদের জানা আছে। কারা ট্যাক্স পরিশোধ করে সেটাও আমাদের জানা আছে। তাদের আয় এবং মুনাফা বাড়বে কিন্তু আয়করের পরিমাণ কেন বাড়বে না!
আমাদের ট্যাক্সব্যবস্থা এবং করব্যবস্থা কে আমরা উন্নয়নমুখী হিসেবে চিন্তা করিনি। রাজস্ব আয় বাড়ানোই দেশের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত নাগরিকদের আয় বাড়ানো। আয় বাড়লে তখন করের পরিমাণও বাড়বে। আমরা এমনভাবে বেশি আমদানি কর ধার্য করি যাতে আমদানির খরচ অনেক বেড়ে যায়। মূল্যস্ফীতির জন্য এটাও একটি কারণ হতে পারে।
কালবেলা : ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়েছে। এটাকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না কেন?
ড. শামসুল আলম : নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা উচিত। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা দরকার। ব্যাংকসহ সব প্রতিষ্ঠানের লেনদেনই স্বচ্ছতার মধ্যে আসতে হবে। লাঙ্গলের পেছনের মানুষটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। লাঙ্গল উন্নত যত আধুনিক হোক, পেছনের মানুষটা যিনি লাঙ্গলটা ধরবেন তিনি যদি ঠিকমতো না ধরেন তাহলে তো চাষাবাদ ভালো হবে না।
কালবেলা : অর্থনৈতিক সংকট চলমান অবস্থায় রাজনৈতিক সংকটও যুক্ত হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হরতাল এবং অবরোধসহ একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এগুলো কি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলবে?
ড. শামসুল আলম : অর্থনীতি এবং রাজনীতি একটির সঙ্গে অন্যটি অঙ্গাভঙ্গিভাবে জড়িত। রাজনীতি স্থিতিশীল থাকলে অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতার দিকে পরিচালিত হয়। রাজনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হলে অর্থনীতিও কোনো না কোনোভাবে অস্থিরতার দিকে যায়। অর্থাৎ রাজনীতি এবং অর্থনীতির আন্তঃসম্পর্ক খুবই নিবিড়। ফলে এক ধরনের রাজনৈতিক সংকট রয়েছে এটা বলা যায়। অর্থনীতির ওপর এই সংকট প্রতিফলিত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগে প্রভাব পড়ছে। পুঁজি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে সেটাও এই অনিশ্চয়তার কারণে। এ কারণেই বলেছি নির্বাচন আসলে বেশি পুঁজি পাচার হয়।
রাজনীতিতে অস্থিরতা থাকলে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা কঠিন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ছাড়া অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা আমাদের জন্য কঠিনই থেকে যাবে বলে মনে হয়। বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের বিবেচনা করতে হবে এবং অর্থনৈতিক স্বার্থটাকেই আগে দেখতে হবে। যদিও গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতিই শেষ কথা, তারপরও অর্থনীতিকে বাঁচালেই রাজনীতি ও গণতন্ত্র সবই টিকবে। শেষ বিচারে অর্থনীতি না বাঁচলে একসময় রাজনীতিও টিকবে না, গণতন্ত্র টিকবে না। কাজেই অর্থনীতিকে সবার আগে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
কালবেলা : আমাদের ডলার সংকট কীভাবে কাটানো যায় বলে মনে করেন?
শামসুল আলম : সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করেছে। এর পাশাপাশি আমরা প্রবাসী আয়ের ডলার দেশে আসার জন্য কীভাবে উৎসাহিত করা যায়- সে বিষয়ে আলোচনা করেছি। বিদেশ থেকে কেউ দেশে আসার সময় সে সঙ্গে করে কত ডলার নিয়ে এসেছে সেটা এয়ারপোর্টে জানাতে হয়। ১০ হাজার ডলার নিয়ে আসলেও সেটা ঘোষণা দিতে হয়। এই নিয়মটি কেন? আমি তো ডলার দেশে নিয়ে আসছি, সে ক্ষেত্রে আমাকে ঘোষণা দিতে হবে কেন! ঘোষণার ভয়ে অনেকে ডলার দেশে নিয়ে আসতে চায় না, অনেকে লুকোচুরি করে অথবা হুন্ডির আশ্রয় নেয়।
পৃথিবীর কোনো দেশে আমি দেখিনি কেউ দেশে ফেরার সময় এয়ারপোর্টে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় কত ডলার আনলেন। দেশে ফেরার সময় একজন ব্যক্তি যা খুশি তাই আনতে পারে। ডলার আনতে পারে, স্বর্ণ আনতে পারে বা অন্য কিছু আনতে পারে। অবৈধ কোনো কিছু না নিয়ে আসলে তো তাকে আটকানোর কোনো মানে হয় না। ডলার বা স্বর্ণ যেটাই নিয়ে আসুক সেটা তো দেশের অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। আর অর্থনীতিতে যোগ হওয়া মানে প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা। তাহলে কেন আমার দেশের এয়ারপোর্টে একটি ফর্মে আমাকে উল্লেখ করতে হবে আমি কত ডলার নিয়ে আসলাম!
অনেকে বলতে পারেন, বেশি ডলার নিয়ে আসলে তার থেকে একটি ট্যাক্স পায় সরকার। কিন্তু এই সামান্য ট্যাক্সের জন্য দেশে ডলার প্রবেশে মানুষ অনুৎসাহিত হচ্ছেন। দেশে ডলার ঢুকলে সেটা তো তারা সিন্দুকে আটকে রাখবে না। অর্থনীতিতে ডলার ঢুকলে সেখান থেকে যে আয় বাড়বে তা থেকে সরকার ট্যাক্স পাবে। সেখান থেকে তো সরকার লাভবান হবেই। ফলে আমি মনে করি, এয়ারপোর্ট দিয়ে ডলার বা স্বর্ণ আসার ব্যাপারে উদারতা থাকা উচিত। কাউকে প্রশ্ন করা উচিত নয় বরং সসম্মানে আনতে দেওয়া উচিত। এটা হলে দেশে ডলারের প্রবাহ বাড়বে। আর ডলারের প্রবাহ বাড়লে তখন সংকট অনেক সহজ হয়ে যাবে।
গত তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসী আয় কমেছে। অনেকে মনে করতে পারেন আমরা তো ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার আসার জন্য ৫ পার্সেন্ট প্রণোদনা দিই। তারপরও ডলার আসা কমছে কেন। এখানে আমি মনে করি- প্রণোদনা দেওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি এক্সচেঞ্জে যেদিন যে রেটে ডলার বিক্রির অনুমতি দেয় প্রবাসী আয়ের ডলারে সেই রেট দিতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আজ মানি এক্সচেঞ্জগুলোকে যে রেটে ডলার কিনতে অনুমতি দিয়েছে প্রবাসী আয়ের ডলারের সেই রেট দিতে হবে। তাহলে তারা ডলারের প্রকৃত বাজার দর পেয়ে যাবেন। আর প্রকৃত মূল্য পেলে তারা তো হুন্ডির চিন্তা করবেন না। এটা করতে পারলে বাড়তি প্রণোদনার দরকার হয় না এবং অতিরিক্ত হিসাব-কিতাবেরও দরকার হয় না। আমার বিশ্বাস এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলে প্রবাসী আয় অনেক বেড়ে যাবে।
এ ছাড়া আমরা যদি ইমপোর্ট এবং এক্সপোর্টের ট্রানজেকশনগুলো অনলাইনের মাধ্যমে করি তাহলে পুঁজি পাচার অনেকাংশে আটকে দেওয়া যাবে। ইমপোর্ট এবং এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে প্রাইজ এবং সোর্স উল্লেখ করতে হবে। ইমপোর্টের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়সিং হচ্ছে কিনা এবং এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে আন্ডার এনভয়সিং হচ্ছে কিনা সেটা অনলাইন সিস্টেমে নজরদারির আওতায় থাকবে। দুনিয়াব্যাপী কোথায় কোন পণ্য কত দামে ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে সেটা এখন এক নিমেষে জানা যায়। কমোডিটি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে প্রত্যেক পণ্যের দাম প্রতি মুহূর্তের আপডেট উন্মুক্ত থাকে। আমরা যেসব পণ্য অনেক বেশি আমদানি করি সেগুলোর সব ই-কমোডিটি এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত। সুতরাং কেউ ওভার ইনভয়সিং করলে তাৎক্ষণিকভাবে সেটা শনাক্ত করা সম্ভব। আমি মনে করি, এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্য দ্রুত গ্রহণ করা উচিত।
আমরা স্বর্ণের অলংকার কিনতে ভারতে যাই, দুবাই যাই। দুবাই থেকে প্রতিদিন বিশাল পরিমাণ স্বর্ণালংকার বিক্রি হয়। অথচ দুবাই নিজে কোনো স্বর্ণ উৎপাদন করে না। দুবাইতে কোনো স্বর্ণের খনিও নেই। কিন্তু দুবাইতে স্বর্ণের আমদানি অবাধ। সুতরাং বাংলাদেশে কেউ স্বর্ণ আনলে আমরা কেন তাকে ধরব! একজন ৫টি স্বর্ণের বার আনল, কেন একজন ১০টি স্বর্ণের বার আনল, কেন আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই। দেশে আনার সময় বাধা কেন দেব? কেউ নিয়ে আসলে সেটা দেশের ভেতর ঢুকতে দেওয়া উচিত। কেউ স্বর্ণ নিয়ে আসলে সেটি দেশের ভেতরে ঢুকে তো সিন্দুকে ভরে রাখবে না। এটা ভ্যালু এডিশনে যাবে, অলংকার তৈরি হবে। যখন আমরা অবাধে স্বর্ণ আনতে দেব তখন স্বর্ণের দাম সস্তা হবে এবং বাংলাদেশ বিদেশে স্বর্ণালংকার এক্সপোর্টও করতে পারবে। ভারত, দুবাই বা এই ধরনের দেশগুলো এই নীতিতে চলে। আমাদেরও বিদেশ থেকে ডলার বা স্বর্ণ নিয়ে আসতে কোনো ধরনের বাধা দেওয়া উচিত নয়।
শ্রুতিলিখন : মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন